Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

এ মৃত্যুর উপত্যকা আমার দেশ নয়

Icon

শামীমা চৌধুরী

প্রকাশ: ২৮ নভেম্বর ২০১৯, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

এ মৃত্যুর উপত্যকা আমার দেশ নয়

এ এক ভয়াবহ, নির্মম, পাশবিক দৃশ্য! কদমগাছের ডালে ঝুলছে শিশু তুহিনের নিথর দেহ। পেটে ঢোকানো দুটি লম্বা ছুরি। তার দুটি কান ও যৌনাঙ্গ কেটে ফেলা হয়েছে। এ শিশুর বাড়ি সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার রাজানগর ইউনিয়নের কেজাউরা গ্রামে। এ হত্যার সঙ্গে জড়িত তার পিতা ও চাচা। এ ঘটনার এক মাস পর ৬ অক্টোবর বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগের বুয়েট শাখার নেতাকর্মীরা।

চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডে ২৫ জন জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। দেশের মেধাবী ছাত্রদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বুয়েটের এ ঘটনা সারা দেশব্যাপী-বিশ্বব্যপী তোলপাড় শুরু হয়। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ২১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আর আবরার ফাহাদকে সরাসরি মারধর করে ছাত্রলীগের ১১ নেতাকর্মী। এখনও থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে বুয়েটে।

বরগুনার রিফাত শরিফকে পিটিয়ে মারা হয় পরিবারের সামনে। প্রকৃত খুনিকে আড়াল করতে তাকে গ্রেফতার না করে গ্রেফতার করা হয় রিফাতের স্ত্রী মিন্নিকে। তাকে নেয়া হয় রিমান্ডে। পরে জানা যায়, এমপির চাঁদাবাজপুত্র এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। তাকে রক্ষা করার জন্যই প্রশাসন এ গ্রেফতার দেখায়।

এ তো সেদিন ঢাকার ধানমণ্ডির ২৮নং রোডে প্রবীণ গৃহকর্ত্রী আফরোজা বেগম ও তার কাজের মেয়ে দিতি অপর কাজের মেয়ে সুরভীর হাতে খুন হল। উত্তরখানে চাচাতো ভাইয়ের ছুরিকাঘাতে নিহত হয়েছে রিয়াদ হোসেন ওরফে সাগর নামে এক কিশোর। আওয়ামী লীগ নেতা ইসমত কাদির গামার স্ত্রী পারভীন কাদের খুন হল গৃহপরিচারিকার হাতে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে মারা হয়।

৩ অক্টোবর অপহৃত হয় পাপ্পু নামে এক কিশোর। এ ঘটনায় বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজির পর না পেয়ে ৮ অক্টোবর যাত্রাবাড়ী থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন তার মা রুনা পারভীন রুনু। তবে এ জিডির সূত্র ধরেই রহস্য উন্মোচন করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। যাত্রাবাড়ীর পূর্ব ধোলাইপাড়ে গলাটিপে পাপ্পুকে হত্যার পর বস্তায় লাশ ঢুকিয়ে পিকআপে করে ওই বস্তা নিয়ে যাওয়া হয় লৌহজংয়ে; সেখানে পদ্মা রিসোর্ট থেকে ৫০০ গজ দক্ষিণ দিকে পদ্মার শাখা নদীর তীরে বস্তাটি নদীতে ডুবিয়ে দেয়া হয়।

১ অক্টোবর গাজীপুরে একটি বাড়িতে ঢুকে আবদুর রউফ নামে এক ব্যক্তিকে হত্যা করে স্বর্ণালঙ্কার লুট করা হয়। ২৯ সেপ্টেম্বর কিশোরগঞ্জ সদরে নানি জয়নব বিবিকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে কিশোর নাতি। ১৭ জুলাই রাতে কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ায় স্মৃতি আক্তার রিমা নামে এক কিশোরীকে প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে সংঘবদ্ধভাবে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ঘটে। হত্যার পর লাশ গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয় বলে অভিযোগ করেন স্বজনরা।

২১ এপ্রিল রাজধানীতে গৃহবধূ জান্নাতি আক্তারের শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন শ্বশুরবাড়ির লোকজন। ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর কেরানীগঞ্জের বেউতা এলাকায় মালয়েশিয়া প্রবাসী আল-আমিনের বাড়িতে সাভারের ভাকুর্তা এলাকার কবিরাজ মফিজুর রহমানকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। পরে ৮ থেকে ১০ টুকরা করে প্রতিবেশীর মাগুর মাছের খামারসহ বিভিন্ন স্থানে ফেলে রাখা হয় লাশ।

একই বছরের ২ নভেম্বর ঢাকার বাড্ডার হোসেন মার্কেট এলাকার ময়নার টেকের একটি বাসায় স্বামী জামিল শেখ ও মেয়ে নুসরাতকে খুন করেন আরজিনা বেগম ও তার কথিত প্রেমিক শাহীন মল্লিক। আগের রাত ১ নভেম্বর কাকরাইলে পারিবারিক কলহের কারণে খুন হন মা শামসুন্নাহার ও ছেলে সাজ্জাদুল করিম শাওন। এত এ বছরে ঘটে যাওয়া কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। এর সঙ্গে আরও আছে ধর্ষণ আর হত্যার ঘটনা। এখন ধর্ষণের সবচেয়ে বড় শিকার শিশুরা।

এ বছরের শিশু ধর্ষণের ও হত্যার প্রতিটি ঘটনা প্রমাণ করে শিশুরা সবচেয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে তার পরিবারে আর রাস্তাঘাটে চলতে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। পরিবারে তারা নিকটাত্মীয়দের দ্বারা ধর্ষণের শিকার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার। আর প্রতিবাদ করতে গেলে ফেনীর সোনাগাজীর নুসরাত জাহানের মতো ভয়াবহ নির্যাতন ও হত্যার শিকার হতে হয়।

খুনের ঘটনা এখন যেন আমাদের প্রত্যাহিত জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষ খুন হচ্ছে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে, পারিবারিক কারণে, চাঁদাবাজির কারণে, সামাজিক কারণে, অর্থ-সম্পদের কারণে, যৌতুকের কারণে, পরকীয়ার কারণে, মাদকের কারণে। সর্বোপরি বিচারহীনতার কারণে।

পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে সারা দেশে খুন হয়েছেন ১৭ হাজারের বেশি মানুষ। একই সময়ে রাজধানীতে খুন হয়েছেন ১ হাজারের বেশি। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর পেছনে অন্যতম কারণ পরকীয়া, জমিসংক্রান্ত বিরোধ ও মাদকের অর্থ জোগাড়। ইন্টারনেটের অপব্যবহার, অসহিষ্ণুতা, অতিমাত্রার ক্ষোভ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণেও মানুষের মাঝে দিন দিন মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে নিষ্ঠুরতা। তুচ্ছ কারণে অসহিষ্ণু হয়ে খুনের ঘটনা ঘটাচ্ছে। তবে বীভৎস বিকৃত খুনের ঘটনার বেশিরভাগই ঘটছে অপেশাদার খুনিদের মাধ্যমে।

ঘরে-বাইরে, মানুষের জীবন কোথাও নিরাপদ নয়। কেন এ পাশবিকতা? একদিকে শিক্ষা আর উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে দেশ। নারীসহ সব নাগরিকের উন্নয়ন ও তাদের আর্থিক নিরাপত্তার জন্য নেয়া হচ্ছে যুগান্তকারী পদক্ষেপ, অন্যদিকে তুচ্ছ কারণে খুনের মতো জিঘাংসার শিকার হচ্ছেন সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। শিশুসহ নারী ধর্ষণ ও হত্যা প্রমাণ করে পাশবিকতা কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে।

প্রতিটি ঘটনার যদি সুষ্ঠু বিচার হতো, বিচারহীনতার রাজনীতি যদি বন্ধ হতো তাহলে হয়তো সুড়ঙ্গের ফাঁক দিয়ে ঢুকত আলোর কণা। নুসরাতের হত্যাকারীদের ফাঁসির আদেশে দিয়েছেন নিু আদালত। এটি আশার ঝিলিক। তবে ভয় হয় উচ্চ আদালতে এ রায় বহাল থাকবে তো? তা না হলে আবারও সেই অন্ধকারেই পথ চলতে হবে। বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যার বিচার হবে তো? এ প্রশ্নগুলো বারবার ঘুরেফিরে আসে। হত্যার বিচার না হলে এ মৃত্যুর উপত্যকায় যে কোনো সময় খুনের শিকার হওয়ার ভয় নিয়েই আমাদের পথ চলতে হবে।

শামীমা চৌধুরী : গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিককর্মী

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম