দেশপ্রেমের মতোই বিশ্ববিদ্যালয়প্রেম থাকা চাই
বিমল সরকার
প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর ২০১৯, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রকৃত অর্থে বাউলি কেটে কেটে কোনোরকমে সময় অতিবাহিত করার নাম জীবন নয়, কর্ম তো নয়ই। অথচ বড় দাগে বলতে গেলে আমরা যে যেখানে আছি, অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় তা-ই করে চলেছি। অন্য যে কোনো ক্ষেত্রে যেমন-তেমন, শিক্ষাক্ষেত্রে বিষয়টি অতীব ভাবনার।
এত সংশয়-সন্দেহ, এত অনিয়ম-অব্যবস্থা, এত অনাস্থা-অবিশ্বাস-অনিশ্চয়তা, এতসব কিছুর ওপর ভর করে হয়তো পথ চলা যায়, যেতে পারে; কিন্তু সত্যিকার অর্থে সামনের দিকে এগোনো যায় কি? ভুলতে পারি, ভুলে থাকতে পারি, নাকি ভুলে থাকা সম্ভব যে, আমাদের স্বাধীনতার বয়স এখন পুরোপুরি আটচল্লিশ? ব্যক্তি, মহল বা গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষায় কিংবা উদ্ধারে শিক্ষাক্ষেত্রে নানা ছল-কৌশল খাটিয়ে আমরা একেকজন আর কীভাবে গোটা জাতির বারোটা বাজাব!
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুবই পবিত্র স্থান। একে হরহামেশা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তুলনা করা হয়। আদর্শ-উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বিবেচনায় রাজনৈতিক দল বা অন্য কোনো সংগঠন কোনো সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ধারে-কাছেও নেই। পরিতাপের বিষয়, আজকাল এমনকি বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শীর্ষপদে আসীন হয়েও একেকজন ব্যক্তির কর্মকাণ্ড ও কথাবার্তা লক্ষ করলে মনে হয় তারা একেকজন ট্রেড ইউনিয়ন নেতা!
তপোবন প্রেমিক কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একদা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বৃহত্তম কলকাতা মহানগরীর কোলাহল থেকে অন্তত দেড়শ মাইল দূরে বীরভূম জেলার বোলপুর শহরের অদূরে ছায়াসুনিবিড় শান্তিনিকেতন গ্রামে ১৯২১ সালের ২৩ ডিসেম্বর ‘বিশ্বভারতী’ নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এদিন বিভিন্ন দেশের পুরুষ ও মহিলা নিজ নিজ দেশের প্রতিনিধি হিসেবে এসে এর ভিত্তিমূলে মৃত্তিকা বর্ষণ করেন। রবীন্দ্রনাথ প্রদত্ত সেদিনের শিক্ষাবিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণে ‘বিশ্বভারতী’ শব্দটি প্রথম উচ্চারিত হয়। বক্তৃতায় তিনি বলেন, এখানে ‘বিশ্ব : ভবতি একনীড়ম।’ অর্থাৎ সমগ্র বিশ্ব এখানে বাঁধা পড়েছে। তার ভাষায়, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখ্য কাজ বিদ্যার উৎপাদন, তাহার গৌণ কাজ সেই বিদ্যাকে দান করা। ... বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের নকল করিয়া হইবে না। ... এরূপ আদর্শ বিশ্ববিদ্যালয়কে আমি ‘বিশ্বভারতী’ নাম দিবার প্রস্তাব করিয়াছি।’
ইউনিভার্সিটি অব সাউথ আফ্রিকা। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এ প্রতিষ্ঠানটি আফ্রিকার সবচেয়ে বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব বর্ণনা করে এর মূল ফটকে সংক্ষেপে যা লেখা রয়েছে তা এমন- ‘কোনো জাতিকে ধ্বংস করার জন্য পারমাণবিক হামলা কিংবা বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের দরকার নেই; বরং সেই জাতির শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় প্রতারণার সুযোগ দিলেই হবে। কারণ এভাবে পরীক্ষা দিয়ে তৈরি হওয়া চিকিৎসকদের হাতে রোগীর মৃত্যু হবে। প্রকৌশলীদের দ্বারা দালানকোঠা-ইমারত ধ্বংস হবে এবং অর্থনীতিবিদদের দ্বারা দেশের আর্থিক খাত দেউলিয়া হবে। এছাড়া বিচারকদের হাতে বিচারব্যবস্থার কবর রচনা হবে। অতএব শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়ার মানে হল একটি জাতির অবলুপ্তি।’
১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক সমাবর্তন উৎসবের সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে শেরেবাংলা একে ফজলুল হক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য এবং উপাচার্য (৯ নভেম্বর ১৯৫৬-২৭ অক্টোবর ১৯৫৮) ছিলেন বিচারপতি মোহাম্মদ ইব্রাহিম। সমাবর্তনের দিন ১৯ জানুয়ারি সকাল ১০টায় কার্জন হল প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠানমালায় সভাপতিত্ব করেন গভর্নর ও আচার্য একে ফজলুল হক। উপাচার্য তার ভাষণে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ই অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে প্রকৃতির গূঢ় রহস্য উদ্ঘাটন করে অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে। পুলিশি শাসনব্যবস্থা সমাজের কোনো কল্যাণ করতে পারে না। একমাত্র শিক্ষার মাধ্যমেই একটি জাতিকে সুঠাম করে গড়ে তোলা যায়। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। শ্রেষ্ঠ ও সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় জাতিকে সঠিক নির্দেশনা দিতে পারে। শিক্ষা আধুনিক সভ্যতার ধমনি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশেই বর্তমানে উন্নত খাবার ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের মতো শিক্ষাকেও অপরিহার্য বিষয়রূপে গণ্য করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় দেশের নৈতিক ও বুদ্ধির চাহিদা পূরণ করে থাকে এবং বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া জাতির অস্তিত্ব নিরর্থক।’
১৯৫৭ সালের ২৯ অক্টোবর লন্ডন শহরে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে আধুনিক বিশ্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে স্যার রিচার্ড লিভিংস্টোন বলেন, ‘যদি কেউ আধুনিক সভ্যতাকে ধ্বংস করতে চায় তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ধ্বংস করেই তা কার্যকর করা যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই কেন্দ্রস্থলে দাঁড়িয়ে জ্ঞান সৃষ্টি করে এবং মানুষের মনকে শিক্ষিত করে তোলে। এগুলোর দেয়া শিক্ষাই সব শিক্ষিত ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গিকে গড়ে তোলে এবং এভাবে রাজনীতি, শাসন, চাকরি, শিল্প ও বাণিজ্যকে প্রভাবিত করে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আবিষ্কার, জ্ঞান ও চিন্তাধারা জীবনের প্রায় সব চিন্তার মধ্যে প্রবেশ করে। চিকিৎসক ও খনিজীবীদের যান্ত্রিক কলা-কৌশল, ধর্মশিক্ষা, এমনকি সংবাদ ও সরকারের কর্মপন্থাও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক নির্দেশিত হয়। ধীরলয়ে হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাব বেড়ে চলেছে এবং দিন দিনই তা বাড়বে, যে পর্যন্ত না আধুনিক সভ্যতার পতন ঘটে। আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রভাব মধ্যযুগের চার্চের প্রভাবের মতো ...।’
এখানে রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করি- ‘দেশকে ভালো না বাসলে তাকে ভালো করে জানার ধৈর্য থাকে না, তাকে না জানলে তার ভালো করতে চাইলেও তার ভালো করা যায় না।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও তা-ই। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদটি ধার ও ভার সবদিক দিয়েই কত তাৎপর্যমণ্ডিত। বিশ্ববিদ্যালয় জাতির কত সাধনার ধন, সবার কাছে বোধকরি স্বাধীনতার পর এ বস্তুটিই মহামূল্যবান। ১৮৫৭ সালে উপমহাদেশে প্রথম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়।
অবশ্যই স্মরণযোগ্য যে, ব্রিটিশ ভারতে সমগ্র বাংলা মুলুকে (বর্তমান আমাদের বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ-বিহার-ওড়িশা-আসাম) দ্বিতীয় বিশ্ববিদ্যালয়টি (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) স্থাপনের জন্য কোটি কোটি মানুষকে অন্তত ৭৪টি বছর অধীর অপেক্ষায় থাকতে হয়েছিল। ১৯২১ সালের পর ৩২ বছরের মাথায় ১৯৫৩ সালে আমাদের পরিচয় ঘটে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে। আর ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। ঠিক এভাবেই তো শুরু হয় প্রকৃত আলোর সন্ধানে আমাদের পথচলা। কত গর্ব, অহঙ্কার ও আত্মবিশ্বাস একেকটি বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে। একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে একেকটি বিশ্ববিদ্যালয়কে এমনই মূল্যবান ঠিকানা-অভিভাবক-পথপ্রদর্শক বলে ভাবতে হবে, ভাবা চাই। কে ভাববে? সরকার ভাববে, সবাইকেই ভাবতে হবে। তবে বেশি ভাবতে হবে একেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও এসব গুরুত্বপূর্ণ পদে সমাসীন ব্যক্তিকে।
বিমল সরকার : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক