নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি
অর্থনীতিতে ভালো খবর খুবই কম
ড. আর এম দেবনাথ
প্রকাশ: ২১ নভেম্বর ২০১৯, ০১:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
কপালে ভোগান্তি থাকলে এর থেকে রেহাই নেই। তা না হলে পেঁয়াজের সংকট চালের ওপর বর্তায় কীভাবে? শুধু কি চাল, কাঁচাবাজারেও, সয়াবিন তেলসহ আরও কিছু পণ্যেও।
এই ভোগান্তির সীমা থাকবে না, যদি পরিবহন ধর্মঘট অব্যাহত থাকে। যুগান্তরের ১৯ নভেম্বরের একটি প্রতিবেদনে দেখলাম, ১১ জেলায় যাত্রী ও পরিবহন চলাচল ব্যাহত।
কারণ আচমকা পরিবহন ধর্মঘট। দাবি, নতুন সড়ক আইন সংশোধন করতে হবে, এত কঠিন আইন মানি না! পেঁয়াজে তো দুর্ভোগ হয়েছেই। অথচ এর কোনো কারণ নেই। পেঁয়াজের উৎপাদন ও আমদানির তথ্য বলে দেশে পেঁয়াজ সংকট নেই।
কাগজের খবর চাহিদা ২৪ লাখ টন, উৎপাদনও ২৪ লাখ টন। এটি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য। এতদসত্ত্বেও পেঁয়াজ নিয়ে সারা দেশে তুলকালাম কাণ্ড ঘটেছে। পেঁয়াজ সংকটের যেমন কারণ নেই, তেমনি এ মুহূর্তে চালের দাম বাড়ারও কোনো কারণ নেই। এখন অগ্রহায়ণ মাস যা এক সময় ছিল বাঙালির বর্ষ শুরুর মাস।
চারদিকে ধান, নতুন ধান। ধান উঠতে শুরু করেছে। কৃষকরা বাড়িতে নিচ্ছেন ধান। এ মুহূর্তে চালের দাম কেন কেজিপ্রতি টিসিবি’র মতে চার থেকে দশ শতাংশ বাড়বে? অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে যে ধান-ফসল ওঠে তা আমন ধান।
বোরোর পরই আমনের স্থান, এক সময় অবশ্য আমনই ছিল এক নম্বর ফসল। এই ভরা মৌসুমে চালের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। মিলাররা বলছেন চার কথা : স্টক শেষ, সরবরাহ কম, সরকারি সংগ্রহ ছয় লাখ টন, তার ওপর রফতানির কথা। ব্যস, চালের মূল্য বাড়ছে। মাঝে মাঝে বাড়ছে শাক-সবজির দাম। নির্বাচিত কিছু পণ্যের দাম।
বলা বাহুল্য, পরিবহন ধর্মঘট চললে মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। খাদ্যমূল্য স্ফীতি অক্টোবর মাসে বেড়েছে। আরও বাড়বে। এসব লক্ষণ কি ভালো? না, কোনোভাবেই ভালো নয়; বিশেষ করে অর্থনীতির সার্বিক অবস্থার সঙ্গে মেলালে।
এর মধ্যে ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম চার মাস অতিবাহিত হয়েছে। আমরা আছি অর্থবছরের পঞ্চম মাসে। এরই মধ্যে প্রথম তিন/চার মাসের যে অবস্থার কথা বিভিন্ন কাগজে ছাপা হচ্ছে তাতে অর্থনীতির অবস্থা স্বস্তিকর বলে মনে হচ্ছে না। কেন বলছি।
আমদানি-রফতানি, রেমিটেন্স, আমানত-ঋণ প্রবৃদ্ধি, বেসরকারি ঋণ বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, কর আদায় এবং সরকারি ঋণের প্রবণতা মোটা দাগে এ কয়েকটি সূচক দিয়ে এ মুহূর্তের অর্থনীতি বোঝার চেষ্টা করা যাক।
রফতানি আমাদের অর্থনীতির দুই-তিন স্তম্ভের এক বড় স্তম্ভ। বিশেষ করে তৈরি পোশাকের রফতানি। দেখা যাচ্ছে এ খাত নানা সমস্যায় জর্জড়িত। বিদেশের বাজারে চাহিদার যেমন ঘাটতি হচ্ছে, তেমনি দেশের ভেতরেও সমস্যার অন্ত নেই।
দেখা যাচ্ছে এরই সূত্র ধরে জুলাই-অক্টোবর সময়কালে রফতানি হ্রাস পেয়েছে ছয় দশমিক ৪২ শতাংশ। তৈরি পোশাক রফতানি চ্যালেঞ্জের মুখে। এ খাতের নেতৃস্থানীয় ব্যবসায়ীরা প্রতিদিন নানা সমস্যার কথা বলছেন। কারখানা অর্ডারের অভাবে বন্ধ হচ্ছে।
ভিয়েতনাম, ভারত আমদানিকারকদের জন্য বিকল্প বাজার হচ্ছে। রফতানি মূল্যও হচ্ছে। তাদের দাবি টাকার অবমূল্যায়ন। তারা মনে করেন ডলার পিছু টাকা বেশি পেলেই সমস্যা কিছুটা লাঘব হবে।
কিন্তু এর সঙ্গে সম্পর্ক আমদানির। আমরা আমদানি বেশি করি। ডলারের দাম বাড়লে অভ্যন্তরীণ বাজারে জিনিসের দাম পড়বে। এটা যেন ‘শাঁখের করাত’।
এদিকে দেখা যাচ্ছে জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়কালে আমদানি হ্রাস পেয়েছে দুই দশমিক ৫৫ শতাংশ। তিন মাসে আমদানি ছিল গেল বছর ১৩ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলারের অথচ এবার হয়েছে মাত্র ১৩ দশমিক ২৫ বিলিয়ন (একশ’) ডলার।
এর ফলে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। এটি হয়েছে প্রধানত আমদানি হ্রাসের ফলে। এটা কিন্তু ভালো লক্ষণ নয়। আমদানির ক্ষেত্রে আমরা শুধু ভোগ্যপণ্যই আমদানি করি না, মধ্যবর্তী পণ্য এবং মূলধনী যন্ত্রপাতিও আমদানি করি।
মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি হ্রাস পেলে তা খুবই খারাপ খবর। কারণ এর সঙ্গেই সম্পর্কিত শিল্পায়ন। শিল্পের জন্যই যন্ত্রপাতি আমদানি করতে হয়। দেখা যাচ্ছে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির প্রবণতা হ্রাসের দিকে।
আমদানি-রফতানির সঙ্গে বহুলাংশের সম্পর্কিত কর্মসংস্থান, সিংহভাগ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। সরকারি রাজস্বও জড়িত এর সঙ্গে। অভ্যন্তরীণ ব্যবসা থেকে সরকার পায় মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট)।
আমদানি থেকে সরকার পায় আমদানি শুল্ক (কাস্টমস)। এই দুটো উৎস সরকারের রাজস্বের বড় অংশ। বাকি থাকে আয়কর (ইনকাম ট্যাক্স)। তিনে মিলেই সরকারি রাজস্ব। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, সরকারের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা মাফিক হচ্ছে না। ঘাটতি তৈরি হচ্ছে।
অথচ লক্ষ্যমাত্রার ওপর নির্ভর করে সরকারের খরচ নির্ধারণ করা আছে। জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়কালে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৪৭ হাজার ৩৮৮ কোটি টাকা। অথচ লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৬২ হাজার ২৯৪ কোটি টাকা। বলা বাহুল্য, ভ্যাট ও শুল্ক খাতেই ঘাটতি বেশি।
আমদানি ব্যবসায় মন্দার কারণেই তা হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ বেচাকেনার কোনো তথ্য আমাদের দেশে পাওয়া যায় না। কিন্তু ভ্যাটের পরিমাণ থেকে বোঝা যায় বেচাকেনার অবস্থা কী? ভ্যাট আদায় কম হচ্ছে। একমাত্র উজ্জ্বল দিক হচ্ছে আয়কর। সাতদিনের করমেলা শেষ হয়েছে সারা দেশে।
২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে মানুষের সাড়া বেশি। ঢাকার রাস্তায় হাঁটলেই দেখা যাচ্ছে রাজস্ব বিভাগের ছালার ব্যাগ, সুন্দর ব্যাগ। তার মানে এরা করমেলায় কর দিয়ে এসেছেন। সোমবার ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় পাঁচ লাখ করদাতা কর দিয়েছেন বলে খবর।
এটা এক অকল্পনীয় ঘটনা। বোঝা যায় ভয়-ভীতি না থাকলে, ঝামেলা কম হলে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে কর দিতে রাজি। দরকার ‘রিটার্নের ফরম’ সহজ করা, ডকুমেন্টেশনের কড়াকড়ি শিথিল করা।
এসব ধীরে ধীরে হচ্ছে। সরকার এর ফলও পাচ্ছে। কিন্তু ভ্যাট ও শুল্কের আদায় না বাড়লে শুধু আয়কর দিয়ে তো সরকারের চলবে না। কর আদায় কম হওয়ায় সরকার এখন বর্ধিষ্ণু হারে ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে। আগে সরকার ঋণ নিত সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে।
এর বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের চাপের কারণে সরকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি প্রায় বন্ধই করে দিয়েছে। বহু কড়াকড়ি এখন সঞ্চয়পত্র ক্রয়ে। এমতাবস্থায় সরকার ঋণ নিচ্ছে ব্যাংক থেকে।
ব্যাংক থেকে মানে সরকারি ব্যাংক থেকে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরে ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নিয়েছিল মাত্র ৫৩৫ কোটি টাকা। অথচ এবারের একই সময়ে ঋণের পরিমাণ ৩৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। এতে ব্যবসায়ীরা ক্ষিপ্ত। তারা বলছেন তারা ঋণ পাচ্ছেন না। এ কথা অনেকটা সত্য।
এখানে সমস্যা দুটো। প্রথমত আমানতের প্রবৃদ্ধি কম। ঋণের প্রবৃদ্ধি বেশি। অনেক বেসরকারি ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত সীমার বাইরে ঋণ দিয়ে ফেঁসে আছে। তাদের এখন ঋণ সমন্বয় করতে হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, ২০১৮ সালে আমানত বৃদ্ধি পায় ৯ দশমিক ৮ শতাংশ হারে।
অথচ ঋণ বৃদ্ধি পায় ১২ দশমিক ৩২ শতাংশ হারে। এটা খুবই বাজে নজির। আমানতের প্রবৃদ্ধির বেশি ধরনের প্রবৃদ্ধি ঘটা মানে ব্যাংকের তারল্য সংকট অবশ্যম্ভাবী। ব্যাংক এখন আমানত পাচ্ছে না। মানুষ সঞ্চয়পত্রে যেতে চায়, সরকার তা দেবে না। সরকার চায় মানুষ শেয়ারবাজারে থাক। মানুষ ঘর পোড়া গরু।
তারা সেখানে যেতে চায় না। সম্পত্তি, ফ্ল্যাটের বাজারেও মন্দা। তাহলে মানুষ টাকা কী করছে? নাকি মানুষের সঞ্চয়ই কম? মানুষের আয় স্থবির। অথচ খরচ বাড়ছে। নতুন কর্মসংস্থান নগণ্য।
এসব কারণেই কি ব্যাংকের আমানত বাড়ছে না? যে কারণেই হোক, এর ফলে অনেক ব্যাংক ‘৯-৬’ আমানত-ঋণের সুদের সিদ্ধান্ত কার্যকর করছে না। অন্তত বাজারের কথা তাই। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রশ্ন আছে বিশ্লেষকদের। তারা প্রশ্ন করছেন, কোন শক্তিতে ব্যাংক মালিকরা ৯-৬ সুদনীতি কার্যকর করছে না?
দৃশ্যত মনে হচ্ছে, বিষয়টি জটিল আকার ধারণ করেছে। ‘ডাবল ডিজিট’ সুদ এবং তস্য সুদ দিয়ে ব্যবসা করা সম্ভব নয়। আবার ছয় শতাংশ সুদে আমানতকারীদের লোকসান। কারণ প্রায় ছয় শতাংশ হচ্ছে মূল্যস্ফীতি।
অতএব, এই হারে ব্যাংক আমানত পায় না। এক্ষেত্রে একটা সমঝোতা দরকার। সরকার নানাভাবে এর সমাধান করতে পারে। হয় ভর্তুকি ব্যাংক ঋণে, অথবা আমানতে। কারণ সঞ্চয় না হলে আমানত হবে না। এটি খুব ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়। এসব কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বেসরকারি খাতের ঋণ। এ খাতে ঋণ প্রবাহ বাড়ছেই না। আগস্ট মাসে বেসরকারি খাতে ঋণ বেড়েছিল ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশ। অথচ সেপ্টেম্বরে কমে তা দাঁড়ায় ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশে।
এর কারণ কি শুধু ঋণপ্রাপ্তিতে বাধা, না মন্দার ঘটনাও আছে? আরেক প্রশ্ন এখন সবার মধ্যে। আমাদের অনেক শিল্প এখন ‘ওভার ক্যাপাসিটিতে’ ভুগছে। এমনকি তৈরি পোশাক খাতও। সিমেন্ট, চিনি, ইস্পাত, বস্ত্র ইত্যাদি খাতে ‘ওভার ক্যাপাসিটি’ তৈরি হয়ে আছে। আবার বিদেশে বিনিয়োগের সুবিধা নিতে উদ্যোক্তারা আগ্রহী। পুঁজি বাজারের বিষয় তো আছেই। কিন্তু এ তালগোলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রকৃত ব্যবসায়ী শিল্পপতিরা।
পরিশেষে ভালো খবরটি দেব। আর সেটি হচ্ছে রেমিটেন্সের খবর। জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়কালে রেমিটেন্স বৃদ্ধি পেয়েছে ১৬ দশমিক ৫৪ শতাংশ। খুবই আশাব্যঞ্জক ঘটনা। ডলারপ্রতি দুই টাকা ভর্তুকি দেয়ায় রেমিটেন্স বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে অনেকের ধারণা।
আবার বিদেশে পাঠানো টাকা ভর্তুকির কারণে দেশে ফেরত আসতে থাকবে- এটি ঘটতে পারে বলে কেউ কেউ মনে করেন। প্রকৃত ঘটনাটি খুঁজে বের করা দরকার। কারণ সাধারণ জ্ঞানই বলে টাকা বিদেশে যেমন পাচার হয়, তেমনি টাকা দেশেও আসে।
এটা দ্বিমুখী ব্যাপার। তবে যাই হোক, রেমিটেন্স ক্ষেত্রে খবর ভালো। এতে গ্রামীণ ‘ভোগস্তর’ ঠিক আছে। ভোগ দরকার। ভোগ বা কনজাম্পশন না থাকলে অর্থনীতির চাহিদা আসবে কোত্থেকে? এখানেই মূল্যস্ফীতির কথা। মূল্যস্ফীতির কারণে মধ্যবিত্ত ভোগ কমাতে বাধ্য হয়, যা চাহিদা সৃষ্টিতে একটা বড় বাধা।
ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
rmdebnath@yahoo.com