শিক্ষকের মর্যাদা আর কতভাবে ভূলুণ্ঠিত হবে?
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০১৯, ০১:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রাজশাহী সরকারি পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের অধ্যক্ষকে লাঞ্ছিতের পর পানিতে ফেলে দিল ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। (ইনসেটে) অধ্যক্ষ ফরিদ উদ্দিন। ছবি-সংগৃহীত
রাজশাহী পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের অধ্যক্ষ ফরিদ উদ্দীন আহম্মেদকে টেনেহিঁচড়ে পুকুরে ফেলে দেয়ার ঘটনায় সচেতন শিক্ষক মহলের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে- আর কতভাবে শিক্ষকের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করা হবে? ২ নভেম্বর দুপুরে অধ্যক্ষ ফরিদ উদ্দীন আহম্মেদকে টেনেহিঁচড়ে পুকুরে ফেলে দেয়ার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটে।
আর এ ধরনের ঘৃণ্য ঘটনার জন্য ওই ইন্সটিটিউটের ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী দায়ী বলে অভিযোগ রয়েছে। ঘটনার শিকার অধ্যক্ষ গণমাধ্যমের কাছে অভিযোগ করেছেন, অন্যায় দাবি না মানায় ক্ষুব্ধ হয়ে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা এ কাজ করেছে।
ক্লাসে উপস্থিতি কম থাকা দু’জন শিক্ষার্থী ফরম পূরণ করতে না পারায় ওইদিন প্রথমে ওই অধ্যক্ষের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় লিপ্ত হয়। ওইদিন দুপুরে অধ্যক্ষ ফরিদ উদ্দীন আহম্মেদ নামাজ শেষে মসজিদ থেকে কার্যালয়ে ফেরার সময় ১০-১২ জন তরুণ ওই অধ্যক্ষের হাত ধরে টেনে ও ধাক্কা দিয়ে রাস্তার পাশে পুকুরে ফেলে দেয়। পরে কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষার্থী অধ্যক্ষকে পুকুর থেকে তোলেন।
শিক্ষকের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করার ঘটনা দেশে এটিই প্রথম নয়। এর আগে নারায়ণগঞ্জে এক শিক্ষকের মর্যাদা প্রকাশ্য দিবালোকে ভূলুণ্ঠিত করা হয়, যা ছিল বহুল আলোচিত ও নিন্দিত ঘটনা। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে শিক্ষক হত্যাসহ হামলা, লাঞ্ছনার বেশিরভাগ ঘটনারই বিচার হয়নি।
যেমন- ২০১৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের বাসে ছাত্রশিবিরের সন্ত্রাসীরা ককটেল হামলা চালিয়ে ১২ শিক্ষককে আহত করার ঘটনা; ২০১৩ সালের ১০ জানুয়ারি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষকদের ওপর ছাত্রলীগের ‘বহিরাগত’ কর্মীর হামলায় দুই শিক্ষক আহত হওয়ার ঘটনা; এর একদিন পর ১২ জানুয়ারি কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ নামধারীরা বহিরাগতদের সঙ্গে নিয়ে ফিল্মি স্টাইলে শিক্ষক লাউঞ্জে ঢুকে ইটপাটকেল ছুঁড়ে ২০ শিক্ষককে আহত হওয়ার ঘটনা ইত্যাদি।
শুধু শিক্ষকদের লাঞ্ছনা করাই নয়, দেশে শিক্ষকদের হত্যা করতেও দ্বিধাবোধ করা হয় না। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে গত একযুগে চারজন শিক্ষককে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে; আর এসব হত্যাকাণ্ডে বিশ্ববিদ্যালয়েরই কতিপয় শিক্ষার্থীর যোগসাজশ ছিল; যা আদালতের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে।
কবি কাজী কাদের নেওয়াজ রচিত ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ নামক কবিতার বিষয়বস্তু হল এরকম- দিল্লির এক মৌলভী (শিক্ষক) বাদশাহ আলমগীরের পুত্রকে পড়াতেন। একদিন প্রভাতে বাদশাহ লক্ষ করলেন, তার পুত্র ওই শিক্ষকের পায়ে পানি ঢালছেন আর শিক্ষক তার পা নিজেই পরিষ্কার করছেন।
এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করার পর বাদশাহ দূত মারফত ওই শিক্ষককে ডেকে নিয়ে যান। তারপর বাদশাহ ওই শিক্ষককে বলেন, ‘আমার পুত্র আপনার নিকট থেকে তো সৌজন্য না শিখে বেয়াদবি আর গুরুজনের প্রতি অবহেলা করা শিখেছে। কারণ; সেদিন প্রভাতে দেখলাম, আমার পুত্র শুধু আপনার পায়ে পানি ঢেলে দিচ্ছে আর আপনি নিজেই আপনার পা পরিষ্কার করছিলেন। আমার পুত্র কেন পানি ঢালার পাশাপাশি আপনার পা ধুয়ে দিল না- এ কথা স্মরণ করলে মনে ব্যথা পাই।’
বাদশাহের মুখ থেকে এ কথা শোনার পর ওই শিক্ষক অত্যন্ত উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বলে উঠলেন, ‘আজ হতে চির উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির; সত্যিই তুমি মহান, উদার, বাদশাহ্ আলমগীর।’
আগের যুগে সমাজে শিক্ষকের মর্যাদা যে কত উঁচুস্তরে ছিল, তা ওই কবিতার মাধ্যমে অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। কিছুকাল আগেও আমাদের দেশে ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ কবিতাটিকেই অভিভাবকরা ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের আদর্শ রূপ বলে মনে করতেন।
আর এখনকার দিনে শিক্ষার্থী কর্তৃক শিক্ষকের ওপর হামলা চালানো, তাদের হুমকি দেয়া ও হত্যা করা এবং লাঞ্ছনা করার ঘটনা যেন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর পেছনে ক্ষমতা ও স্বার্থকেন্দ্রিক নোংরা রাজনীতিই যে দায়ী, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
অবশ্য আমাদের সমাজের সব শিক্ষকই ধোয়া তুলসী পাতা নয়। অনেক শিক্ষকের বিরুদ্ধেই অনিয়ম-দুর্নীতি, যৌন হয়রানি, শিক্ষার্থীদের ক্লাসে সঠিকভাবে না পড়িয়ে প্রাইভেট বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত থাকা, নিয়মিতভাবে ক্লাস না নেয়া, সঠিক সময়ে খাতা না দেখা ও ফলাফল প্রকাশ না করে শিক্ষার্থীদের সেশনজটে ফেলা, মাদক গ্রহণ, শিক্ষার্থীকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা, রাজনৈতিক বিবেচনায় শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নপূর্বক অনেক শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন নষ্ট করাসহ বিভিন্ন সময়ে নানা অভিযোগ পাওয়া যায়।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীর পরস্পরের প্রতি এ ধরনের বিষয়গুলো নিঃসন্দেহে লজ্জার। আর এ লজ্জা যে গোটা জাতির লজ্জা, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক নিয়ে এডুকেশন ওয়াচ কর্তৃক প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থী এখন আর শিক্ষকদের আদর্শ মনে করে না।’
প্রকাশিত ওই রিপোর্ট থেকে জানা যায়, এখানে মতামত শুধু শিক্ষার্থীরাই দেননি, মতামত প্রদানের ক্ষেত্রে যুক্ত ছিলেন শিক্ষার্থীদের অভিভাবক এবং অনেক শিক্ষকও। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক নিয়ে এ ধরনের গবেষণা এবং রিপোর্ট আমাদের দেশের শিক্ষাপদ্ধতি এবং শিক্ষাব্যবস্থা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
কারণ, এ ধরনের গবেষণা এবং রিপোর্টের মাধ্যমে আমাদের দেশে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের বিষয়ে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। সত্যি বলতে কী, এখনকার অধিকাংশ শিক্ষার্থীই শিক্ষকদের আদেশ-উপদেশ পূর্ববর্তী সময়ের মতো মেনে চলে না, মেনে চলতে চায় না। যদিও এর পেছনে অনেক কারণ রয়েছে।
এখনকার অধিকাংশ শিক্ষার্থীই বেশি ক্লাস করতে বা বেশি পড়তে আগ্রহী নয়। কম ক্লাস নেয়া, কম পড়ানো আর বেশি নম্বর দেয়া শিক্ষকরাই যেন আজ অধিকাংশ শিক্ষার্থীর কাছে ‘জনপ্রিয়’ শিক্ষক হয়ে ওঠেন। যেসব শিক্ষক এ অবস্থার বিপরীতে চলেন, অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের কাছে তারা হয়ে ওঠেন চরম যন্ত্রণাদায়ক এবং চরম অপছন্দের মানুষ।
একটা সময় যখন বেতন খুবই কম ছিল, তখন শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীরা আসতেন না বললেই চলে। তখন একটি প্রবাদ প্রচলিত ছিল ‘যার নাই কোনো গতি, তিনি করেন পণ্ডিতি’। তবে শিক্ষকতা সম্মানিত পেশা হওয়ায় সেবার ব্রত নিয়ে অনেক সম্মানী লোক আগ্রহ করে আসতেন, যারা টাকা উপার্জনকে গুরুত্ব না দিয়ে সমাজের সম্মানী পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকে বেছে নিয়েছিলেন।
একটা সময় মহৎ পেশা হিসেবে গর্ব করে বলা হতো- আমি শিক্ষকতা করি। এখনও সবচেয়ে সম্মানের পেশা শিক্ষকতা হলেও এ মহৎ পেশাটাকে তথাকথিত রাজনীতি আর কিছুসংখ্যক সুবিধাভোগী শিক্ষক নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে এ মহৎ পেশার গায়ে কালিমা লেপন করছেন, যা মোটেই কাম্য নয়।
সদাচরণ, গুরুভক্তি, বড়দের সম্মান করা ইত্যাদি বিষয়গুলো একটা সময় আদর্শ ছাত্রের বৈশিষ্ট্য ছিল। কিন্তু আজ বাস্তবতা ভিন্ন। এজন্য অবশ্য অনেক শিক্ষকও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দায়ী। যখন কোনো শিক্ষক পরীক্ষার হলে শিক্ষার্থীদের নকল সরবরাহ করেন তখন ছাত্রছাত্রীদের কাছে ওই শিক্ষকের মর্যাদা থাকে না।
আজকাল ইন্টারনেট, ফেসবুক, মাদক, ইভটিজিং ইত্যাদি বিষয়গুলো যেন শিক্ষার্থীসহ কিশোর ও যুব সমাজকে শেষ করে দিচ্ছে। এখন নীতি-নৈতিকতা যেন ছাত্রজীবন থেকে বিলীন হতে চলছে।
স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেমেয়ের হাতে পিতামাতার নিগৃহীত ও নির্যাতনের শিকার হওয়া, এমনকি খুন পর্যন্ত হওয়া (যেমন ঐশী) সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে সমাজ ব্যবস্থা পাল্টেছে; প্রায়ই শিক্ষকদের অপমান করে এক শ্রেণির শিক্ষার্থী (বিশেষ করে যারা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত) নিজেদের হিরো মনে করে।
শিক্ষাকে বলা হয়, জাতির মেরুদণ্ড আর শিক্ষকদের বলা হয়, জাতি গঠনের কারিগর। তাহলে উপরোক্ত ঘটনাগুলো নিশ্চয় জাতির মেরুদণ্ড এবং জাতির কারিগরের ওপর চরম আঘাত। একটি সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশ এভাবে চলতে পারে না।
বিষয়গুলো শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসিসহ সংশ্লিষ্ট সবারই গুরুত্ব সহকারে ভেবে দেখা প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে, পৃথিবীতে যারা বিখ্যাত হয়েছেন, প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন; যাদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে (যেমন- অ্যারিস্টটল, সক্রেটিস, প্লেটো প্রমুখ), তাদের প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পেছনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে মাতাপিতার প্রতি দায়িত্বশীলতা এবং শিক্ষাগুরুর (শিক্ষক) প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া।
এ কথা সত্য, এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের মধ্যে ফারাক থাকবে এবং কথাবার্তা, চিন্তা-ভাবনা, চলনে-বলনে তার প্রকাশ ঘটবে এবং এটাই স্বাভাবিক। তবে আমাদের দেশে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের বর্তমান পরিস্থিতিতে দুই প্রজন্মেরই চলমান অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন।
শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের নিজেদের সমালোচনার পরিবেশ-পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে। কারণ, ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যকার সুসম্পর্কই কেবল পারে আমাদের পুরো শিক্ষাব্যবস্থার অহসহনীয় এবং অস্বস্তিকর বিষয়গুলোকে উপড়ে ফেলতে।
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সদস্য
kekbabu@yahoo.com