Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

তৃতীয় মত

‘একতারা যাহাদের তারাও সম্মান যেন পায়’

Icon

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

প্রকাশ: ০৩ নভেম্বর ২০১৯, ০১:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

‘একতারা যাহাদের তারাও সম্মান যেন পায়’

গতকাল (৩ নভেম্বর, রবিবার) বাংলাদেশে জেলহত্যা দিবস পালিত হল। জাতি শ্রদ্ধাভরে শহীদ নেতাদের স্মরণ করেছে। কিন্তু গত ৪৪ বছরেও যা হয়নি, তা হল এই চার নেতার স্মৃতি যথাযোগ্য মর্যাদায় সংরক্ষণ এবং পাঠ্যপুস্তকে তাদের আদর্শ ও লক্ষ্যের কথা তুলে ধরে নতুন প্রজন্মের কাছে তাদের পরিচিত করা। এ কাজটি দেশে ভালোভাবে হয়নি।

সূর্য উঠলে যেমন দিনের আলোয় আকাশের নক্ষত্র, এমনকি চাঁদের আলোও চোখে পড়ে না, তেমনি বঙ্গবন্ধুর জীবন শত সূর্যের আলো হয়ে আমাদের চোখ এমনভাবে ধাঁধিয়ে রেখেছে যে, চার নেতা যদি চাঁদের বা নক্ষত্রের আলো হয়ে থাকেন, তা আমাদের চোখে পড়ে না। স্বাধীনতা দিবস এলে দেশের মানুষ তাদের প্রধান নায়ক বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করে উত্তাল হয়ে ওঠেন; আর একটি বিশেষ শ্রেণি খলনায়ক জিয়াকে বড় বানাতে ব্যর্থ চেষ্টায় মেতে ওঠে (ধীরে ধীরে এই খলনায়ক অস্তমিত হচ্ছেন), মাঝখানে স্বাধীনতার চারজন প্রকৃত কারিগর মেঘে ঢাকা তারা হয়ে থাকেন।

রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, সাহিত্যের ভোজসভায় বড় বড় মহারথীরা ঠাঁই পাবেনই, কিন্তু ‘একতারা যাহাদের তারাও সম্মান যেন পায়।’ আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে যেসব বীর নায়কের হাতে ছিল একতারা, তাদেরও সম্মান পাওয়া উচিত। চার জাতীয় নেতার ভাস্কর্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত, দেশের শিক্ষাঙ্গনে, অফিস-আদালতে। তরুণ প্রজন্মের কাছে তাদের জীবনকথা ও কীর্তি ভালোভাবে তুলে ধরা উচিত।

জেলের অভ্যন্তরে চার জাতীয় নেতাকে কেন হত্যা করা হল, কী উদ্দেশ্যে করা হল, কারা করল সেই রহস্য এখন পর্যন্ত ভালোভাবে উদ্ভাসিত হয়নি। এই ব্যাপারে জাতীয় পর্যায়ে ভালোভাবে তদন্ত চালিয়ে প্রকৃত অপরাধীদের বিচার ও শাস্তি এখন পর্যন্ত হয়নি, এটা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য। যেটুকু হয়েছে তাতে দায়সারা ব্যবস্থা বলা চলে।

এটা সব দেশে, সব বিপ্লবেই হয়। নব্যতুরস্কে কামাল আতাতুর্কের প্রখর ব্যক্তিত্বের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছেন আনোয়ার পাশা। রুশ বিপ্লবে লেনিনের নেতৃত্বের আলোর নিচে ঢাকা পড়ে গেছেন ট্রটস্কি। ইন্দোনেশিয়ায় সুকর্ণের নেতৃত্ব ঢেকে ফেলেছে সুলতান শাহ্রিয়ারকে। চীনে চুয়েন লাই বিস্মৃত হয়েছেন মাও জে দুংয়ের নামের আড়ালে। বাংলাদেশে তেমনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হিমালয়সম ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্ব ঢেকে ফেলেছে তাজউদ্দীনের নামকে।

এক্ষেত্রে ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের উচিত জাতীয় রাজনীতির এই বিস্মৃতপ্রায় বীরদের সঠিক জীবন ও কর্ম জাতির নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা এবং তাকে বিস্মৃত হতে না দেয়া। বাংলাদেশে চার জাতীয় নেতার হত্যাকাণ্ড, যা জেলহত্যাকাণ্ড হিসেবে পরিচিত, তা নিয়ে লেখালেখি কম হয়নি। এ বছরেও হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত তদন্ত, প্রকৃত গবেষণা, প্রকৃত তথ্য উদ্ধার এখনও হয়নি।

এসবের বদলে দেশে যা হয়েছে, তা নানা ধরনের থিয়োরি প্রচার। অনেকে সত্যের কাছাকাছি গিয়েছিলেন, কিন্তু আগ্রহ ও আন্তরিকতার অভাবে পূর্ণ সত্যে পৌঁছতে পারেননি। যেমন এ বছরেও ৩ নভেম্বর অভ্যুত্থানের পূর্বাপর সম্পর্কে গষেষণামূলক লেখা লিখতে গিয়ে এক কলামিস্ট লিখেছেন, ‘খালেদ (খালেদ মোশাররফ) ভারত-সোভিয়েত বলয়ের লোক ছিলেন।’ খালেদ ভারত-সোভিয়েত বলয়ের লোক হলে ক্ষমতা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে কেন চার জাতীয় নেতাকে মুক্তি দেননি? খন্দকার মোশতাককে কেন তৎক্ষণাৎ ক্ষমতা থেকে সরাননি?

লেখক নিজেই জানিয়েছেন, খালেদ তখন সেনাপ্রধান হতে ব্যস্ত ছিলেন। মোশতাককে ক্ষমতায় রেখে এবং জাতীয় নেতাদের জেলে রেখে এই নিয়ে দরকষাকষিতে ব্যস্ত ছিলেন। আমরাও জানি, তিনি কোনো শক্তি বলয়ের সমর্থন আদায়ের আগেই নিহত হন। খালেদ মোশাররফ ভারত-সোভিয়েত বলয়ের লোক হলে তাদের পরামর্শে ক্ষমতা গ্রহণ করে সঙ্গে সঙ্গে মোশতাককে পদচ্যুত ও গ্রেফতার করতেন। জিয়াউর রহমানকে তথাকথিত অন্তরীণ অবস্থা থেকে সরিয়ে এনে জেলে কঠোর পাহারায় রাখতেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রাক্কালে সম্পাদিত বাংলাদেশ-ভারত নিরাপত্তা চুক্তি অনুযায়ী অবিলম্বে ভারতের সাহায্য চাইতেন।

খালেদ কোনোটাই করেননি। তিনি মোশতাক-জিয়া গ্রুপ অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর কিলার গ্রুপের সঙ্গে সেনাপ্রধান হওয়ার দরকষাকষিতেই অমূল্য সময় নষ্ট করেছেন এবং নিহত হয়েছেন। দেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে সর্বাধিক নায়কোচিত বীরত্ব দেখিয়েছেন খালেদ মোশাররফ। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু জিয়াউর রহমানকে সামরিক বাহিনীতে প্রমোশন দিলেন, উপ-সামরিক প্রধান করলেন, এটা নিয়ে তার মনে ক্ষোভ ছিল। তিনি ঢাকা ক্লাবে ও অন্যত্র ‘চীনাপন্থী’ বলে পরিচিত হলিডের এনায়েতুল্লা খান ও তার বন্ধুদের সঙ্গে আসর জমাতে থাকেন। খালেদের প্রতিপক্ষ এর সুযোগ নেয়। তাজউদ্দীন সম্পর্কে তারা যেমন বঙ্গবন্ধুর কান ভারি করেছিল, খালেদ মোশাররফ সম্পর্কেও তাই করে।

আমি ইতিহাসবিদ নই, গবেষকও নই। তাই জীবনে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি তার ভিত্তিতেই লিখি। পাণ্ডিত্য দিয়ে লিখি না। যেহেতু মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগরে ছিলাম এবং মুক্তিযুদ্ধের নেতাদের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে ছিলাম, তাই এই সময়ের অনেক কথা জানি। ডিসেম্বর (’৭১) মাসে পাকিস্তানের হানাদার সেনারা যখন বুঝতে পারে তাদের পরাজয় আসন্ন, তখন তারা দুটি ভয়ংকর পরিকল্পনা গ্রহণ করে।

এক. জেলে বন্দি বঙ্গবন্ধুকে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে কনফেডারেশন গঠনে রাজি করানো। মুজিবনগর সরকারের মধ্যে মোশতাক গ্রুপকে এই পরিকল্পনায় রাজি করানো হয়। বঙ্গবন্ধুকে রাজি করানোর জন্য ইরানের শাহকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে পাকিস্তানে ডেকে আনা হয় (তখনকার বাজারি গুজব এবং অভিযোগ, পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে তাদের প্রস্তাবে রাজি করানোর জন্য ড. কামাল হোসেনকেও ব্যবহার করেছিল)।

দুই. বঙ্গবন্ধু তাদের পরিকল্পনায় সম্মত না হলে তাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে ফাঁসি দেয়া, ঢাকায় দ্বিতীয় দফা বুদ্ধিজীবী হত্যা এবং ভাড়া করা এসাসিনেটরদের দ্বারা মুজিবনগর সরকারের তাজউদ্দীন ও তার সমর্থকদের হত্যা করে বাংলাদেশকে সম্পূর্ণ নেতৃত্বহীন করা। পাকিস্তানের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর আশা ছিল, বাংলাদেশকে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক নেতৃত্বহীন করা গেলে, মোশতাকসহ যেসব পাকিস্তানপন্থী নেতা বেঁচে থাকবেন, কৌশলে তাদের দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার গঠন করা যাবে এবং নামে স্বাধীন হলেও বাংলাদেশকে পাকিস্তানের উপনিবেশ করে রাখা যাবে।

এই দুই পরিকল্পনার দুটি গোপন নামও দেয়া হয়েছিল, তা এখন আমার মনে নেই। মুজিবনগর সরকারের তাজউদ্দীনসহ তার সমর্থক ও সহযোগীদের মুজিবনগরে থাকাকালেই হত্যা করার প্লান করা হয়। তা ব্যর্থ হলে স্বাধীনতা লাভের সঙ্গে সঙ্গে এই নেতারা যখন ঢাকায় যাবেন, তখন প্রচণ্ড বিজয় উল্লাসের মধ্যে তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা যখন শিথিল থাকবে, তখনই এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো সহজ হবে বলে ধরা হয়।

এই পরিকল্পনা কীভাবে ভারতের ‘র’-এর হাতে পৌঁছে, তা আমার জানা নেই। তবে তাজউদ্দীন ভাইয়ের কাছ থেকেই জানতে পারি, পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের সঙ্গে সঙ্গে নেতারা দেশে যাচ্ছেন না। ভারত সরকার তাদের পূর্ণ নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। তাদের অনুরোধ এই নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার পরেই তারা যেন বাংলাদেশে যান। তাজউদ্দীন সাহেবরা ইন্দিরা গান্ধীর এই অনুরোধ রক্ষা করেন।

আমার ধারণা, জেনারেল ওসমানীও তার এই নিরাপত্তার অনিশ্চয়তায় দরুন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানের হানাদার সেনাদের আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠানে যাননি। তখন তার স্থলে ভাইস অ্যাডমিরাল এ আর খানকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। তিনিও প্রথমে যেতে চাচ্ছিলেন না। অনেক অনুরোধ করে তাকে ঢাকাগামী হেলিকপ্টারে চড়ানো হয়। তাকে ঢাকায় পাঠানোর উদ্যোগে শরিক ছিলেন পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলার শিপিং কর্পোরেশনের সাবেক চেয়ারম্যান ক্যাপ্টেন রহমান। তিনি এখনও বেঁচে আছেন। কেন মুখ খুলছেন না তা আমি জানি না।

বাংলাদেশের জাতীয় নেতাদের এই যে হত্যা পরিকল্পনা, এর বাস্তবায়ন তখন সম্ভব হয়নি, সম্ভব হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এবং নভেম্বরে জেল হত্যাকাণ্ডে। ’৭১-এর ষড়যন্ত্রকারী জিয়া-মোশতাক চক্র দ্বারাই এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়। মোশতাক থেকে জিয়াউর রহমান, এরশাদ ও খালেদা জিয়া- এদের দীর্ঘ একুশ বছরের শাসনকালে প্রকৃতপক্ষে চলে পাকিস্তানের পরোক্ষ ঔপনিবেশিক শাসন।

সুতরাং ’৭৫-এর আগস্ট ও নভেম্বরের হত্যাকাণ্ড, ৭ নভেম্বরের তথাকথিত সেনা-জনতার বিপ্লব কেবল সেনা-কোন্দলজাত বা কেবল রাজনীতিকদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে রাখার সামরিক ষড়যন্ত্র নয়, এর পেছনে ছিল তখনকার চীন, আমেরিকা, পাকিস্তান ও সৌদি আরবের মিলিত চক্রান্তের সঙ্গে দেশের মক্স অ্যান্ড মিলিটারি এক্সিসের মিতালি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস জানতে হলে এই ষড়যন্ত্রের ইতিহাস এবং তার বহমান বর্তমান ধারা সম্পর্কে জানতে হবে। চার শহীদ নেতা তাই আমাদের জাতীয় জীবনে আরও বেশি করে স্মরণীয় এবং বরণীয়।

লন্ডন ৩ নভেম্বর, রবিবার, ২০১৯

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম