Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

কারিগরি শিক্ষা নিম্নমাধ্যমিক থেকে শুরু হচ্ছে

Icon

ড. আবদুস সাত্তার মোল্লা

প্রকাশ: ১৮ নভেম্বর ২০১৯, ০১:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কারিগরি শিক্ষা নিম্নমাধ্যমিক থেকে শুরু হচ্ছে

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মো. ইকবাল হোসেনের ‘মাধ্যমিকে কর্মমুখী শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা কি জরুরি?’ শীর্ষক নিবন্ধ (যুগান্তর, ২৭.০৮.২০১৯) পড়ে মনে হয়েছিল, সাধারণ শিক্ষায় একটি কারিগরি বিষয় বাধ্যতামূলক করার সরকারি পরিকল্পনা রয়েছে।

উল্লেখ্য, স্বাধীন বাংলাদেশে প্রাথমিক থেকে নিম্নমাধ্যমিক পর্যায় (ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি) পর্যন্ত সাধারণ শিক্ষা ও মাদ্রাসা শিক্ষা নামে শিক্ষার দুটো প্রধান ধারা বা উপব্যবস্থা বিদ্যমান। মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরের মাঝখানে অবস্থিত (মধ্য) মাধ্যমিক উপস্তর (নবম-দশম শ্রেণি) থেকে তৃতীয় উপব্যবস্থা হিসেবে কারিগরি শিক্ষাধারা শুরু হয়।

দেশে ইংরেজি মাধ্যম নামে যে ব্যবস্থাটি রয়েছে তা কোনো স্বতন্ত্র উপব্যবস্থা নয়, বরং সাধারণ শিক্ষাধারারই অংশ। একইভাবে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাও কোনো পৃথক উপব্যবস্থা নয়, সেটি মাদ্রাসা শিক্ষাধারারই অংশ। তবে ইংরেজি মাধ্যম ও কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা দেশের জাতীয় শিক্ষাক্রমের বাইরে পড়ে আছে এবং এ অবস্থাকে তো দুঃখজনকই বলতে হয়।

আধুনিক বিশ্বে, বৈজ্ঞানিক যুগে কারিগরি দক্ষতা ছাড়া শুধু সাধারণ জ্ঞান দিয়ে কোনো পেশাই ভালো চলে না। এটা বুঝে পাকিস্তান আমলের শেষ দিক (১৯৬৭ সাল) থেকেই কারিগরি শিক্ষা একটি স্বতন্ত্রধারা হিসেবে প্রবর্তিত হয়।

কারিগরি শিক্ষায় সাধারণ শিক্ষার মতো তাত্ত্বিক ভিত্তির দরকার হলেও এ শিক্ষা ব্যবহারিক প্রধান (Practical-oriented) এবং কারিগরি বিদ্যালয়ে যথোপযুক্ত ল্যাবরেটরি বা সংযুক্ত কারখানা থাকা জরুরি।

এরূপ মানের ল্যাবরেটরি বা কারখানা সাধারণ শিক্ষার বিদ্যালয়ে দরকার হয় না। তাই আমি ড. মো. ইকবাল হোসেনের সঙ্গে একমত যে কারিগরি বিষয় সাধারণ শিক্ষায় বাধ্যতামূলক করার পরিবর্তে এরূপ বিষয় শুধু কারিগরি শিক্ষাধারারই উপযোগী।

উক্ত মতটি আমি এ দৈনিকে ১৫ বছর আগে প্রকাশিত ‘ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তিমূলক শিক্ষা’ শীর্ষক নিবন্ধে (২৬.০৮.২০০৪) অত্যন্ত জোরের সঙ্গে ব্যক্ত করেছিলাম। সেখানে লিখেছিলাম, ‘বৃত্তিমূলক শিক্ষা দেয়ার জন্য আমাদের একটি প্রতিষ্ঠিত কারিগরি-বৃত্তিমূলক শিক্ষা উপব্যবস্থা রয়েছে।

সেটিকে ব্যবহার করেই আমরা ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের অধিক হারে বৃত্তিমূলক শিক্ষা দিতে পারি। এর জন্য আমাদের সাধারণ শিক্ষা উপব্যবস্থাকে দুর্বল অথবা অতিরিক্ত ভারে ন্যুব্জ করার কোনো দরকার হয় না।’

‘কর্মমুখী প্রকৌশল শিক্ষা-১, ২, ও ৩ নামে তিনটি বই প্রণয়নের জন্য’ যে ‘সিলেবাস তৈরির কাজ শেষ হয়েছে’ সেগুলো আসলে সাধারণ শিক্ষাধারার জন্য নয়। ড. মো. ইকবাল হোসেনের তথ্যসূত্র সম্ভবত ঠিক নেই! বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড (বাকাশিবো) ‘কর্মমুখী প্রকৌশল শিক্ষা-১’ পাঠ্যপুস্তকটি প্রণয়ন করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (জাশিপাবো) কাছে পাঠিয়েছে প্রকাশ করার জন্য।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড (বামাশিবো) প্রণীত ইবতেদায়ি ও দাখিল স্তরের সব পাঠ্যপুস্তক এবং বাকাশিবো প্রণীত এসএসসি-ভোকেশনাল পাঠ্যপুস্তক জাশিপাবো শুধু প্রকাশ করে, প্রণয়ন করে না।

কিন্তু সাধারণ শিক্ষাধারার প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক জাশিপাবো প্রণয়ন করে (দশম শ্রেণি পর্যন্ত) বা করিয়ে (উচ্চমাধ্যমিক উপস্তরের অধিকাংশ) প্রকাশ করে অথবা অনুমোদন দেয়। ষষ্ঠ শ্রেণির জন্য প্রচ্ছদে ‘জেএসসি-ভোকেশনাল’ লেখা কর্মমুখী প্রকৌশল শিক্ষা-১ পাঠ্যপুস্তকটি বাকাশিবো প্রণয়ন করায় বিষয়টি স্পষ্ট যে এটি কারিগরি শিক্ষাধারায় পাঠ্য।

বাংলাদেশ কারিগরি দক্ষতায় দারুণভাবে পিছিয়ে থাকায় আমাদের বিপুল জনগোষ্ঠীর যে প্রায় এক কোটি লোক আমরা বিদেশে ‘রফতানি’ করেছি তার অর্ধেকের বেশি অদক্ষ বা স্বল্পদক্ষ, প্রধানত শ্রমিক শ্রেণির। এতে জাতি যেমন বিদেশে অসম্মানের শিকার হয়, তেমনি বৈদেশিক মুদ্রা আয়ও হয় কম।

অধিকন্তু আমাদের প্রধান শিল্প খাত-পোশাকশিল্পে বিদেশি দক্ষ কারিগর এবং ব্যবস্থাপক ‘আমদানি’ করতে হয়; এতে নাকি ওই শিল্প খাতের লাভের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বিদেশে ফেরত চলে যায়। এ কারণে আমি ওই দৈনিকে প্রকাশিত উল্লিখিত নিবন্ধে এবং পরে ২০০৮ সালে (Needed : A revolution in technical education; 08.01.2008) আরেকটি লেখায় দেশে কারিগরি শিক্ষায় একটি বিপ্লবের আহ্বান জানিয়েছিলাম।

অথচ লক্ষ করা গেছে, দেশের কারিগরি শিক্ষাধারায় তখন বিদ্যমান শিক্ষার্থীর আসন সংখ্যাও পূরণ হচ্ছিল না। এর প্রধান কারণ হিসেবে লিখেছিলাম : ‘এসব প্রতিষ্ঠান সাধারণ শিক্ষার স্কুলগুলোর মতো হাতের কাছে পাওয়া যায় না এবং বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউটগুলো অধিকাংশ অভিভাবকের কাছে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতিই পাচ্ছে না।’

ওই সমস্যার সমাধান হিসেবে উভয় নিবন্ধে দেশের প্রতি জেলায় অন্তত একটি করে পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট এবং প্রতি উপজেলায় একটি টেকনিক্যাল স্কুল-কলেজ ধরনের বৃত্তিমূলক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনেরও দাবি জানিয়েছিলাম।

আশার কথা, বর্তমানে দেশে ৫২টি সরকারি পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট আছে (বেসরকারি পলিটেকনিকের সংখ্যা ৩৮৭, সূত্র : বেনবেইস), অর্থাৎ আমরা প্রতি জেলায় একটি করে সরকারি পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট স্থাপনের কাজ প্রায় শেষ করে এনেছি; কিন্তু সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজের সংখ্যা এখনও মাত্র ৬৪ (বেসরকারি ১১০)।

জানা যায়, প্রতিটি উপজেলায় একটি করে টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা করার সরকারি পরিকল্পনা রয়েছে। এ লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে ‘১০০টি উপজেলায় একটি করে টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ইতিমধ্যে রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগের ১৬ উপজেলায় একটি করে টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ স্থাপন করা হয়েছে/হচ্ছে এবং এসব টেকনিক্যাল স্কুলেই ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে শুধু ষষ্ঠ শ্রেণিতে ‘কর্মমুখী প্রকৌশল শিক্ষা-১’ পাঠ্যপুস্তকটি পাঠ্য হচ্ছে।

পরিকল্পনা অনুসারে কর্মমুখী প্রকৌশল শিক্ষার দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড যথাক্রমে সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণিতে অনুশীলন শেষে ‘জেএসসি-ভোকেশনাল’ পরীক্ষার মাধ্যমে এ পর্ব শেষ হওয়ার কথা।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কারিগরি শিক্ষাকে নবম থেকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে নামিয়ে আনা ঠিক কিনা। এ বিষয়ে প্রথম নিবন্ধ লেখার সময় জেনেছিলাম চীনসহ পূর্ব এশিয়ার বেশ কয়েকটি উন্নত-উন্নয়নশীল দেশে নিম্নমাধ্যমিক পর্যায় থেকেই বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল। অথচ আমাদের দেশে নবম শ্রেণির আগে এরূপ শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা ছিল না (এখনও নেই)।

তাই প্রাথমিকের পর থেকেই দেশে বৃত্তিমূলক-কারিগরি শিক্ষা প্রবর্তন করার দাবি জানিয়েছিলাম। বর্তমানে চীন আর সেই অবস্থায় নেই। বিশ্বের নতুন শিক্ষাব্যবস্থায় বিভিন্ন দেশে অষ্টম, নবম বা দশম (এমনকি দ্বাদশ) শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাকে ‘মৌলিক’ হিসেবে ঘোষণা করা হচ্ছে।

‘মৌলিক’ শিক্ষার প্রধান তিনটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে : অভিন্ন ধারায় রাখা, আবশ্যিক ঘোষণা করা এবং সম্ভব হলে অবৈতনিক করা। চীনে মাধ্যমিক স্তরের প্রথম উপস্তর নিম্নমাধ্যমিক (সপ্তম-নবম শ্রেণি) ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষাস্তরের সঙ্গে মৌলিক (ও আবশ্যিক) হিসেবে গণ্য।

তাই দশম শ্রেণি থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে বিভিন্ন ধারায় শিক্ষা শুরু হয় যার মধ্যে একটি শক্তিশালী বৃত্তিমূলক-কারিগরি শিক্ষাধারার প্রবর্তন হয়েছে। কারিগরি শিক্ষার মান বৃদ্ধির জন্য চীন এ ধারার শিক্ষায় শিল্প-সংযোগ (Industrial attachment) আবশ্যিক করেছে। তাইওয়ান এবং জাপানের শিক্ষাও এ ধারার।

বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষায় দক্ষিণ কোরিয়াকে নানাভাবে অনুসরণ করে ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত টেকনিক্যাল সেন্টারসহ দেশে বেশ কয়েকটি বাংলাদেশ-কোরিয়া যৌথ উদ্যোগের কারিগরি শিক্ষাকেন্দ্র রয়েছে। কোরিয়া এখনও ষষ্ঠ শ্রেণির প্রাথমিক শিক্ষার পর নিম্নমাধ্যমিকের শুরু অর্থাৎ সপ্তম শ্রেণি থেকেই বৃত্তিমূলক-কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা রেখেছে।

শিক্ষায় উদীয়মান শক্তি মালয়েশিয়ায়ও অনুরূপ ব্যবস্থা রয়েছে। বিজ্ঞান ও গণিতে বিশ্বসেরা সিঙ্গাপুরেও নিম্নমাধ্যমিক (সপ্তম শ্রেণি) থেকে ‘নরমাল টেকনিক্যাল’ নামে কারিগরি শিক্ষাধারা বহাল রয়েছে। উল্লিখিত তিনটি দেশেই প্রাথমিক শিক্ষাস্তর ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত।

তাই এসব দেশে বৃত্তিমূলক-কারিগরি শিক্ষা সপ্তম শ্রেণি থেকে শুরু হয়। বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষাস্তর পঞ্চম শ্রেণিতে শেষ হওয়ায় আমাদের কারিগরি শিক্ষা যুক্তিসঙ্গতভাবেই ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে শুরু হতে পারে।

তবে এ ব্যবস্থায় যে অসুবিধাটি রয়ে যাচ্ছে তা হল, আমাদের অভিন্ন ধারার মৌলিক শিক্ষাস্তর অষ্টম থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে নেমে যাচ্ছে। তাতেও তেমন সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

আমরা বরং দুটো ভাষা, গণিত, বিজ্ঞান, সমাজ (নতুন নাম ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’) এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি- এই পাঁচ-ছয়টি কোর বিষয় সব ধারায় কমন রেখে শিক্ষায় ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে একতা’ (Unity in diversity) নীতিতে চলতে পারি।

এসএসসি-ভোকেশনালের মতো জেএসসি-ভোকেশনাল স্তরেও বিজ্ঞানসহ কোর বিষয়গুলো পাঠ্য থাকলে কারিগরি শিক্ষার ভিত দুর্বল হওয়ার কোনো কারণ নেই।

মৌলিক শিক্ষার অভিন্নতা হারানোর মতো ‘সামান্য ক্ষতির’ বিনিময়ে লাভটি হতে পারে বেশ খাসা। জেএসসি-ভোকেশনালসহ কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা প্রতি উপজেলায় করা গেলে এ ধারার শিক্ষা শিক্ষার্থীদের দোরগোড়ায় চলে আসবে এবং আশা করা যায় অভিভাবক ও শিক্ষার্থী উভয়ের কাছে এ শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ, সম্মানজনক ও উপকারী হিসেবে গ্রহণযোগ্য এবং আকর্ষণীয় হবে।

কারিগরি শিক্ষার সার্বিক বিকাশের জন্য দরকার হবে বহির্বিশ্ব ও দেশের ভেতর দক্ষতার চাহিদা ভালোভাবে নিরূপণ করে কারিগরি শিক্ষাক্রমের আশু উন্নয়ন এবং পরিকল্পনামাফিক প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সহায়তাসহ বিদ্যালয়গুলো স্থাপন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা। তাছাড়া বিদ্যমান কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শূন্যপদগুলো সত্বর পূরণ করে শিক্ষক সংকটের অবসান করাও জরুরি।

ড. আবদুস সাত্তার মোল্লা : শিক্ষা গবেষক এবং বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার সদস্য

asmolla@ymail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম