Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

জাতি হিসেবে আমরা কোথায় যাচ্ছি?

Icon

ড. ফাদার হেমন্ত পিউস রোজারিও

প্রকাশ: ০৫ নভেম্বর ২০১৯, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

জাতি হিসেবে আমরা কোথায় যাচ্ছি?

আবরার ফাহাদ। ফাইল ছবি

প্রকৃতিপ্রেমী কবি জীবনানন্দ দাশ যান্ত্রিক সভ্যতার বীভৎসতা আর নিষ্ঠুরতা প্রত্যক্ষ করে এক অবক্ষয়িত যুগে বসে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, সাম্রাজ্য-রাজ্য-সিংহাসন-জয় মৃত্যুর মতো নয়। আর তাই তিনি অবক্ষয়িত যুগের কাছে প্রার্থনা করে বলেছিলেন, ‘মৃত্যুর মতন শান্তি চাই’।

কিন্তু হায়! এ একবিংশ শতকে এসে এক স্বাধীন বাংলাদেশে বাস করে শান্তিতে মৃত্যুবরণ করার আকুতিই যেন দেশের সর্বত্র প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ঘটনা, দুর্ঘটনা আর তুচ্ছ ঘটনায় মানুষের বীভৎস মৃত্যু আমাদের কোমল অনুভূতিকে বিধ্বস্ত করে দিয়ে চেতনাশূন্য করে তুলছে।

সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের মৃত্যুর ঘটনা দেশের প্রতিটি হৃদয়বান মানুষের অনুভূতির গভীরে নাড়া দিয়েছে। সামান্য একটা ফেসবুক স্ট্যাটাস দেয়ার কারণে অথবা ভিন্নমত পোষণ করার কারণে বুয়েটের মতো জায়গায় এমন একজন মেধাবী ছাত্রকে এভাবে প্রাণ বিসর্জন দিতে হবে এটি কেউ কল্পনা করতে পারেনি।

স্বভাবতই আবরার হত্যা আমাদের সামনে একটি নতুন ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছে। জাতি হিসেবে আমরা কোথায় আছি এবং আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের গন্তব্য কোন অভিমুখে ধাবিত হচ্ছে তার স্বরূপ বিশ্লেষণ করার সময় এসেছে।

আবরারের সঙ্গে আমার একটা নিবিড় ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এ সম্পর্কটি পিতা-পুত্রের সম্পর্কের অনুরূপ। কারণ আবরার একজন মেধাবী ছাত্র হিসেবে নটর ডেম কলেজে ভর্তি হয়। আর অধ্যক্ষ হিসেবে কলেজের সাবেক-বর্তমান সব ছাত্রকেই আমি পুত্রজ্ঞান করি।

সেই দিক থেকে আবরার হত্যার ঘটনা আর দশজন মানুষের থেকে আমার অনুভূতিতে বেশি নাড়া দিয়েছে এবং আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেক বেশি কষ্ট পেয়েছি। সত্যি কথা বলতে কী, এ কষ্টের মাত্রা আরও শতগুণ বেড়ে গিয়েছে- যখন বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে জানতে পারি, আবরার হত্যায় অভিযুক্তদের মধ্যে কয়েকজন নটর ডেম কলেজেরই সাবেক শিক্ষার্থী।

আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি আবরার নিঃসন্দেহে একজন মেধাবী, মার্জিত ও ভদ্র ছেলে হিসেবে কলেজ জীবন শেষ করেছে। কলেজ জীবনে তার বিরুদ্ধে একটি অভিযোগও আমাদের কাছে আসেনি। অর্থাৎ আবরার যে আদ্যোপান্ত একজন সজ্জন ও ভদ্র ছাত্র ছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

কিন্তু দুঃখের বিষয় হল- নটর ডেম কলেজের যেসব শিক্ষার্থী আবরার হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত তারাও প্রত্যেকে কলেজের নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলত এবং তারা প্রত্যেকেই মেধার স্বাক্ষর রেখে বুয়েটে ভর্তি হয়েছে। কিন্তু কয়েক বছরের ব্যবধানে তাদের জীবনে কী এমন ঘটনা ঘটল যে, তারা এমন একটি বীভৎস ঘটনার জন্ম দিল!

এ কোমলমতি ছেলেদের দানব আর ঘাতক হিসেবে দেখতে হল। ব্যক্তিস্বার্থ আর অপরাধ করার পর নিশ্চিতভাবে দায়মুক্তির নিশ্চয়তাই কি তাদের এ দানবে পরিণত করল? যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে এখানে ভাববার বিষয় রয়েছে।

আরেকটি প্রশ্ন আমার অনুভূতিকে আন্দোলিত করে তুলেছে, সেটি হল- বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের মতো জায়গায় যেখানে শত শত শিক্ষার্থী একসঙ্গে বসবাস করে, সেখানে ২০-২৫ জন যুবক একটি কক্ষে অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় ছয় ঘণ্টা ধরে ধীরে-সুস্থে আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করল।

এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যে একজন যুবকের মধ্যেও কি মানবিক বোধ জাগ্রত হয়নি? ব্যক্তিস্বার্থ কি আমাদের দিন দিন বর্বর অমানুষে পরিণত করছে? এ দীর্ঘ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যে দায়-দায়িত্বের পরিচয় দিয়েছে তা-ও প্রশ্নবিদ্ধ।

এ ঘটনার পশ্চাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ভূমিকা কিংবা আরও অসংখ্য কারণ নিয়ে তাত্ত্বিকভাবে বিচার-বিশ্লেষণ অনেকেই করছেন ও করবেন; কিন্তু আবরারসহ এই যে ২০-২৫ জন মেধাবী ছেলের জীবন ধ্বংস হয়ে গেল, এতগুলো পরিবারের এক একটা জীবন্ত স্বপ্ন মুহূর্তের মধ্যেই ধ্বংস হয়ে গেল সেই বিষয়টিই আমাকে ভাবাচ্ছে বেশি।

সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষাঙ্গনগুলোতে দুটি মানসপ্রবণতা রীতিমতো উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। প্রথমটি হল ছাত্র রাজনীতির ভয়ংকর রূপ। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, পেশিশক্তির প্রদর্শন আর স্বার্থকেন্দ্রিক বিত্ত-বৈভবের মোহ ছাত্র রাজনীতিকে সমূলে কলুষিত করে ফেলেছে।

হলগুলোতে র‌্যাগিংয়ের নামে ছাত্র নির্যাতন কিংবা আবরার হত্যার মতো অনভিপ্রেত ঘটনার জন্ম হচ্ছে। অপরদিকে ছাত্রদের একটা বৃহৎ অংশ শুধু ফলাফলকেন্দ্রিক পড়ালেখার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। তারা যে কোনো উপায়ে ভালো ফল করে একটা ভালো চাকরি প্রাপ্তিকেই জীবনের কাঙ্ক্ষিত সাফল্য রূপে ধরে নিচ্ছে।

পদার্থ, রসায়ন, গণিত এমনকি বুয়েট-মেডিকেলের অনেক ছাত্র ম্যাজিস্ট্রেট, এসপি, ফরেন ক্যাডার হওয়ার বাসনায় বিভোর হয়ে বিসিএস পরীক্ষার পড়াশোনায় নিমগ্ন হয়ে পড়ছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনেকাংশে হয়ে পড়েছে চাকরি বিশেষত বিসিএস পরীক্ষার পড়ার কেন্দ্র। এ দুই ধারার ছাত্ররাই কিন্তু ব্যক্তিস্বার্থের চর্চা করছে।

একদল বৈধ উপায়ে আর এক দল অবৈধ উপায়ে। পার্থক্য শুধু এটুকুই। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যেখানে হওয়ার কথা ছিল গবেষণা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন ও সাহিত্য-শিল্প চর্চার কেন্দ্র- তা অনেকাংশে আড়ালেই থেকে যাচ্ছে।

এখন ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার যৌক্তিকতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠছে। কিন্তু ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করলেই যে সবকিছুর সমাধান হয়ে যাবে বিষয়টি তা নয়। কারণ ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে সফলতা এসেছে অনেকাংশে এ ছাত্র রাজনীতির হাত ধরেই।

পরবর্তী এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সফলতাও এসেছে ছাত্র রাজনীতির কল্যাণে। তখন ছাত্র রাজনীতি একটা নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে পরিচালিত হতো। এ নীতি ও আদর্শ ছিল দেশপ্রেমভিত্তিক। তখন ছাত্ররা জনগণের কণ্ঠস্বরের প্রতিনিধিত্ব করত। ছাত্র রাজনীতির পুনর্গঠন করতে হবে- নীতি ও আদর্শ সামনে রেখে।

আর এজন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকেই বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে হবে। তাহলে ছাত্ররা আবরারের মতো সহপাঠীকে হত্যা না করে দেশ ও জাতির কল্যাণে আত্মাহুতি দেয়ার শিক্ষা লাভ করবে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নৈতিক, মানবিক ও আধ্যাত্মিক চর্চার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। একজন শিক্ষার্থী নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের দ্বারা উজ্জীবিত না হলে তার মেধা দেশ, জাতি, সমাজ এবং পরিবারের কোনো কাজে আসবে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের রূপান্তর নিয়ে আসবে।

এ রূপান্তরের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীর মধ্যে একটি নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠবে। পূর্বস্থিত কিংবা বাইরে থেকে আরোপিত কোনো মতাদর্শ নয়, বরং সে যুক্তি, বুদ্ধি ও বিচার-বিশ্লেষণ দ্বারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে শিখবে এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণের কৌশল রপ্ত করবে।

আমার মতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো হল এক ধরনের উপাসনালয়- যেখানে শিক্ষার্থীরা সত্যের সাধনা করবে। বিচার-বুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার উপাসনা করবে। তারা শ্রেণিবিভেদ ভুলে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার অনুশীলন করবে।

আবুল ফজল, মোতাহের হোসেন চৌধুরী, কাজী মোতাহার হোসেনরা মুক্তবুদ্ধি চর্চার যে ধারা সৃষ্টি করে গেছেন, জ্ঞানের সেই আলোকশিখায় দেশের সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয় আলোকিত করতে হবে।

রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি ও সংকীর্ণ স্বার্থচিন্তা বাদ দিয়ে শিক্ষকদের ডিরোজিও’র মতো এ মশাল দণ্ড হাতে নিয়ে ছাত্রদের দিকনির্দেশনা দিতে হবে। তাহলে আবরারের মতো এক মেধাবী সন্তানকে হারানোর শোকের পরিবর্তে সমগ্র জাতি সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার কিংবা আসাদের মতো দেশপ্রেমিকদের নিয়ে বুক ফুলিয়ে কাঁদতে পারবে। আর এ আসাদদের উত্থান হোক ইতিবাচক ছাত্র রাজনীতির ভেতর থেকেই।

ড. ফাদার হেমন্ত পিউস রোজারিও, সিএসসি : অধ্যক্ষ, নটর ডেম কলেজ, ঢাকা

 

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম