
প্রিন্ট: ০১ মে ২০২৫, ১২:২৯ এএম
ঘৃণা শুধু ঘৃণারই জন্ম দেয়

অমিত রায় চৌধুরী
প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২০১৯, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

এনআরসি। ফাইল ছবি
আরও পড়ুন
১৯৪৭ সালে যে প্রক্রিয়ায় দেশবিভাগ হয়, সেখানে সাধারণ জনগোষ্ঠীর কোনো হাত ছিল না; কিন্তু এর ফলে ভারত-পাকিস্তান উভয় অংশেই জনসাধারণের একটি বড় অংশ ধর্মের পরিচয়ে সংখ্যালঘু হয়ে পড়ে।
সাম্প্রতিক সময়ে ভারতে অসহিষ্ণুতা ও বিভাজনের কিছু লক্ষণ দেখা গেলেও এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই, স্বাধীনতার পর দীর্ঘ ৬০ বছর সে দেশে বহুধর্ম, বহুমত, বহুভাষা, বহুপন্থার মানুষ একসঙ্গে বাস করে এসেছে।
মূল স্রোতে একাত্ম থেকে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী জাতীয় অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার সুযোগ পেয়েছে। দেখা গেছে, সংখ্যালঘু জনসংখ্যা দেশবিভাগের সময়ের তুলনায় সে দেশে কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বহুত্ব ও অন্তর্ভুক্তির দর্শনের সুফল ভারত ভোগ করেছে।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকে দেশটা অনেকটাই এগিয়ে গেছে। অপরদিকে আগ্রাসী রাষ্ট্রীয় নীতির কারণে ও সামাজিক সুরক্ষার অভাবে পাকিস্তানে সংখ্যালঘু জনসংখ্যা ক্রমশ কমে এসেছে। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশের মাটি ও মানুষ পৃথক সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও মননসত্তার কারণে পশ্চিম অংশের তুলনায় অনেক সহনীয় হলেও সংখ্যালঘু বাঙালি হিন্দুর দুর্ভাগ্যের রেখাচিত্র আগাগোড়াই বিবর্ণ থেকেছে।
এপার বা ওপার বাংলা- কোথাও এ জনগোষ্ঠীর স্বপ্নপূরণের আকাক্সক্ষা নির্বিঘ্ন থাকেনি। এপারে অর্পিত সম্পত্তি বা ওপারে এনআরসির মতো আতঙ্ক সবসময়ই এদের তাড়া করে ফিরেছে।
দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশবিভাগের সঙ্গে সঙ্গে লাখ লাখ বাঙালি হিন্দু পশ্চিমবঙ্গের উদ্দেশে পাড়ি জমায়। পাকিস্তান রাষ্ট্র হিন্দু জাতিগোষ্ঠীকে অস্থিতিশীল করে রাখতে নানা কৌশল অবলম্বন করলেও ১৯৬৪-এর দাঙ্গা ও ৬৫-এর ভারত-পাকিস্তান সর্বাত্মক যুদ্ধের পরই ব্যাপকহারে দেশান্তর ঘটতে থাকে।
যুদ্ধ চলাকালীন সাময়িকভাবে আরোপিত শত্রু সম্পত্তি আইন দীর্ঘমেয়াদে বলবৎ রেখে তদানীন্তন সরকার মূলত হিন্দুদের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ ভেঙে দিয়ে এথনিক ক্লিনজিংয়ের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে ফেলে। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময় ঐতিহাসিক ১১ দফায় এ কালাকানুন বাতিলের দাবি অন্তর্ভুক্ত ছিল।
কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অর্পিত সম্পত্তি আইন নামে কালাকানুনটি বহাল থেকে যায়। শেখ হাসিনা সরকার ৯৬-২০০১ মেয়াদের শেষ প্রান্তে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ বিল পাস করান। বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে প্রসঙ্গটি ধামাচাপা পড়ে যায়। এরপর ২০১১ সালে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন নতুন করে পাস করা হলেও ২০১২ ও ১৩ সালে আবারও আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা হয়।
বিভিন্ন সূত্রমতে, দেশে অর্পিত সম্পত্তির পরিমাণ ৯ লাখ ৬২ হাজার ৬১২ একর। আর হিন্দু জনগোষ্ঠী এ সম্পত্তি ফিরে পাওয়ার আশায় এযাবৎ প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে ফেলেছে বলে জানা যায়; কিন্তু ইতিহাসের দায়মোচনের জন্য সরকারের এ মহৎ উদ্যোগের বাস্তবায়ন নানা কারণে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। ভূমি প্রশাসনের একাংশের অসহযোগিতা, সদিচ্ছার অভাব ও দুর্নীতির কারণে নানারকম জটিলতা, অনিশ্চয়তা ও দীর্ঘসূত্রতা দেখা দিচ্ছে।
একদিকে ট্রাইব্যুনাল বাতিলের কথা শোনা যাচ্ছে, অন্যদিকে এ দীর্ঘসূত্রতার সুযোগে রাজস্ব আদায়ের অজুহাতে বিচারাধীন জমাজমি কায়েমি গোষ্ঠীকে আবারও লিজ দিয়ে মূল মালিকের কাছে সম্পত্তি ফেরতের সম্ভাবনাকে দুরস্ত করে ফেলা হচ্ছে। আর এসব অবৈধ দখলদার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের যুগ যুগ ধরে ভোগ করা পিতৃপুরুষের সম্পদ দিনদুপুরে দখল করার নজিরবিহীন ঔদ্ধত্য দেখাচ্ছে; যা কল্পনাতীত।
রাজনৈতিকভাবে সংখ্যালঘুদের জন্য অনুকূল একটি সময়ে এ জনগোষ্ঠীর এমন নাজুক অবস্থা ভবিষ্যতে তাদের মূল বিস্তারের স্বপ্নকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে এবং কার্যত বিপন্ন এ শ্রেণি এভাবেই দেশত্যাগে বাধ্য হয়ে পড়ে।
১৯৬৫ সালের যুদ্ধ শুধু শত্রু সম্পত্তি আইনের অজুহাত হিসেবে ব্যবহৃত হয়নি, পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনের আওতায় ব্যাপকহারে হিন্দু পদস্থ চাকরিজীবী ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের গ্রেফতার করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে ভীতি ও আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়। অনেক হিন্দু নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের আটক বা হয়রানি করা হয়। হিন্দু চাকরিজীবীরা শাস্তিমূলক বদলিসহ নানারকম নির্যাতনের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। সামাজিকভাবেও নানারকম নিপীড়নের শিকার হয়ে দলে দলে দুর্বলতর এ জনস্রোত অজানার উদ্দেশে দেশ ছাড়তে শুরু করে প্রবল অনিশ্চয়তাকে মাথায় নিয়ে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের প্রায় সব বাঙালি পাকিস্তানি হত্যাযজ্ঞের শিকার হলেও- বীভৎস এ হিংসার মূল লক্ষ্য ছিল হিন্দু জনগোষ্ঠী। নিষ্ঠুর আক্রোশে নিরীহ, নিরস্ত্র এ মানবসন্তানরা সভ্যতার নৃশংসতম প্রতিহিংসার মুখে পড়ে যায়; যা দেশ স্বাধীন হলেও ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা এ ট্রমা থেকে মুক্ত হতে পারেনি।
ফলে নিকটাত্মীয়ের পাশবিক নির্যাতন ও মৃত্যুযন্ত্রণা নিজ চোখে দেখার সেই দুঃসহ, ভয়াল স্মৃতিকে ধারণ করে সদ্য স্বাধীন হওয়া প্রিয় মাতৃভূমিতে অনেকে আর ফিরে আসেনি।
এরপর ১৯৯০ সালে বাবরি মসজিদ আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা, ২০০১ সালের নির্বাচনোত্তর সহিংসতা, ২০১৪-১৫ সালে যুদ্ধাপরাধীর বিচার চলাকালে অথবা যে কোনো নির্বাচনের আগে বা পরে কিংবা কোনো অজুহাত না পেলে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে স্রেফ গুজব ছড়িয়ে সংখ্যালঘুর উপাসনালয় ও জানমালের ওপর হামলা চালানোর ঘটনা ঘটেছে। খুবই বিস্ময়কর, এসব অপরাধের কোনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি।
ব্যতিক্রম শুধু সাম্প্রতিক ভোলা সহিংসতা; যেখানে সরকারকে যথেষ্ট প্রো-অ্যাকটিভ মনে হয়েছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, ‘দাঙ্গা’ শব্দটি এখানে প্রযোজ্য নয়, কারণ হিন্দু জনগোষ্ঠী আত্মরক্ষায় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চেয়েছে- এমন ঘটনা এদেশে বিরল; বরং ধ্বংসলীলার নির্মমতা ও অনিবার্যতার কাছে তাদের করুণ আত্মসমর্পণ যে কোনো বিবেকবান মানুষকে কেবল হতবাকই করেছে। আর দলে দলে সংখ্যালঘুর নীরব দেশত্যাগের সাক্ষী হয়েছে দেশ।
একথা সত্য, হিন্দু জনগোষ্ঠী বর্তমান সরকারের শাসনামলে মানসিকভাবে নিরাপদ বোধ করে। এটিও মিথ্যা নয় যে, বেশকিছু হিন্দু চাকরিজীবী বর্তমানে উচ্চপদে আসীন আছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, মেধা মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও হিন্দু চাকরিপ্রার্থীরা বর্তমান সরকার ও এরশাদ আমলের কিছু সময় ছাড়া আগাগোড়া বৈষম্য ও পক্ষপাতের শিকার হয়েছে। ভালো চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে ভালো ফলাফলের আনুপাতিক প্রতিফলন ঘটেনি।
আর একথা ভুললেও চলবে না যে, দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সেবাখাতে এ জনগোষ্ঠীর অবদান গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য ছিল। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা কাঠামো গড়ে দেয়ার ক্ষেত্রে সংখ্যালঘু এ জনগোষ্ঠীর অগ্রণী ভূমিকা কেউ অস্বীকার করতে পারে না। শিল্প-সংস্কৃতিতেও এ সম্প্রদায়ের সংযোগ যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।
দেশভাগের পর দেশান্তরীদের বড় অংশই ছিল সম্ভ্রান্ত ও বিত্তশালী সম্প্রদায়। পরবর্তীকালে শ্রেণি নির্বিশেষে এ দেশত্যাগী কাফেলার আকার বৃদ্ধি পেতে থাকে। পৃথিবীর ইতিহাস বলে, যে কোনো নিপীড়িত গোষ্ঠীর সংগঠিত প্রতিবাদ দৃশ্যমান না হলে শক্তিশালী পক্ষ নির্লিপ্ত থেকে যায়, প্রতিরোধ করতে না পারলে প্রতিকার পাওয়া যায় না।
সংখ্যালঘুদের দুর্ভাগ্যের পেছনে দেশ থেকে পালিয়ে বাঁচার স্বার্থপর প্রবৃত্তিও কাজ করেছে বলে মনে হয়। আর নিজেরা সংগঠিত না থাকায় সমষ্টিগতভাবে তারা ক্ষতির মুখে পড়েছে। অথচ ’৪৭-এর পর থেকে মাটি কামড়ে থেকে যাওয়া এ জনগোষ্ঠী মননে, চিন্তায়, ভাবনায়, জীবনাচরণে সবসময় প্রগতিশীল।
রাজনীতি চর্চায় আদর্শ ও ত্যাগের অনুশীলনে উত্তীর্ণ। জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের সব পর্বে সক্রিয় থেকে মুক্তিযুদ্ধের সময় চূড়ান্ত আত্মত্যাগে তারা কখনও পিছপা হয়নি। কিন্তু যে বাংলাদেশের জন্য তারা যুদ্ধ করেছে, সর্বস্ব খুইয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের পর বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের উত্তরপর্বে সে দেশকে তারা আর খুঁজে পায়নি। বরং রাষ্ট্রের আদর্শিক উল্টোযাত্রা এ সম্প্রদায়কে শুধু বৈষয়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেনি, মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত করেছে।
নির্দ্বিধায় যে কথাটি বলা যায় তা হল- দেশবিভাগের পর সবচেয়ে অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে বাঙালি হিন্দু জনগোষ্ঠী; যারা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এ দুর্ভোগ বয়ে নিয়ে চলেছে। ভারত সরকার বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির আওতায় এ দেশের উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব দিতে চায়নি।
ফলে ভারত অভিমুখে আছড়ে পড়া অসহায় মানুষের দুর্দশা কল্পনার সীমা ছাড়িয়েছে। অথচ অগণিত অসহায় মানুষের এ চাপা আর্তনাদ আলোচনার আড়ালেই থেকে গেছে। একদিকে বাস্তুভিটে ত্যাগের প্রাক্কালে অনেক গোপনীয়তা রক্ষা করা এবং চুপিসারে দেশত্যাগের ফলে তাদের সম্পদের ন্যায্যমূল্য তারা পায়নি, অন্যদিকে ওপারে তাদের নিকটাÍীয় বা পরিজন; যার কাছে অর্থ গচ্ছিত রেখেছে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার একটা বড় অংশই তাকে খুইয়ে বসতে হয়েছে।
এরপর মাথাগোঁজার মতো একটা বাড়ি তুলতে গেলে- পাড়ার দাদাদের তোলাবাজির মুখে তাদের পড়তে হয়েছে। বাড়ির যে সন্তান এ দেশ থেকে øাতক পাস করে ভারতে গেছে- তাকে ৮ম বা ৯ম শ্রেণিতে ভর্তি হতে হয়েছে, ঘাটে ঘাটে অর্থদণ্ড দিয়ে ভোটার তালিকায় নাম লেখাতে পারলেও চাকরি জোটানো অনেক কষ্টকর হয়েছে।
এরপরও বাংলাদেশ থেকে আসা- এ অজুহাতে চাকরি হারানোর আশঙ্কায় তাকে সর্বদা তটস্থ থাকতে হয়েছে। ১ম প্রজন্মকে জীবনের সবটাই উৎসর্গ করতে হয়েছে পরবর্তী প্রজন্মের নিরাপদ ভবিষ্যতের জন্য। কিন্তু সে কাজটিও সহজসাধ্য হয়নি। ভারতের বর্তমান সরকার বলেছে ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে যারা দেশত্যাগ করেছে- তাদের ৬ বছর পর্যবেক্ষণে রেখে স্থায়ী নাগরিকত্বের আবেদন বিবেচনা করবে।
অথচ কার্যত দেখা গেছে, আসামে এনআরসির আওতায় নাগরিকত্ব বাতিল হওয়া ১৯ লাখ অধিবাসীর মধ্যে ১৩ লাখই বাঙালি হিন্দু। এরপর পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি চালু হলে এ জনগোষ্ঠীর অবস্থা কী হতে পারে- তা সহজেই অনুমান করা যায়।
বর্তমান সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকাবস্থায় সংখ্যালঘু জনগণের মধ্যে এক ধরনের নিরাপত্তাবোধ থাকলেও কোনো অনভিপ্রেত তুচ্ছ ঘটনার সূত্র ধরে বা সরকার পরিবর্তন হলে আবার তাদের ওপর বিপর্যয়ের কোনো খড়্গ নেমে আসতে পারে- এমন আশঙ্কা একটা বিপুল জনগোষ্ঠীকে হয়তো এখন থেকেই দেশত্যাগে প্রস্তুত করে তুলছে; যা এদেশের ভবিষ্যৎ, সামাজিক স্থিতিশীলতা, ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণ বা আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের জন্য ভালো নয়।
গোটা বিশ্বেই ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও মৌলবাদের বিস্তার মানবসভ্যতাকে সংকটের মধ্যে ফেলেছে। গণতান্ত্রিক বহুত্ববাদী ভারতেও আজ ঘৃণা ও বিভেদের রাজনীতি জায়গা পেয়ে যাচ্ছে; যা দেশবিভাগের এত পর কেন এমনভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল তা-ও সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে।
পৃথিবীর কোথাও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভাগ্যলিপি সুখকর হয়নি। সংখ্যালঘু শব্দের মধ্যেই হয়তো একটা অপূর্ণতা, অব্যক্ত বেদনার ধারণা নিহিত। আর বাংলাদেশে বসবাসরত হিন্দু জনগোষ্ঠীর ভাগ্যের রেখাচিত্রটি খুবই ফ্যাকাসে। ভারত কিংবা বাংলাদেশে- কোথাও এরা নিশ্চিন্তে জীবনযাপনের, মূল বিস্তারের স্বপ্ন দেখতে পারে না।
পাকিস্তানের কথা বাদ রেখেই বলা যায়- ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে, বিশেষ করে হিন্দি বলয়ে গো-রক্ষার মতো ইস্যুর আড়ালে সাম্প্রদায়িক হিংসার যে নজির দেখা গেছে তা শুধু উদ্বেগজনক নয়, রীতিমতো ভীতিকর। কারণ চরম দারিদ্র্যের মাঝেও বহু সংস্কৃতিকে ধারণ ও পরিচর্যার যে আদর্শ নজির ভারত স্থাপন করেছিল, তা কেবল সেদেশটিকেই নয়, গোটা বিশ্বের গণতান্ত্রিক, সুস্থ সমাজের জন্য রোল মডেল।
এমন শুদ্ধ পরিসর যখন আক্রান্ত হয়, সভ্যতার জন্য তা বিপদসংকেত বয়ে আনে। ভারতবর্ষ বহুত্বের মহত্ত্ব উপভোগ করেছে এবং লাভবান হয়েছে। চোখের সামনে দেখেছে পাকিস্তানের দৃষ্টান্ত, দেখেছে পাশবিক হিংসা কীভাবে সভ্যতাকে পিছিয়ে দেয়, জাতীয় অগ্রগতিকে স্তব্ধ করে, সামাজিক শান্তির আকাক্সক্ষা চূর্ণবিচূর্ণ হয়। ভারতবর্ষের সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা বা প্রবণতা ভিন্ন বাঁকের ইঙ্গিত দিলেও ভারতীয় সমাজের পরিণতমনস্কতা ন্যায়ের শক্তিকে দুর্বল হতে দেবে না- একথা বলা যায়।
অন্যদিকে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের দুরবস্থা যথেষ্ট এবং তার বিভিন্ন পর্যায় এখনও অজানা, অজ্ঞাত। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও যে কথা সত্যি তা হল, সমাজের মনোভূমিতে এখনও একটা সহনশীল, আধুনিক ও মানবিক কাঠামো আছে- সেটাই আমাদের ভরসার আসল জায়গা।
তাৎক্ষণিক লোভ যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বাসযোগ্য সমাজ গড়ার স্বপ্ন ধূলিসাৎ করে না দেয়- সে বিষয়ে সুস্থ নাগরিক সমাজকে সজাগ ও সক্রিয় থাকা জরুরি। ঘৃণা থেকে ঘৃণাই জন্ম নেয়, হিংসা সৃষ্টি করে প্রতিহিংসা- মানবসভ্যতার এ জটিল সন্ধিক্ষণে সব শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে একটি শান্তিপূর্ণ, অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন, সমৃদ্ধ সমাজ গঠনের জন্য অনেক দূরদর্শিতা ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে।
অমিত রায় চৌধুরী : সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ
principalffmmc@gmail.com