Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

ইসলাম ও পাশ্চাত্যের মধ্যে দ্বন্দ্বের স্বরূপ

Icon

সাদ হাফিজ

প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর ২০১৯, ০১:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ইসলাম ও পাশ্চাত্যের মধ্যে দ্বন্দ্বের স্বরূপ

পশ্চিমা দেশগুলোর রাজনীতিক ও পণ্ডিত এবং জিহাদিদের মধ্যে অভিন্ন কিছু বিষয় রয়েছে। তারা উভয়েই পশ্চিমা ও মুসলিম বিশ্বের মধ্যকার সংঘাতকে ‘ক্লাশ অব সিভিলাইজেশন’ বা সভ্যতার সংঘাত মহাথিসিসের আয়নায় দেখে থাকেন।

কেউ কেউ একে চিরন্তন যুদ্ধ হিসেবে বিবেচনা করেন। আমি মনে করি, এ দৃষ্টিভঙ্গি একটি মহাভুল। এ দৃষ্টিভঙ্গি নিবিড় বিশ্লেষণের দাবি করা একটি জটিল সমস্যাকে অনেক বেশি সরলীকরণ করে ফেলে।

৯/১১-এর পর থেকে উগ্র ইসলামী সন্ত্রাসবাদ হয়ে পড়েছে উত্তেজনা সৃষ্টিকারী হেডলাইন। সন্ত্রাসীদের নৃশংসতা ইসলাম ও মুসলিমদের প্রতি বৈরিতার চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছেছে। কিন্তু আমরা ভুলভাবে ইসলামকে একশীলা স্তম্ভ হিসেবে বিবেচনা করছি। এ বিবেচনার মধ্যে যে বিষয়টি হারিয়ে গেছে তা হল বেশিরভাগ মুসলিম দারিদ্র্য, অশিক্ষা ও বেকারত্বের সঙ্গে লড়াই করছে।

পশ্চিমা ‘জীবনযাপন’ ধ্বংস করার আকাঙ্ক্ষার কথা দূরে থাক, পশ্চিমা পদ্ধতির ‘জীবনযাপনে’র আশাই তো তারা তেমন করতে পারে না। অন্য সবার মতো মুসলমানরা প্রত্যাশা করেন এমন একটি ন্যায়সঙ্গত সমাজের অংশীদার হওয়ার, যাতে থাকবে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ও সুশাসন।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে সন্ত্রাসী হামলার দুষ্টচক্রের প্রাক্কালে সামরিক ও রাজনৈতিক নেতাদের কঠোর ভাষার প্রতিক্রিয়া যে কেউ বুঝতে পারে। জীবনের ওপারে জিহাদি হিরোদের তালিকায় বিন লাদেনের সঙ্গী হয়েছেন বাগদাদি- এটি জেনে সামান্য সময়ের আনন্দ পাওয়া যাবে; কিন্তু বন্দুকের গোলা ও বোমা নিক্ষেপ বর্বর একটি সংঘাতের সমাধান করে দেবে না। এছাড়া সমস্যাটি সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ভিন্নমতের সঙ্গে কম সম্পৃক্ত এবং আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অসমতার সঙ্গে বেশি সংশ্লিষ্ট।

আমরা জানি, পশ্চিমারা মুসলিম বিশ্বের সাংবিধান তত্ত্ব, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ে ঐতিহাসিকভাবে বক্তব্য দিয়ে গেছে। পশ্চিমাবিরোধী বলে বিবেচিত শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে নির্বাচনী রায় ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য তারা সহায়তা করে গেছে।

যদিও তারা ভণ্ডামিপূর্ণভাবে গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলে গেছে, প্রকৃতপক্ষে পশ্চিমা বিশ্ব কিন্তু কেবল একনায়কদের সঙ্গে কাজ করাকেই প্রাধান্য দিয়ে গেছে (শাহ, জেনারেল জিয়াউল হক, জেনারেল আল-সিসিকে প্রাধান্য দিয়েছে মোসাদ্দেক, ভুট্টো ও মুরসির বিপরীতে)। বলতে কঠিন শোনালেও যখন আইএসের সঙ্গে তুলনা করা হয়, তখন পশ্চিমে সাদ্দাম, গাদ্দাফি ও আসাদের জন্য নস্টালজিয়ায় ভোগে অনেকেই. তাদের প্রায় সবাইকে ধ্বংস করে দেয়ার পরও!

একনায়ক ও স্বৈরশাসকদের প্রতি পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন মুসলিম বিশ্বের অনেক অংশে রাজনৈতিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করেছে। ‘গণতন্ত্র ইসলামের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়’- এ বিতর্কের ন্যায্যতা প্রতিপাদন করা কঠিন, যদি পরিস্থিতি একে সমর্থন না করে। আত্মসেবার এ নীতির পরিণতি হল, এতে করে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো তাদের রক্তপিপাসু আদর্শ ছড়িয়ে দেয়ার সুযোগ পায়।

ধর্ম ও সংস্কৃতিগুলোর মধ্যকার সংঘাত পশ্চিমা ও মুসলিম বিশ্বের বিশেষ স্বার্থান্বেষী গ্রুপগুলোকে সমানভাবে উপকৃত করে। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছে সামরিক শিল্পের জটিল ক্ষমতাশীল পক্ষ এবং জনতুষ্টিবাদী রাজনীতিকরা।

এ গ্রুপটিকে ৯/১১-এর ফলাফল ও সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের মূল বিজয়ী হিসেবে বিবেচনা করি আমি। পশ্চিমা ক্ষমতাশীল এলিট এবং তাদের কৃপাপ্রাপ্ত আরব বিশ্বের একনায়কদের জন্য ‘উগ্র ইসলামী সন্ত্রাসবাদ’ কেবল একটি সাইড শো।

এ স্বার্থান্বেষী মহলের মূল ফোকাস হচ্ছে আকর্ষণীয় অস্ত্র বিক্রি ও তেল ক্রয়। মূল তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা হাতেগোনা কয়েকজনের মধ্যে সীমিত থাকে- এটি তাদের সহায়তা করে। এ সীমিত লোকজনের মধ্যে আছে সৌদি আরব, আরব আমিরাত, কাতার ও কুয়েতের রাজ পরিবারের ২৩ হাজার সদস্য; যাদের সম্পদের অস্বাভাবিক আকার হচ্ছে ২ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলার।

পশ্চিমা বিশ্বের লক্ষ্য হচ্ছে এই একনায়ক-স্বৈরশাসকদের অভ্যন্তরীণ ও বহির্হুমকি থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য তাদের কাছে অস্ত্র বিক্রি করা। বিনিময়ে একনায়করা তেলের জগতে পশ্চিমাদের প্রবেশাধিকার নিষ্কণ্টক রাখে।

মুসলিম বিশ্ব ত্রুটিমুক্ত নয়। আত্মসমালোচনা পরিহার করার মধ্য দিয়ে মুসলমানরা ইসলামী বিশ্বের গভীর অস্থিরতা লুকিয়ে রাখে। ইসলামের ঘটনাবহুল ইতিহাসের প্রথম চারশ’ বছর পর যুক্তিবাদীদের কাছে পরাজয়ের পর থেকে ইসলামে বুদ্ধিভিত্তিক ক্রমাবনতি ঘটেছে।

মুসলমানরা পিছিয়ে পড়েছে, কারণ ইসলামী সমাজগুলোতে মুক্ত অনুসন্ধানকে নিরুৎসাহিত করা হয়। বর্তমানে স্পর্শকাতর এ বিষয়টি নিয়ে একটি পরিশীলিত বিতর্ক মুসলিমদের কাছ থেকে মুখোমুখি অবস্থানের প্রতিক্রিয়া নিয়ে আসে। ইসলাম একটি শান্তিপূর্ণ ধর্ম- এ লাইনের সঙ্গে একাত্ম থাকতেই মুসলমানরা অনেক বেশি স্বস্তি অনুভব করে।

তারা অনুভব করে যে, সামান্য কিছু সন্ত্রাসী ইসলামের বদনাম করেছে, যা অন্যায্যভাবে পশ্চিমা বিশ্বে বৃহদাকারে ইসলামভীতি ছড়ানোর সুযোগ করে দেয়। একইভাবে মুসলিম বিশ্বেও পশ্চিমাবিরোধী অনুভূতি লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে।

আরও বেশি গভীর রাজনৈতিক স্তরে ভিন্নমত ও ভিন্নধর্মী আইডিয়ার প্রতি অসহিষ্ণুতা রয়েছে। সেক্যুলার গণতন্ত্র অনেক মুসলমানের কাছে একটি ঘৃণিত বিষয়, যারা ইসলামকে একটি সম্পূর্ণ জীবন বিধানের বাইরে ভাবতে পারেন না। অনেকে একটি নতুন ধরনের ধারণা পোষণ করে যে, ধর্ম হচ্ছে ব্যক্তি ও সৃষ্টিকর্তার মধ্যকার একটি ব্যক্তিগত বিষয়। ইসলামেও রাজনীতি ও ধর্মকে আলাদা করার কোনো ঐতিহ্য নেই।

বাকি বিশ্ব ধর্ম ও চার্চকে আলাদা করার মূলনীতি, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ধর্মীয় বহুত্ববাদ ও নাগরিক সমাজকে আঁকড়ে ধরাকে মেরিট হিসেবে দেখছে। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে তীব্র বৈপরীত্যে মুসলিম বিশ্বে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ রয়ে গেছে স্বৈরশাসক, ধর্মতন্ত্র বা সামরিক বাহিনীর হাতে। আধুনিক রাজনৈতিক সংজ্ঞায় এটি একটি মারাত্মক সমস্যা এবং পশ্চিমা সভ্যতার সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণ।

যেহেতু পশ্চিমা ও মুসলিম সম্পর্কের মধ্যে একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ আমরা দেখছি, সেহেতু সব পক্ষে সংশোধনের একটি উদ্যোগ যতক্ষণ না আসবে, ততক্ষণ আমরা অব্যাহতভাবে নৈরাজ্য ও ধ্বংস দেখতে পাব। কর্তৃত্ববাদকে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান এবং গণতন্ত্রের প্রতি সর্বোচ্চ সমর্থন অপরিহার্য। যতক্ষণ পর্যন্ত সন্ত্রাসবাদ কেন্দ্রীয় ভূমিকায় রয়েছে, ততক্ষণ পর্যন্ত মুসলমানদের নেতিবাচক ধারণা পরিবর্তন করা কঠিন।

মুসলিম সমাজগুলোর গভীরে জেঁকে বসা চরমপন্থার মূলোৎপাটনেরও সহজ কোনো সমাধান নেই। তারপরও ভয় ছড়িয়ে দেয়া ও লালন করার পরিবর্তে সৎ ও আন্তরিক সংলাপ এবং বিতর্ক চিরন্তন যুদ্ধের হুমকি হ্রাস করতে পারে।

কাউন্টারপাঞ্চ ডটকম থেকে অনুবাদ : সাইফুল ইসলাম

সাদ হাফিজ : ফ্রিল্যান্স কন্ট্রিবিউটর

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম