চামড়া শিল্পে সম্ভাবনা বাড়ছে

গিয়াস উদ্দিন
প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর ২০১৯, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

চামড়া শিল্প। ছবি: সংগৃহীত
বিশ্বব্যাপী চামড়ার বাজারে বাংলাদেশকে ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে তুলে ধরতে এবং বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের চামড়া শিল্পকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় নিয়ে ঢাকায় হয়ে গেল তিন দিনব্যাপী বাংলাদেশ লেদার ফুটওয়্যার অ্যান্ড লেদারগুডস ইন্টারন্যাশনাল সোর্সিং শো (ব্লিস) ২০১৯।
ব্লিসের ৩য় সংস্করণের এবারের মূল বিষয় ছিল ‘ফিউচার প্রুফ সোর্সিং’। এবারের প্রদর্শনীতে ফিউচার প্রুফ সোর্সিং সমাধান হিসেবে বাংলাদেশকে তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির গল্প, প্রযুক্তি ও অভিযোজনযোগ্যতা, স্থায়িত্বের দিকে অগ্রযাত্রা এবং বাংলাদেশের ভৌগোলিক সুবিধা- এই চারটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে এবারের প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল।
এ প্রদর্শনীর মাধ্যমে এই শিল্প খাতের ক্রেতা, বিশ্ববাজারের খুচরা ক্রেতা এবং আন্তর্জাতিক সোর্সিং এজেন্টদের একই ছাদের নিচে নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। ফলে তারা সরাসরি স্থানীয় উৎপাদনকারী ও রফতানিকারকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছেন এবং বাংলাদেশকে এ খাতের একটি সোর্সিং হাব হিসেবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন।
৩০ অক্টোবর এই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময়ে তিনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক্সপোর্ট কম্পিটিটিভনেস ফর জবস প্রকল্পের ম্যাচিং গ্র্যান্ট উদ্বোধন করেন। এর পাশাপাশি আইএফসির অর্থায়নে বাংলাদেশ লেদার সেক্টরের জন্য তৈরিকৃত কমপ্লায়েন্সের জন্য ই-মডিউলও উদ্বোধন করেন।
বাংলাদেশ বিশ্বের নামিদামি ব্র্যান্ডস ও ক্রেতাদের জন্য ফিউচার প্রুফ সোর্সিংয়ের গন্তব্য হতে পারে, যদি সরকার ও নীতিনির্ধারকরা এ খাতের অপার সম্ভাবনা বিবেচনায় নিয়ে বাস্তবিক প্রয়োগযোগ্য সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করেন। এ প্রদর্শনীতে ৩০ জনেরও বেশি আন্তর্জাতিক ক্রেতা ও ব্র্যান্ড প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন।
আঞ্চলিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সুযোগ, মধ্য-ব্যবস্থাপনায় নারীর ক্ষমতায়ন, টেকসই উন্নয়ন প্রতিবেদন, ব্র্যান্ডিংয়ের সুযোগসমূহ নিয়ে প্রদর্শনীর পাশাপাশি তিনটি ব্রেকআউট সেশন পরিচালনা করা হয়।
ব্রেকআউট সেশনগুলোর প্যানেল ডিসকাশনে ছিলেন এলএফএমইএবি ও পিকার্ড বাংলাদেশ লিমিটেডের সভাপতি সায়ফুল ইসলাম, ইন্ডিয়ান শু ফেডারেশনের সভাপতি ভি. মুথুকুমারান, অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর এবং বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক। এছাড়াও প্যানেল ডিসকাশনে এ খাতের সংশ্লিষ্ট আরও অনেক প্রতিধিনিধি অংশগ্রহণ করেন।
প্রতিযোগিতামূলক উৎপাদন মূল্য, ক্রমবর্ধমান কমপ্লায়েন্স প্র্যাকটিস, দক্ষ ও কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী, ইউরোপ ও চীনা বাজারে বাণিজ্য অগ্রাধিকারের কারণে বাংলাদেশ, চীন, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ায় শিল্প স্থাপনের তুলনায় বাংলাদেশ সারা বিশ্বের চামড়ার বাজারে প্রতিযোগিতামূলক জায়গা হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে।
এ প্রদর্শনীটি বাংলাদেশের লেদার ফুটওয়্যার অ্যান্ড লেদারগুডস শিল্প খাতের সংশ্লিষ্ট সবাইকে তথ্য, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা আদান-প্রদানে সহায়তা করেছে। প্রদর্শনীতে ছিল বাংলাদেশ থেকে উৎপাদিত আধুনিক ফ্যাশনের জুতা ও চামড়াজাত পণ্যের সমাহার।
জেন্টস, লেডিস ও কিডস সুজ, চামড়ার তৈরি ব্যাগ, মানিব্যাগ, সুটকেস, ট্রাভেল ব্যাগ, বেল্ট, গ্লোভস ছাড়াও আরও বৈচিত্র্যময় পণ্যসামগ্রি প্রদর্শন করা হয়। প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করে বিভিন্ন ব্র্যান্ড, আন্তর্জাতিক ক্রেতাবৃন্দ, ডিজাইনার, ফ্যাশন এক্সপার্ট, ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ, সোর্সিং এজেন্ট, রিটেইল চেইন, পরিবেশক, সম্ভাব্য বিদেশি ও স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা।
বাংলাদেশে তৈরি ও উৎপাদিত রফতানিমুখী পণ্যসমূহ প্রদর্শন করার জন্য ১০টি প্যাভেলিয়ন ও ৩০টি বুথ ছিল। পণ্য প্রদর্শন করেছেন দেশের স্বনামধন্য স্থানীয় ও বৈদেশিক পাদুকা ও চামড়াজাত পণ্য প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো।
পাশাপাশি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাস্তবায়িত এক্সপোর্ট কম্পেটিটিভনেস ফর জবস প্রকল্পের সহায়তায় ১০টি এসএমই প্রতিষ্ঠান এবারের প্রদর্শনীতে পণ্য প্রদর্শন করেছে। একটি নতুন ধরনের সোর্সিং সল্যুয়েশন অভিজ্ঞতা প্রদান, নেটওয়ার্কিং ইভেন্টস এবং ব্যবসায়িক সহযোগিতা বাড়াতে সরাসরি ফ্যাক্টরি ভিজিটের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বাংলাদেশের চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা খাতের সম্ভাবনা, ব্লিসে অংশগ্রহণকারী এবং আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের কাছে তুলে ধরতে বিশ্বব্যাংক গ্রুপের প্রতিষ্ঠান আইএফসির সহায়তায় মাসব্যাপী প্রচারণা এবং ডিজিটাল ক্যাম্পেইন পরিচালনা করা হয়েছে।
লেদারগুডস এবং পাদুকা শিল্পে অধিক শ্রম ও শক্তির প্রয়োজন। এ খাতে বর্তমানে ৬০ শতাংশেরও বেশি মহিলা কর্মী রয়েছে। বর্তমানে এই শিল্পে প্রায় ২ লাখ কর্মী নিযুক্ত রয়েছেন এবং ভবিষ্যতে আরও কয়েক লাখ কর্মী নিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে।
বর্তমানে প্রায় ২২০টি ট্যানারি, ৩,৫০০টি ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান, প্রায় ৯০টি বড় সংস্থা এবং ১৫টি বড় প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে চামড়া শিল্প গঠিত। দেশে বছরে ৩১০ মিলিয়ন বর্গফুট চামড়ার কাঁচামাল উৎপাদিত হয়। দেশের প্রায় ৭৬ শতাংশ ট্যানারি রফতানিমুখী।
বর্তমানে আমাদের রফতানি আয় ১ বিলিয়নের বেশি এবং এটি আরএমজির পর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানি খাত হিসেবে তৈরি হয়েছে। গত এক দশকে দেশের চামড়া শিল্পের রফতানি ৫০০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ উৎপাদনে বিশ্বে ৬ষ্ঠ স্থান এবং বিশ্বব্যাপী রফতানিতে ২০তম স্থান অর্জন করেছে।
বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৮টি দেশে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরে আরও ১০টি দেশে জিএসপি সুবিধা পাচ্ছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চামড়া শিল্পে রফতানি আয় হয়েছে রেকর্ড ১০১৯.৭৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যেখানে অন্যান্য পাদুকা (চামড়াবিহীন) শিল্পের রফতানি আয় ১১.২৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। আশা করা হচ্ছে, ২০২২ সালের মধ্যে এ খাত থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার রফতানি আয় করা সম্ভব হবে।
গিয়াস উদ্দিন : চামড়া বিশেষজ্ঞ