পেঁয়াজ বাজারের কেন এ হাল
এসএম নাজের হোসাইন
প্রকাশ: ১৫ নভেম্বর ২০১৯, ০১:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
এসএম নাজের হোসাইন। ফাইল ছবি
দেশে পেঁয়াজের দাম দফায় দফায় বাড়লেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) এবং জেলা প্রশাসন কোনো ধরনের উদ্যোগ না নিয়ে নীরব থাকায় জনমনে ক্ষোভ ক্রমেই বাড়ছে।
যে কোনো পণ্যের দাম বাড়লে বা কৃত্রিম সংকট তৈরি হলে ইতিপূর্বে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসন ওই খাতের ব্যবসায়ী ও ভোক্তা এবং প্রশাসনের লোকজনকে নিয়ে করণীয় বিষয়ে পরামর্শসভা করে বাজারে অস্থিরতা দূরীকরণের উদ্যোগ নিয়েছে।
কিন্তু ইদানীং লক্ষ করা যাচ্ছে, সরকারের দায়িত্বশীল লোকজন ব্যবসায়ীদের ওপর সবকিছু ছেড়ে দিয়ে দিবাস্বপ্নে বিভোর। এর আগে ব্যবসায়ীরা বাজেটে শুল্ক আরোপসহ নানা অজুহাতে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ালেও সরকার বেশকিছু পণ্যের বিষয়ে শুল্ক ছাড় দেয়ার পরও বাজারে তার কোনো প্রতিফলন ঘটেনি। ফলে সবরকম নিত্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে।
এ অবস্থায় জরুরিভাবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, জেলা-উপজেলা প্রশাসন, জাতীয় ভোক্তা অধিকার অধিদফতরসহ সরকারের বিভিন্ন বিভাগের প্রতিনিধি, ক্যাব, গণমাধ্যম ও চেম্বার প্রতিনিধি সমন্বয়ে বাজার তদারকি জোরদার, জাতীয় ও স্থানীয়ভাবে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে জরুরি সভা করে সম্ভাব্য করণীয় নির্ধারণ, বিকল্প উৎস থেকে পণ্য আমদানি নিশ্চিত করা, বিকল্প বাজার হিসেবে টিসিবির মাধ্যমে পেঁয়াজ বিক্রি জোরদার করার দাবি জানিয়েছে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশসহ (ক্যাব) বিভিন্ন সামাজিক, পেশাজীবী, রাজনৈতিক ও নাগরিক সংগঠন।
গতকাল পর্যন্ত বাজারে পেঁয়াজের দাম উঠেছে কেজিপ্রতি ২৪০-২৫০ টাকায়। ভারতের রফতানি বন্ধের সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় বাজারে দাম বাড়ানো শুরু হয়েছে। তবে খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, আমদানি কম হওয়ার সুযোগ নিয়ে হিলি বন্দরের পাইকাররা কারসাজি করে পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
এ অবস্থায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় টিসিবির মাধ্যমে স্থানীয় বাজার থেকে ক্রয় করে ঢাকা শহরে ট্রাকে কিছু পেঁয়াজ বিক্রি করলেও নিজেরা আন্তর্জাতিক উৎস থেকে আমদানি করে কোনো পেঁয়াজ আনেনি। ফলে বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া টিসিবি সংকটকালীন সাধারণ মানুষের উদ্ধারকর্তা হতে পারেনি।
দেশের বিভিন্ন জেলায় স্থাপিত অফিস ও জনবল এবং বিশাল বহরের ডিলারগুলো বেকার বসে অলস সময় কাটাচ্ছে। ক্যাব দীর্ঘদিন ধরে টিসিবিকে কার্যকর করা, বর্তমান প্রশাসনিক অবকাঠামোকে পুনর্গঠন করে কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার দাবি জানালেও সরকার এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি, যার খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
এদিকে সরকার টিসিবির মাধ্যমে পেঁয়াজ আমদানি না করে কিছু বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীর মাধ্যমে পেঁয়াজ আমদানির উদ্যোগ নেয়। ফলে ব্যবসায়ীরা আজ নয় কাল এভাবে কালক্ষেপণ করার কারণে সমস্যাটি আরও ঘনীভূত হতে থাকে। বৃহৎ শিল্প গ্রুপের পেয়াঁজ এখনও দেশের বাজারে প্রবেশ করতে পারেনি।
বিষয়টিকে আবারও ব্যবসায়ীদের হাতে সরকারের আত্মসমর্পণ বলছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। কারণ সরকার যদি নিজে পেঁয়াজ আমদানি করত, তাহলে ব্যবসায়ীদের ওপর সরকারের এত নির্ভরতা বাড়ত না। মানুষের দুর্ভোগ সীমাহীন পর্যায়ে পৌঁছাত না।
বাজার ও ভোক্তা খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিত্যপণ্যের বাজার ঊর্ধ্বগতির মূল কারণ আমদানিকারক ও বড় ব্যবসায়ী কর্তৃক পণ্যের হাতবদল। কারণ যখনই পণ্য হাতবদল হয় তখনই লাভের অঙ্ক বেড়ে যায়। বৃহৎ আমদানিকারক ও শিল্প গ্রুপ যখন আমদানি করবে, তারা নিজেরা সরাসরি এগুলো বিক্রি করবে না, বিভিন্নজন পাইকারিতে বিক্রি করবে আর তাদের মাধ্যমে হাতবদল থেকে আবারও পেঁয়াজের বাজার অস্থির হতে পারে।
এছাড়া একটি শুভঙ্করের ফাঁকি আছে পেঁয়াজের উৎপাদন, ব্যবহার ও পরিসংখ্যান নিয়ে। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, দেশে পেঁয়াজের চাহিদা ২৬ লাখ টন, আর দেশে উৎপাদিত হয় ১৮ লাখ টন। বাদবাকি ৮ লাখ টন বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। কিন্তু পেঁয়াজের সিংহভাগ দেশে উৎপাদিত হলেও দেশীয় পেঁয়াজের দাম সবসময় বিদেশি পেঁয়াজের চেয়ে বেশি থাকে। দেশীয় পেঁয়াজ বাজারে সবসময় সহজলভ্যও নয়।
এ কারণে দেশীয় পেঁয়াজের চাহিদা ও উৎপাদনের পরিসংখ্যানটি কতটুকু সত্য তা যাচাই করা দরকার। দেশীয় চাহিদা ও উৎপাদনের যে রকম প্রকৃত পরিসংখ্যান বের করতে হবে, একইসঙ্গে দেশীয় কৃষককে তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য উৎপাদনকালীন বিদেশি পেঁয়াজ আমদানিতে উচ্চ হারে কর আরোপ করতে হবে।
এছাড়াও প্রকৃত কৃষকের মাঝে প্রণোদনা হিসেবে স্বল্পসুদে ঋণ, ভর্তুকি প্রদান, কৃষক পর্যায়ে পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য খাদ্য গুদাম, হিমাগার নির্মাণ করা যেতে পারে।
পেঁয়াজ সংকট চলাকালে জেলা প্রশাসন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও জাতীয় ভোক্তা অধিদফতরের সমন্বিত বাজার অভিযানকালে যে বিষয়টি বেশি করে দেখা গেছে তা হল, আমদানিকারক আমদানি করে আড়তদারদের হাতে পণ্য পৌঁছানোর সময় তাদের হাতে কোনো রসিদ দেয় না।
অনেকের মতে যে ট্রাকে করে আমদানিকারক পেঁয়াজ আড়তদারদের কাছে পাঠায়, তারা বিক্রি করে ওই ট্রাকে করেই টাকা পাঠায়। তারা জানে না কে আমদানিকারক ও কত টাকা আমদানি মূল্য। আবার অনেকে আমদানিকারকদের কাছে টাকা পাঠায়; কিন্তু নাম-ঠিকানা জানে না। বিষয়টি অনেকটাই অদৃশ্য ব্যবসার মতো। পেঁয়াজ আমদানিকারক, আড়তদার ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের এ ধরনের অদৃশ্য ব্যবসাকে একটি কাঠামোর মধ্যে না আনা হলে কৃত্রিম সংকটের এ সিন্ডিকেট প্রথা ভাঙা সম্ভব হবে না।
মজার ব্যাপার হল, টেকনাফ দিয়ে মিয়ানমার থেকে আমদানিকৃত পেঁয়াজের আমদানি মূল্য ৪২ টাকা হলেও এর পাইকারি মূল্য ৯০-১০০ টাকা। ব্যবসায়ীরা তাদের গোমর ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়ে পেপারলেস এ ধরনের কারসাজিতে লিপ্ত।
বাজার তদারকিতে চলমান অভিযানটিকে অনেকেই লোকদেখানো ও দায়সারা গোছের বলছেন। কারণ বর্তমান বাজার তদারকিতে দেখা যাচ্ছে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বাজারে পর্যাপ্ত সময় দিচ্ছেন না, প্রশাসনের নানাবিধ কাজে জড়িত থাকায় বাজারে বিস্তারিত খোঁজখবর নিয়ে অভিযান পরিচালনার সময় তার থাকে না। ফলে অনেকটাই দায়সারাভাবে দায়িত্ব পালন করে কাজ শেষ করতে চান অনেকে।
আবার মোবাইল কোর্ট আইন বা অন্য আইনগুলোতেও বলা আছে ফলোআপ করার কথা। অর্থাৎ আজ যে অপরাধের জন্য একজন ব্যবসায়ীকে জরিমানা করা হচ্ছে তাকে পর্যবেক্ষণে রাখা- সে পরবর্তী সময়ে কী করছে? ব্যবসায়ীরা অনেক সময় মোবাইল কোর্টে জরিমানা দিতে আগ্রহী, কারণ তারা বিশ্বাস করে, যদি আজকে জরিমানা প্রদান করা হয়, তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট তার দোকানে এক মাস আসবে না। ফলে সে আবারও বেপরোয়া হয়ে অপরাধ সংঘটনে লিপ্ত হতে পারবে।
কাজেই সমন্বিত বাজার তদারকির মতো সরকারের অনেক উদ্ভাবনী উদ্যোগের সুফল তৃণমূল পর্যায়ের মানুষ পাচ্ছে না। অন্যদিকে যে যেভাবে পারে লুটপাট করছে, জনগণের পকেট কাটছে। প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন এক্ষেত্রে নীরব দর্শক। বাজার নিয়ন্ত্রণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বিভাগীয় ও জেলা প্রশাসনের নানা সভার সিদ্ধান্ত শোনা গেলেও এর কার্যকারিতা কতটুকু, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
এসএম নাজের হোসাইন : ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)
cabbd.nayer@gmail.com