শ্রীলংকায় রাজাপাকসে প্রশাসনের প্রত্যাবর্তন
অহিলান কাদিরগামার
প্রকাশ: ২১ নভেম্বর ২০১৯, ০১:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
শ্রীলংকার ইতিহাসে ২০১৯ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ছিল একটি সন্ধিক্ষণ। ২০১৫ সালের প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট- উভয় নির্বাচনে সুস্পষ্টভাবে রাজাপাকসে সরকারকে পরাজিত করা হয়েছিল।
তখন থেকে ওই সরকারের ধ্বংসাবশেষ থেকে পুনরায় জেগে ওঠার জন্য মনোযোগী হয়ে ওঠেন তারা। জাতীয় পর্যায়ে প্রত্যাখ্যাত ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একঘরে হয়ে পড়া তাদের কুশলী রাজনীতি, আদর্শিক একত্রীকরণ এবং রাজনৈতিক উদ্যম সিংহলি জনগণ অধ্যুষিত আসনগুলোতে শক্তিশালী রাজনৈতিক ঘাঁটি গড়ে তোলার কাজটি নিশ্চিত করেছে।
যেখানে নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন সংখ্যালঘুরা সিংহভাগ ভোট দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী গোতাবায়া রাজাপাকসের বিপক্ষে, সেখানে সিংহলি অধ্যুষিত আসনগুলোতে রাজাপাকসে ভাইদের মাধ্যমে তৈরি রাজনৈতিক ঘাঁটিগুলো তাদের ক্ষমতায় ফিরিয়ে এনেছে।
রাজাপাকসে শিবির নিজেদের নতুন একটি দল- দ্য শ্রীলংকা পডুজানা পেরামুনা গড়ে তোলার ঝুঁকি নিয়েছে, যা বর্তমানে দ্য শ্রীলংকা ফ্রিডম পার্টির সঙ্গে মিশে গেছে। তারা সিংহলি আসনগুলোতে ঘাঁটি গড়ে তোলে গ্রামীণ জনগণ ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষকে বিজড়িত করার মাধ্যমে।
দীর্ঘদিনের অবহেলিত, খরা ও ক্রমাবনতিশীল অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অসন্তোষ কাজে লাগিয়ে মানুষের পক্ষে কথা বলেছে। নবনিযুক্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের বন্ড কেলেংকারি প্রকাশ হয়ে পড়ার পর সংশোধনের অসাধ্য ‘সুশাসনের’ প্রতিশ্রুতি দিয়ে তারা দুর্নীতির ইস্যুকে কাজে লাগিয়েছে, যা তাদের ক্ষমতাচ্যুত করেছিল।
২০১৮ সালের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নিজেদের শক্তির পরীক্ষা দিয়েছে এবং আস্থা অর্জন করেছে তারা, যেখানে তাদের নতুন গঠিত পার্টি দক্ষিণাঞ্চলীয় আসনগুলোতে ভূমিধস বিজয় লাভ করেছে।
অনাস্থার বহু প্রস্তাবের মাধ্যমে পার্লামেন্টকে তারা অগ্নিপরীক্ষায় রেখেছিল, এমনকি সংসদীয় অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করেছিল প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনার মাধ্যমে মাহিন্দা রাজাপাকসেকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের মধ্য দিয়ে। ইস্টার সানডের হামলাকে তারা নিজেদের পক্ষে বড় ধরনের পুঁজি হিসেবে নিয়েছে এবং দাবি করেছে যে, তারাই একমাত্র অনুঘটক হিসেবে জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে; যদিও প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী নিরাপত্তায় ঢিল না দিলে ওই বিপর্যয় এড়ানো যেত।
গত চার বছরে কেবল সরকারকে আক্রমণ করার কোনো সুযোগই যে তারা হাতছাড়া করেনি তাই নয়, একইসঙ্গে অবিরাম নিজেদের ঘাঁটি গড়ে তোলার কাজ করেছে। এক্ষেত্রে হতাশ গ্রামীণ সিংহলি, নিজেদের পক্ষের আমলাদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা, যেসব ব্যবসায়ী শ্রেণি তাদের অর্থনৈতিক নীতির মাথ্যমে সুবিধা পেতে চেয়েছে তাদের বা উগ্র জাতীয়তাবাদী সামাজিক আন্দোলন, যেগুলো তাদের সমর্থনে ফুলে-ফেঁপে উঠেছে ও বিদেশভীতির রাজনীতি- যেটাই প্রয়োজন হয়েছে সেটাকেই তারা কাজে লাগিয়েছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ের মধ্য দিয়ে রাজাপাকসে গ্রুপ এখন দৃষ্টি দেবে ক্ষমতা সংহত করার দিকে।
রাজাপাকসে ভাইদের প্রতিটি সফলতা মূলত সিরিসেনা-বিক্রমাসিংহে সরকারের একেকটি ব্যর্থতা। জোট সরকার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে ছিল বিধ্বস্ত এবং এর উদাসীন নেতৃত্ব ব্যবসায় উদারীকরণ ও বিদেশি বিনিয়োগের বড় বড় প্রকল্প নিতে গিয়ে মানুষের দৈনন্দিন উদ্বেগকে অবহেলা করেছে। বৈশ্বিক পর্যায়ে ইসলামভীতির উত্থানের ক্ষেত্রে সরকার উগ্র জাতীয়তাবাদী শক্তিগুলোর মোকাবেলায় তেমন কিছু করেনি; যা সিংহলি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনগুলোতে মুসলমানদের নতুন শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করতে তাদের আদর্শিকভাবে উজ্জীবিত করেছে। তীব্র বেকারত্বের মধ্যে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, মানুষের গৃহঋণ বেড়ে যাওয়া এবং তাদের এখনও গ্রামীণ জীবিকানির্ভর হওয়া, ইস্টার সানডের সন্ত্রাসী হামলার পর ভয়ের পরিবেশ কাটিয়ে না ওঠা- এসব কারণে নিরাপত্তাহীনতার থাবা থেকে মুক্তির জন্য মানুষ ‘শক্তিশালী নেতা’র দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এসবই হচ্ছে মূলভিত্তি, যার ওপর ভর করে শ্রীলঙ্কার ২০১৫ সালের মহান উদার গণতন্ত্রের পরীক্ষা কর্তৃত্বপরায়ণ লোকরঞ্জনবাদের হাতে চলে গেছে।
রনিল বিক্রমাসিংহের শাসনাধীনে যদি নব্য উদারবাদীরা অর্থনীতির কৌশল হারিয়ে ফেলে থাকে, তবে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রকৃতপক্ষে কোনো উদার অগ্রগতিই হয়নি। দেশজুড়ে সামরিকীকরণ ও নজরদারি, বিশেষত দেশের উত্তর ও পূর্বাংশে প্রতিবাদ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার গণতান্ত্রিক অধিকার দেয়ার ক্ষেত্রে পরিস্থিতি যথেষ্ট বিপরীত অবস্থানে ছিল। সামরিক বাহিনীর দখলে নেয়া দেশের উত্তরাংশের ভূমি সেগুলোর ব্যক্তিগত মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। বিচার বিভাগ স্বাধীনতা ফিরে পেয়েছে। গণমাধ্যম ও সামাজিক আন্দোলনগুলো সরকারের সমালোচনা করার আস্থা পেয়েছে। প্রেসিডেন্টের অতিরিক্ত নির্বাহী ক্ষমতা কমানো হয়েছে এবং মানবাধিকারের স্বাধীন কমিশন ও তথ্য অধিকার কমিশন শক্তিশালী হয়েছে।
এ প্রেক্ষাপটে যুদ্ধের দিনগুলোর অতিরিক্ত নিরাপত্তা কড়াকড়ি থেকে স্বাভাবিক হওয়ার মনোভাব ইস্টার সানডের হামলার কারণে উধাও হয়ে গেছে এবং নিরাপত্তা যন্ত্রগুলোর নিরাপত্তার সুযোগ এখন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতাও এখন ঝুঁকির মুখে পড়েছে- হয়তো আইন বিভাগের মাধ্যমে পার্লামেন্টে ক্ষমতা দৃঢ়করণের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অথবা স্থূল রাজনীতিকরণের মাধ্যমে। এগুলো গত পাঁচ বছরজুড়ে অর্জিত গণতন্ত্রের পরিস্থিতির প্রতি হুমকি।
এগুলো হচ্ছে ওইসব বিষয়, যা রাজাপাকসে প্রশাসনের প্রত্যাবর্তনের বিরোধিতাকারী পরাজিত অনুঘটকদের মধ্যে এসেছে। যেটি দরকার ছিল তা হল একটি শক্তিশালী জোট, যা কিনা মৌলিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো দূর করবে; কিন্তু সেটি তৃতীয় শক্তি গড়তে চাওয়া জনতা বিমুক্তি পেরামুনা (জেভিপি) এবং দলে নিজের নেতৃত্ব নিশ্চিত করার জন্য নিজ দলীয় প্রার্থিতাকে খাটো করে দেখা ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি (ইউএনপি) নেতা বিক্রমাসিংহের মাধ্যমে হওয়ার ছিল না।
এ পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচনী পথপরিক্রমায় সুনির্দিষ্ট বিভক্তি প্রকাশ পেয়েছে। তামিল ও মুসলিম অধ্যুষিত উত্তর ও পূর্বাঞ্চল, কেন্দ্রীয় উঁচু ভূমি এলাকার ইউএনপি ও শক্ত তামিল ঘাঁটি এবং কলম্বোর আশপাশের সংখ্যালঘু অধ্যুষিত ও ইউএনপির শক্তঘাঁটি এলাকার মানুষ সাজিথ প্রেমাদাসাকে ভোট দিয়েছেন। অন্যদিকে বাকি সব এলাকার সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটার ভোট দিয়েছেন গোতাবায়া রাজাপাকসেকে।
নির্বাচনী ফলাফল তাৎক্ষণিকভাবে নৃতাত্ত্বিক-জাতীয়তাবাদী ধারায় মেরুকরণকৃত একটি দেশের ইঙ্গিত দিতে পারে; কিন্তু প্রতিটি রাজ্যের রাজনীতির দিকে গভীর দৃষ্টি দিলে ভিন্ন গতি প্রকাশ পেতে পারে। কোনো প্রার্থীই তাদের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে প্রতিশ্রুতি না দেয়া এবং তামিল জাতীয়তাবাদীদের কাছ থেকে নির্বাচন বয়কটের স্থূল আহ্বান সত্ত্বেও উত্তরাঞ্চলীয় আসনগুলোতে ভোটার উপস্থিতি অনেক বেশি ছিল আগের বছরগুলোর তুলনায়। সংখ্যাগরিষ্ঠভাবে প্রেমাদাসার জন্য ভোট দেয়া উত্তরাঞ্চলীয় আসনগুলো জাতীয় রাজনীতির একটি ছকে প্রবেশ করেছে, যারা চাচ্ছে বাদ দেয়ার রাজনীতির কয়েক দশকের এমন দীর্ঘ একটি পদক্ষেপের বিরোধিতার একটি আকার দিতে, যেটি জাতীয় পরিবর্তনগুলোকে বিবেচনায় নিতেও অস্বীকার করেছে। একইভাবে, সহজ হিসাবে সিংহলি ভোটারদের প্রশাসনকে সমর্থনের বিষয়টি প্রলুব্ধকরণের কারণে মনে হতে পারে; কিন্তু বাস্তবতা হল এটি হতে পারে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির এবং যুবকদের মোহমুক্তি, যাতে করে তারা গণহারে রাজাপাকসেকে ভোট দিয়েছেন।
২০১৫ সালের উদার গণতন্ত্রের পরীক্ষার পরাজয়ের দায়ভার বিস্তৃত আকারে সিরিসেনা ও বিক্রমাসিংহের ওপর পড়তে পারে। গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি ও অধিকার রক্ষার যে দায়িত্বটুকু বাকি ছিল তা এখন হয়ে গেল ছত্রভঙ্গ বাহিনী, যাদের কাজ হবে আসন্ন পার্লামেন্ট নির্বাচনের আগে পুনরায় জোট গড়ে তোলা। মুসলিম ও তামিল সংখ্যালঘু পার্টি যারা রাজাপাকসেকে পরাজিত করতে চেয়েছিল, জেভিপি ও বাম শক্তির সঙ্গে জোটের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা ব্যর্থ তৃতীয় শক্তি এবং বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনকারীদের এখন কাজ হবে ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে যাওয়া একনায়কসুলভ লোকরঞ্জনবাদীর হাত থেকে গণতান্ত্রিক পরিবেশকে রক্ষা করা।
দ্য হিন্দু থেকে অনুবাদ : সাইফুল ইসলাম
অহিলান কাদিরগামার : রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ, ইউনিভার্সিটি অব জাফনার শিক্ষক