সন্ত্রাস-দুর্নীতি নির্মূলে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার বাস্তবায়ন হোক
মোল্লা জালাল
প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২০১৯, ০১:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
শেকড় থেকে শিখর পর্যন্ত সন্ত্রাস-দুর্নীতি আর মাদকের মতো অপরাধ নির্মূলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতীয় সংসদে তিনি বলেছেন, সন্ত্রাস-দুর্নীতি আর মাদকের মতো অপরাধ নির্মূলে তিনি বদ্ধপরিকর। এ কথা তিনি আগেও বলেছেন। এবার বললেন জাতীয় সংসদে।
সংসদে বলার অর্থই হচ্ছে, সংসদ নেতা গোটা জাতিকে এ বার্তাটি জানিয়ে দিলেন। সংসদ সদস্যরাও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলছেন এবং দুর্নীতিবাজদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিরও দাবি জানাচ্ছেন। সবাই দুর্নীতিবাজদের শাস্তি দেখতে চায়।
এ দাবিতে জাতি যখন ঐক্যবদ্ধ তখনই সমাজের নানা অবস্থান থেকে সুবিধাভোগী শ্রেণি বিভিন্ন কৌশলে মানুষের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টির পাঁয়তারা শুরু করে। শুরু হয় নানামুখী তৎপরতা। এসব তৎপরতার বিপক্ষে বহু সুবিধাভোগী সুশীল-কুশীলরা নীরবে তামাশা দেখেন। কিছু বলেন না।
অনেকে আবার বলা-কওয়ার ক্ষেত্রেও সুবিধার সন্ধান করেন। হিসাব করেন, চুপ থাকলে কী লাভ আর বললে কী ক্ষতি। প্রধানমন্ত্রী পরিষ্কার করে বলেছেন। কিন্তু বাস্তবায়ন করতে হবে প্রশাসনের লোকদের।
বিচার ও শাসন বিভাগের ব্যাপারে বাংলাদেশের মানুষের বিভিন্ন রকমের অভিজ্ঞতা আছে। আগের কথা বাদ দিলেও স্বাধীনতার ৪৮ বছরের বাংলাদেশকে মানুষ বিভিন্ন রূপে দেখেছে। আজকের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকেও তার পিতামাতা, ভাই ও স্বজনদের খুনের বিচার চাইতে ২১ বছর আন্দোলন করতে হয়েছে। তার পিতা ইতিহাসের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারাজীবন আন্দোলন-সংগ্রাম করে এ দেশটা স্বাধীন করে দিয়েছেন।
সেই মহান ব্যক্তির সপরিবারে হত্যার বিচারের জন্য আন্দোলন করতে হয়েছে। দেশের বিচারব্যবস্থার পরিস্থিতি কী? প্রথমত, দীর্ঘসূত্রতা। এর ফলে মানুষ ন্যায়বিচারের আশা ছেড়ে দেয়। দ্বিতীয়ত, সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করে আদালতে পেশ করা কঠিন ইত্যাদি। এগুলো জোগাড় করার দায়িত্ব পুলিশের। সেখানেও অনেক কথা।
বাংলাদেশের আইন অপরাধীর অধিকারকে সমর্থন করে। যুক্তি হচ্ছে, ন্যায়বিচার। আর অপরাধীরা এ সুযোগটাকেই শতভাগ কাজে লাগায়। কেউ অপরাধ করলে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে, আদালতের মাধ্যমে জেলে পাঠায়। জেলখানা অপরাধীদের জন্য খুবই নিরাপদ আশ্রয়। ওখানে কিছুদিন থেকে জামিনের নানা কায়দায় বাইরে বেরিয়ে আসে। অপরাধীরা জেলে যেতে হবে জেনেই অপরাধ করে।
যেমন- ব্যাংকের কিংবা সাধারণ মানুষের শত শত কোটি টাকা লুটপাট করে জেলে গিয়ে আরামে থাকে। জেল থেকে বেরিয়ে এসে মামলায় লড়ে। ভাব দেখায়, সে নির্দোষ। তার বিরুদ্ধে যা হচ্ছে সবই ষড়যন্ত্র। বছরের পর বছর ধরে মামলা চলে।
এতে অপরাধীর কোনো লোকসান হয় না। কারণ মামলা চলে লুটের টাকায়। কোনো এক সময় মামলা-মোকদ্দমা শেষ হলে তার কাছে অবশিষ্ট যা থাকে তার পরিমাণও বিশাল। ফলে সম্পদের পাহাড় তার থেকেই যায়। আর সেই পাহাড়ের চূড়ায় বসে আইনশৃঙ্খলা, বিচারব্যবস্থা, সরকার ও সাধারণ মানুষকে অপরাধীরা বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায়। এতে উৎসাহিত হয় অন্যরাও। এসব কারণে অপরাধীর ডর-ভয় থাকে না।
রাজধানী ঢাকা শহরে কে কোথায় কী দুর্নীতি করে, সেটা সহজে বোঝা যায় না। এ বিশাল শহরে কে কার খবর রাখে। ফলে শহরের বড় অপরাধীরা লুটের টাকা বিদেশ পাঠায়। বিদেশে সম্পদ বানায়। পরিবার-পরিজন আগেই পাঠিয়ে দেয় বাইরে। লুটের সম্পদ তাদের কাছে গচ্ছিত থাকে। কোনো কারণে অপরাধী ধরা পড়লে বিদেশে তার পরিবারের সদস্যদের কাছে গচ্ছিত অর্থ-সম্পদই তাকে রক্ষা করে।
কিন্তু ঢাকার বাইরে জেলা বা উপজেলায় যারা দুর্নীতি করে টাকা বানায় তাদের টাকা বিদেশে পাঠানোর সুযোগ থাকে কম। তারা গাড়ি-বাড়ি করে। জমি-জমা কেনে। কেউ কেউ আবার শিল্পপতি হয়। এগুলো সাধারণ মানুষের চোখে পড়ে। প্রতিটি এলাকার মানুষ ভালো করেই জানে কার কী আছে, কী ছিল, কী হয়েছে। সাধারণ হিসেবে একজন মানুষ কোথা থেকে সম্পদ পায়। এক হচ্ছে- তার পৈতৃক সম্পত্তি।
খোঁজ নিলে দুর্নীতিবাজ প্রত্যেক লোকের তথ্য পাওয়া যাবে- কোন ব্যক্তি পৈতৃক সূত্রে কী পরিমাণ সম্পদের মালিক। দ্বিতীয় হচ্ছে, তার নিজের আয়। সেটা চাকরি কিংবা ব্যবসা হতে পারে। এর বাইরে বৈধভাবে সম্পদের মালিক হওয়া ‘আলাদিনের চেরাগ’ গল্পে থাকলেও বাস্তবে নেই। যে লোক চাকরিজীবী তার চাকরিতে যোগদানের তারিখ থেকে অবসরে যাওয়া পর্যন্ত বেতন-ভাতাসহ সব রকমের বৈধ সুযোগ-সুবিধার হিসাব করে জীবনযাত্রার সব ধরনের ব্যয় বাদ দিলে সঠিক তথ্য মিলে যাবে।
এর সঙ্গে তার অন্য কোনো সূত্রের যেমন শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তি, সেগুলোরও হিসাব করা যায়। ব্যবসার ক্ষেত্রেও তাই। সৎভাবে চাকরি, ব্যবসা ও কৃষিকাজ ছাড়া টাকা-পয়সা কামাই করার বৈধ কোনো রাস্তা এ দেশে নেই। সৎভাবে চাকরি, ব্যবসা ও কৃষি কাজ করে মোটা দাগে রাতারাতি ধনী হওয়া খুবই কঠিন। রাতারাতি ধনী হতে দুর্নীতি করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
ঢাকা থেকে শুরু করে সারা দেশে অবৈধ উপায়ে ধন-সম্পদের মালিকদের তালিকা করতে চাইলে সরকার ছয় মাসের মধ্যেই তা করতে পারে। এজন্য নতুন কোনো জনবলেরও প্রয়োজন হবে না। সরকারের বিভিন্ন বিভাগকে দায়িত্ব দিলেই হয়। তার আগে প্রত্যেকের ব্যক্তিগত সহায়-সম্পদের একটি হলফনামা সরকারের কাছে জমা দিতে হবে। ওই হলফনামাটি তথ্য অধিকার আইনের আওতায় রাখলে সাধারণ মানুষ বিস্তারিত জানতে পারবে।
এতে সরকারের স্বচ্ছতা বাড়বে। পাশাপাশি গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে জনগণকে অবৈধ সম্পদের খবর দিতে বললে বস্তায় বস্তায় তথ্যনির্ভর খবর আসবে। সেগুলো সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে বর্তমানের অভিযানটি বিরতিহীনভাবে চলমান রাখতে হবে। দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি, সাধারণ মানুষ প্রতিদিন খবরের কাগজে আগে খুঁজে নতুন কোনো লুটেরা ধরা পড়ল কিনা। না পড়লে, মানুষ দেখে প্রধানমন্ত্রী কী বলছেন।
স্বাভাবিকভাবেই মনে হতে পারে কেন এ অবস্থা। কারণ, সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ। তারা একমাত্র প্রধানমন্ত্রী ছাড়া অন্য কারও প্রতি আস্থা রাখতে পারছে না। মানুষের মনের এ আস্থার বহিঃপ্রকাশের নামই জাতীয় ঐক্য। আর এ ঐক্যের নেতা হচ্ছেন শেখ হাসিনা। সে কারণেই দেশবাসী তাকেই ভরসা করে। পতিত কিংবা পরিত্যক্ত কয়েকজন একত্রিত হলেই জাতীয় ঐক্য হয় না।
ঐক্যের ভিত্তি হচ্ছে বিশ্বাস ও আস্থা। সেটা অর্জন করতে হয় কর্ম দিয়ে। চাপার জোরে কিংবা রণকৌশল পাল্টে নয়। এখানে কোনো দল-মত, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নেই। ১৬ নভেম্বর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সম্মেলনে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, দেশটা যখনই একটু সামনে যায়, তখনই একটা না একটা ঝামেলা বাধিয়ে বাধাগ্রস্ত করা হয়।
পেঁয়াজ নিয়ে পত্রপত্রিকা, টেলিভিশন, ফেসবুক, টুইটারে কত কথা বলাবলি হল। সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া একই রকমের। সবার একই কথা- সরকার যদি না দেখে তা হলে উপায় কী। সরকারে মানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মানুষ তার কথাবার্তায় কিঞ্চিৎ হলেও ভরসা পায়। অন্যদের কথায় গা জ্বলে। প্রতিদিন কত রকমের খবর আসে। মন্ত্রী বলেন একরকম, ব্যবসায়ীদের ভিন্নমত।
আবার যারা দীর্ঘদিন থেকে বাজারব্যবস্থা নিয়ে কাজ করেন, তারা বলছেন অন্য কথা। শুধু কথাই হয়। জিনিসপত্রের দাম কমছে না। এ দেশের ১৭ কোটি মানুষ পেঁয়াজ, মরিচ, আদা, রসুনের ব্যবসা করে না। ঘরে ঘরে নিত্যপণ্যের গুদামও নেই। সারা দেশে কিছুসংখ্যক আড়তদার আছে। তাদের খবর সরকার জানে। আড়তদাররা পেঁয়াজ, মরিচ, নুন পকেটে নিয়ে পালিয়ে বেড়ায় না। গুদামেই রাখে। গুদামগুলোও এ দেশেই। সেটি খুঁজে বের করা র্যাব-পুলিশের মাত্র কয়েক ঘণ্টার কাজ। তারপরও কিছু হচ্ছে না।
এসব নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। এখন বাজারে নতুন পেঁয়াজ উঠতে শুরু করেছে। আবার বিদেশ থেকেও দ্রুত আমদানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। ইতিমধ্যেই পেঁয়াজের দাম কমতে শুরু করেছে। কিন্তু এতদিন যারা মানুষের পকেট কেটে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিল তাদের কী হবে।
অতীতের রেওয়াজ অনুযায়ী কয়েকদিনের মধ্যেই হয়তো শোনা যাবে কিছুসংখ্যক লোকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তদন্ত চলছে। সেটা অনন্তকাল ধরে চলতেই থাকবে। আর এ তদন্ত প্রক্রিয়ার মাঝেই দুর্নীতিবাজরা নিজেদের নিরাপদ করার সুড়ঙ্গ তৈরি করবে। কিন্তু জাতির প্রত্যাশা ভিন্ন। তারা দুর্নীতিবাজদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চায়। যাতে ভবিষ্যতে সহজে কেউ দুর্নীতি করার সাহস না পায়। সে রকমের শাস্তি হল, অপরাধীদের পথের ভিখারি করে দেয়া।
যার আয়ের সঙ্গে সম্পদের সামঞ্জস্য নেই, তার বৈধ সম্পদটুকু বাদে বাকি সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করার ব্যবস্থা নেয়া। যারা বিদেশে পাচার করেছে তাদের টাকা ফেরত এনে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিতে হবে।
বর্তমানে দলের সহযোগী সংগঠনগুলোর সম্মেলন হচ্ছে। তাতে নতুন নেতৃত্ব আসছে। এটা খুবই ভালো। তবে নতুন যারা আসছেন তাদের দায়িত্ব নেয়ার সময়ে প্রত্যেক নেতার ব্যক্তিগত ও পরিবারের সদস্যদের কার কী সম্পদ আছে তার হিসাব রাখা দরকার।
নেতারা হলফনামার মাধ্যমে সম্পদের পূর্ণ বিবরণী দিয়ে তা আওয়ামী লীগ সভাপতির কাছে জমা দেবেন। এতে করে তাদের অনিয়ম-দুর্নীতি রোধ করা যাবে। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য সরকারি দল হিসেবে আওয়ামী লীগের কাজ হবে সন্ত্রাস-দুর্নীতিবাজদের নির্মূল করায় সরকারকে সব রকমের সহযোগিতা করা। এটাই জাতির প্রত্যাশা।
মোল্লা জালাল : সাংবাদিক, বিএফইউজে সভাপতি