সানোফি ও গ্লাক্সো ব্যবসা গুটিয়ে চলে গেল কেন
ড. মুনীরউদ্দিন আহমদ
প্রকাশ: ০১ নভেম্বর ২০১৯, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফ্রান্সের বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানি সানোফি-অ্যাভেন্টিস বাংলাদেশে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে দেশত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সানোফি-অ্যাভেন্টিস পৃথিবীর ৫ম বৃহত্তম ওষুধ কোম্পানি। এর আগে দেশ ছাড়ল বিশ্ববিখ্যাত ব্রিটিশ কোম্পানি গ্লাক্সো স্মিথক্লাইন। ২০০০ সালে গ্লাক্সো ওয়েলকাম স্মিথক্লাইন বিচামের সঙ্গে একীভূত হয়ে গঠন করে গ্লাক্সো স্মিথক্লাইন বিচাম।
গ্লাক্সো স্মিথক্লাইন বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম কোম্পানি। তল্পিতল্পা গুটিয়ে এ দুটি প্রসিদ্ধ বহুজাতিক কোম্পানির দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার ঘটনাকে অনেক বিশেষজ্ঞ স্বাভাবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন না। অজ্ঞাত কারণে এভাবে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো দেশ ছেড়ে চলে গেলে বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগ ব্যবস্থায় অনাস্থা ও আতঙ্কের সৃষ্টি হবে।
বিসিআইসির ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিরা অনেক চেষ্টা করেও কোম্পানিগুলোর দেশত্যাগের আসল বিস্তারিত কারণ জানতে পারেননি। কোম্পানির পক্ষ থেকে শুধু বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বাজার ব্যবসার জন্য উপযোগী নয়। সরকারের শীর্ষস্থানীয় নীতিনির্ধারকদের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে খতিয়ে দেখার আহ্বান জানাচ্ছি।
বলার অপেক্ষা রাখে না, বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিগুলো ব্যতিক্রম ছাড়া গুণগত মানসম্পন্ন ওষুধ তৈরি করে। ওষুধের কাঁচামাল থেকে শুরু করে ওষুধ উৎপাদন, প্যাকেজিং, বিপণন- সব ক্ষেত্রে তারা একটি আন্তর্জাতিক নিয়ম-কানুন ও নীতিমালা অনুসরণ করে। দাম বেশি হলেও এ প্রক্রিয়ায় ওষুধের গুণগত মান নিশ্চিত হয়। বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিগুলোর দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পেছনে অনেক দৃশ্যমান কারণ রয়েছে।
প্রথমত, বাংলাদেশের ওষুধের বাজার ভীষণ প্রতিযোগিতামূলক হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি কোম্পানির মধ্যে ওষুধের বাজার সম্প্রসারণ ও প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার প্রাণপণ লড়াই চলছে। এ কোম্পানিগুলোর উৎপাদন বৃদ্ধির হার দুই অঙ্কের উপরে। বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় দশটি কোম্পানির মধ্যে সানোফি-অ্যাভেন্টিস ও গ্লাক্সো স্মিথক্লাইন নেই। দেশে পুঁজি বিনিয়োগের পরিবেশ সাবলীল হলেও বিদেশি কোম্পানিগুলোর অর্জিত মুনাফা স্থানান্তরে ব্যাপক প্রক্রিয়াগত ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা রয়েছে। সে কারণে বিদেশি কোম্পানিগুলো নিজ দেশে অর্জিত মুনাফা স্থানান্তর করতে সমস্যার সম্মুখীন হয়। সম্ভবত বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার অনেক কারণের মধ্যে এটি একটি।
তবে আমার ধারণা, সেটি আসল কারণ নয়। বাংলাদেশে গুণগত মানসম্পন্ন ওষুধ উৎপাদন মুনাফার একমাত্র উপকরণ নয়। এখানে উৎপাদিত ওষুধ বিপণনে বা প্রমোশনে যে যত বেশি টাকা ঢালতে পারবে, তার ওষুধের কাটতি তত বাড়বে, মুনাফা আসবে স্রোতের মতো। ওষুধের কাটতি ও মুনাফার হার বৃদ্ধির প্রধান হাতিয়ার হল আমাদের সম্মানিত চিকিৎসক ও ওষুধ বিক্রেতা বা ড্রাগ স্টোরগুলো। দেশীয় ওষুধ কোম্পানিগুলোর অ্যাগ্রেসিভ ওষুধ বিপণন বা প্রমোশনে চিকিৎসকের পেছনে টাকা ঢালার ক্ষেত্রে সানোফি-অ্যাভেন্টিস ও গ্লাক্সো স্মিথক্লাইনের মতো বিদেশি কোম্পানিগুলো টেক্কা দিয়ে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারেনি।
আর ওষুধ প্রমোশনে এ রকম নোংরাভাবে কমিশন বাণিজ্যে শামিল হওয়া সানোফি-অ্যাভেন্টিস ও গ্লাক্সো স্মিথক্লাইনের নৈতিকতা ও মূল্যবোধের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক বলে আমার ধারণা। আর এ দেশে আমাদের জন্য নৈতিকতা ও মূল্যবোধের ব্যাপারটি ব্যবসায় তেমন মুখ্য ভূমিকা পালন করে না।
১৯৮২ সালে জাতীয় ওষুধনীতি প্রণীত ও ঘোষিত হওয়ার পর বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিগুলো কিছুটা বেকায়দায় পড়ে যায়। কারণ সেই ওষুধনীতিতে দেশীয় কোম্পানিগুলোকে কিছু বাড়তি সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হয়, যা বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিগুলোকে দেয়া হয়নি। ১৯৮২ সালের জাতীয় ওষুধনীতিতে বলা হয়েছিল, সাধারণ ব্যথানাশক, ভিটামিন, অ্যান্টাসিড ধরনের সহজে উৎপাদনশীল ওষুধগুলো উৎপাদনের অনুমতি বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিগুলোকে দেয়া হবে না।
এ ধরনের ওষুধ উৎপাদনের একচ্ছত্র অধিকার দেয়া হবে দেশীয় কোম্পানিগুলোকে। দেশীয় কোম্পানিগুলোর চেয়ে বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিগুলো বহুল ব্যবহৃত অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও মুনাফার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ার এটাও একটা কারণ হতে পারে।
ওষুধ প্রশাসনের এক সাবেক পরিচালকের তথ্য মোতাবেক, দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো তাদের মোট বিক্রির দশ শতাংশ অর্থ চিকিৎসকদের ঘুষ বা কমিশন দেয়া বাবদ ব্যয় করে। ২০১৫ সালে দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলোর মোট ওষুধ বিক্রির পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। মোট বিক্রির ১০ শতাংশ হিসাবে প্রদত্ত কমিশনের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৫০০ কোটি টাকা। চিকিৎসকদের বিভিন্নভাবে কমিশন দেয় ওষুধ কোম্পানিগুলো।
মজার ব্যাপার হল, চিকিৎসকরা ওষুধ কোম্পানি থেকে কমিশন পেলেও কোম্পানিগুলো কমিশন বাবদ প্রদত্ত সব টাকা তুলে নেয় মানুষের পকেট থেকে। চিকিৎসকরা শুধু ওষুধ কোম্পানি থেকেই কমিশন নেন না, তারা ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো থেকেও মোটা অঙ্কের কমিশন পেয়ে থাকেন। আর এ কারণেই প্রায় সব চিকিৎসক রোগীকে অসংখ্য অপ্রয়োজনীয় ডায়াগনস্টিক টেস্টের পরামর্শ দিয়ে থাকে। কোনো কোনো ডায়াগনস্টিক টেস্টের পেছনে অসহায় দরিদ্র রোগীদের হাজার হাজার টাকা ব্যয় করতে হয়।
দুর্ভাগ্যজনক, চিকিৎসকদের এ ধরনের ঘুষ বা কমিশন বাণিজ্যের কারণে মানুষের চিকিৎসা ব্যয় দিন দিন বেড়েই চলেছে। তবে ঢালাওভাবে সব চিকিৎসকের ক্ষেত্রে এ ধরনের অভিযোগ প্রযোজ্য নয়। আমার জানাশোনা অনেক চিকিৎসক আছেন, যারা এ কমিশন বাণিজ্যকে সম্পূর্ণ অনৈতিক হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
ওষুধ কোম্পানিগুলোর অনৈতিক ওষুধ বিপণন বহুকাল ধরে জনস্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক অবস্থার সৃষ্টি করেছে। এ অনৈতিক ওষুধ বিপণনে চিকিৎসকদের পাশাপাশি সহায়ক শক্তির ভূমিকা পালন করে থাকে ওষুধ বিক্রেতা ও বিক্রয় প্রতিনিধিরা। আগেই বলেছি, ওষুধ বিপণনের উদ্দেশ্য যদি হয় স্রেফ মুনাফা তবে এর কারণে বড় ধরনের খেসারত দিতে হয় রোগীকে। বহু চিকিৎসক ওষুধ কোম্পানি কর্তৃক প্রতারিত হয়ে অনেক সময় সুস্থ মানুষকে রোগী বানিয়ে ওষুধ গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে।
আবার অনেক সুস্থ-সবল মানুষ ওষুধ কোম্পানির প্ররোচনায় পড়ে আরও বেশি সুস্থ, সবল ও সুন্দর জীবনের জন্য অপ্রয়োজনীয় ও অনেক ক্ষেত্রে ক্ষতিকর ওষুধ গ্রহণ করে। এসব ওষুধকে বলা হয় লাইফস্টাইল ড্রাগ। ফুড সাপ্লিমেন্ট, ভিটামিন, টনিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, স্থূলতা কমানোর ওষুধ, যৌন অক্ষমতা, মাথার টাক, মন চাঙ্গা করার ওষুধ এসব ড্রাগের অন্তর্ভুক্ত। দেশে ওষুধের বিজ্ঞাপনের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। বিজ্ঞাপন বৈধ হলে দেশে কোকাকোলা, পেপসি, হরলিকস, কমপ্লান বা ফেয়ার অ্যান্ড লাভলীর মতো দেদারসে ওষুধ বিক্রি হতো।
আমাদের মনে রাখা দরকার, ভোগ্যপণ্য আর ওষুধ এক জিনিস নয়। ভোগ্যপণ্য জীবনরক্ষাকারী অত্যাবশ্যকীয় বস্তু নয়। ওষুধ অত্যাবশ্যকীয় জীবন রক্ষাকারী বস্তু। সঠিক সময় সঠিক মাত্রায় সঠিক ওষুধটি প্রয়োগ না করলে কোনো কোনো অবস্থায় মানুষ মৃত্যুবরণ করতে পারে। মারাত্মক ও জটিল সংক্রামক রোগের কথাই ধরা যাক। জটিল সংক্রামক রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু ধ্বংসের জন্য আমাদের প্রয়োজন সঠিক মাত্রার গুণগত মানসম্পন্ন একদম সঠিক অ্যান্টিবায়োটিক।
অ্যান্টিবায়োটিক নির্বাচনে ভুল হলে রোগ ভালো হবে না, রোগীর ভোগান্তি বাড়বে, একসময় হয়তো রোগী মারাও যাবে। সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কোনো অবকাশ নেই। সংক্রামক রোগের ধরন যেমন ভিন্ন হয়, তেমনি অ্যান্টিবায়োটিকের ধরনও ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। তবে সব ক্ষেত্রেই উৎপাদকের জোরালো বিপণন ও চিকিৎসকদের অনৈতিক আচরণের কারণে অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার ও অপপ্রয়োগের মাত্রা অতীতের সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে।
শুধু ব্যবসায়িক কারণে আজকাল চিকিৎসকরা সাধারণ সংক্রামক রোগেও সস্তা ও ন্যারো স্পেকট্রাম অ্যান্টিবায়োটিকের (যেসব অ্যান্টিবায়োটিক বিস্তৃত পদের জীবাণুর বিরুদ্ধে কাজ করে না) পরিবর্তে নামিদামি ও পেটেন্টেড ব্রোড স্পেকট্রাম অ্যান্টিবায়োটিক রোগীকে প্রদান করছেন। কোনো কোনো সংক্রামক রোগে ন্যারো স্পেকট্রাম অ্যান্টিবায়োটিক কাজ না করলে ব্রোড স্পেকট্রাম অ্যান্টিবায়োটিক (যেসব অ্যান্টিবায়োটিক বিস্তৃত পদের জীবাণুর বিরুদ্ধে কাজ করে) প্রদান করে রোগ সারানোর সুযোগ থাকে।
কিন্তু রোগীকে শুরুতেই ব্রোড স্পেকট্রাম অ্যান্টিবায়োটিক প্রদান করা হলে এবং সে ওষুধ কাজ না করলে তখন হাতে আর কোনো বিকল্প থাকে না। সেজন্য আমরা বলে থাকি- কার্যকর ও অব্যর্থ অ্যান্টিবায়োটিকগুলো রোগীর দুঃসময়ের জন্য মজুদ রাখুন। কিন্তু চিকিৎসকরা অতি দ্রুত রোগ সারিয়ে রোগীর আস্থা ও সুনাম অর্জনের মাধ্যমে ব্যবসার প্রসার বাড়ানোর জন্য এবং কমিশন বাণিজ্যের কারণে অত্যন্ত দামি ও ব্রোড স্পেকট্রাম অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা শুরু করে থাকেন।
তারা খুব কমই ভাবেন ভুল ও নির্বিচার অপব্যবহারের কারণে জীবাণুর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট হয়ে গেলে শেষ সম্বল হিসেবে তারা কোন অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করবেন। ওষুধ কোম্পানিগুলোর আক্রমণাত্মক প্রমোশন, চিকিৎসকের অনৈতিক ও অবিবেচনাপ্রসূত প্রেসক্রাইবিং এবং রোগীর আত্মচিকিৎসায় নির্বিচারে ব্যবহারের কারণে ইতিমধ্যে বহু অ্যান্টিবায়োটিক জীবাণুর বিরুদ্ধে কার্যকারিতা হারিয়ে রেজিস্ট্যান্ট হয়ে গেছে। এটি মানবসভ্যতার জন্য একটি মারাত্মক দুঃসংবাদ।
ওষুধ কোম্পানিগুলো বাজারজাত করার সময় ওষুধের ওপর বিভিন্ন তথ্যাবলি দিয়ে লিফলেট বা আকর্ষণীয় ফোল্ডার প্রকাশ করে। ওষুধ বিক্রয় প্রতিনিধি এসব তথ্যসংবলিত কাগজপত্র চিকিৎসকদের মধ্যে বিলি করেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা এসব বিজ্ঞাপনের ফিরিস্তি পড়ার সময় ও সুযোগ পান না। বিক্রয় প্রতিনিধিরাই চিকিৎসকদের কাছে তাদের কোম্পানির ওষুধের গুণাবলি ও কার্যকারিতার ফিরিস্তি উপস্থাপন করেন। ওষুধের লিফলেট বা বিজ্ঞাপনে প্রায়ই অতিরঞ্জিতভাবে ওষুধের গুণাবলি তুলে ধরা হয়।
কার্যকর না হওয়া সত্ত্বেও কোনো কোনো রোগে ওষুধটি খুব ভালো কাজ করে বলে দাবি করা হয়। ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা বিষক্রিয়া সম্পর্কে খুব কমই লেখা থাকে, বলাও হয়ে থাকে অতি অল্প। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চিকিৎসকরা যাচাই-বাছাই না করেই এসব ওষুধ প্রেসক্রাইব করা শুরু করেন। এতে করে রোগী বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রথমত, ওষুধটি দামি হলে রোগীকে বেশি পয়সা ব্যয় করতে হয়, যেখানে সস্তায় একই মানের ওষুধ পাওয়া সম্ভব। দ্বিতীয়ত, সব কোম্পানির ওষুধের গুণগত মান সমান নয়।
অর্থ বা উপহারের বিনিময়ে চিকিৎসক গুণগত মান যাচাই না করে কোনো ওষুধ প্রেসক্রাইব করলে রোগী শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চিকিৎসাশাস্ত্র বিক্রয় প্রতিনিধি বা চিকিৎসকদের এসব অপকর্ম সমর্থন করে না; কিন্তু আমরা করি এবং অতিমাত্রায় করি। কারণ, বাংলাদেশে রোগ নির্ণয় থেকে শুরু করে চিকিৎসা, হাসপাতাল-ফার্মেসি, ওষুধ কেনাকাটা, আদান-প্রদান ও নিয়ন্ত্রণ- সবকিছুতেই চিকিৎসকদের একচেটিয়া রাজত্ব।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, রোগী চিকিৎসকের কাছে গেলে তারা প্রয়োজনীয় ওষুধের সঙ্গে প্রেসক্রিপশনে একাধিক অপ্রয়োজনীয় ওষুধ জুড়ে দেন। চিকিৎসকদের এ অনৈতিক মানসিকতার পেছনে যে বিষয়টি কাজ করে তা হল লোভ-লালসা এবং নিজের ব্যক্তিত্ব, মানবিকতা, নৈতিকতা, আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদাবোধের কাছে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে অধিক উপার্জনের মনোবৃত্তি। না হলে একজন চিকিৎসক কী করে একটি ওষুধ প্রেসক্রাইব করার বিনিময়ে ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে স্ত্রীর জন্য শাড়ি বা গহনা গ্রহণ করতে পারেন?
একটি পারফিউম বা ফুলদানির জন্য একজন অসহায় দরিদ্র সাধারণ মানুষ- যিনি অগাধ বিশ্বাস ও আস্থা নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যান সুচিকিৎসা পাওয়ার আশায়- তার ক্ষতি একজন চিকিৎসক কীভাবে করতে পারেন? বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে চিকিৎসকরা (সব চিকিৎসক নয়) যেসব উপঢৌকন পান, তার মধ্যে রয়েছে টাকা-পয়সা, বড় অঙ্কের টাকার চেক, গহনা, দামি কাপড়-চোপড়, পারফিউম, অফিস ভাড়া, অফিস ডেকোরেশনের খরচ, চেম্বারের জন্য প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র ও যন্ত্রপাতি, বিদেশ ভ্রমণের টিকিট, বিদেশে অবস্থানকালে হোটেল ভাড়া, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন, টেলিফোন, ফ্রিজ, টেলিভিশন, এয়ারকুলার ইত্যাদি।
আমার সামনে ঘটে যাওয়া আরও একটি ঘটনা উল্লেখ করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। বেশ কয়েক বছর আগে এক চিকিৎসক এক বিক্রয় প্রতিনিধির কাছ থেকে একটি ক্রিস্টাল ফুলদানি গ্রহণ করে সঙ্গে সঙ্গে সেই কোম্পানির লোসার্টান পটাসিয়ামের ব্র্যান্ড নামটি (উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ) লিখে দিলেন এক রোগীর প্রেসক্রিপশনে। আমি হতবাক হয়ে গেলাম। মজার ব্যাপার, সেই ওষুধের ব্র্যান্ড নামটিও চিকিৎসক জানতেন না! বিক্রয় প্রতিনিধির কাছ থেকে জেনে নামটি প্রেসক্রিপশনে লিখলেন।
উপরে উল্লেখিত লোভনীয় জিনিসপত্র ছাড়াও চিকিৎসকরা ওষুধ কোম্পানি থেকে ফ্রি স্যাম্পল হিসেবে অসংখ্য ওষুধ পেয়ে থাকেন। শোনা যায়, তারা এসব ওষুধ বিক্রি করে টাকা উপার্জন করেন। তবে কিছু চিকিৎসক গরিব রোগীদের এসব ওষুধ দান করেন বলেও শোনা যায়।
ওষুধ কোম্পানি, চিকিৎসক, বিক্রয় প্রতিনিধিদের এসব অনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ হওয়া দরকার। ওষুধ প্রমোশনে কোটি কোটি টাকা খরচের ভারটা রোগী বা ওষুধ ক্রেতাকেই বহন করতে হয়। এতে করে ওষুধের দাম আকাশচুম্বী হয়ে যাওয়ার ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। চিকিৎসকদের অজ্ঞতা, অবহেলা বা পড়াশোনার অভাবে নকল, ভেজাল ও ক্ষতিকর ওষুধও রোগীর হাতে পৌঁছে যায় ওষুধ কোম্পানি ও বিক্রয় প্রতিনিধিদের মাধ্যমে। এটি জনস্বাস্থ্যর জন্য এক বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।
ওষুধ কোম্পানি, চিকিৎসক ও বিক্রয় প্রতিনিধিদের এ অশুভ ও অনৈতিক তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। ভারতে এ ব্যাপারে সরকার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছে। কোনো চিকিৎসক উপহার নিলে তার চিকিৎসা সনদ বাতিল করার বিধান রাখা হচ্ছে বলে শুনেছি। যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ (ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে- ওষুধ বিজ্ঞাপনে ওষুধ কোম্পানিগুলো বছরে কত টাকা খরচ করে, তা প্রকাশ করতে হবে।
ভুতুড়ে লেখক দিয়ে কোনো ওষুধের ওপর প্রবন্ধ লেখা হয় কিনা, তা জানাতে হবে। এছাড়া গবেষণার নামে ওষুধ কোম্পানিগুলো চিকিৎসকদের কত টাকা প্রদান করেন, কনসালটেশন ফি বাবদ ব্যয় কত, যাতায়াত ও আপ্যায়নে কত খরচ হয়, তা প্রকাশের বাধ্যবাধকতা বহাল করার চিন্তাভাবনা চলছে।
অনৈতিক ওষুধ বিপণন বন্ধে সরকারের কোনো উদ্যোগ আছে বলে অতীতে দেখা যায়নি। দেশের পত্রপত্রিকায় এ ব্যাপারে অনেক প্রতিবেদন ও সম্পাদকীয়-উপসম্পাদকীয় ছাপা হয়েছে, প্রতিকারের উপায় উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। কিন্তু এ অরাজকতা বেশিদিন চলতে দেয়া যায় না। চিকিৎসা ব্যবস্থার বর্তমান পরিস্থিতি অনুধাবনপূর্বক সরকার জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হলে শুধু সানোফি-অ্যাভেন্টিস বা গ্লাক্সো স্মিথক্লাইনের মতো বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানি দেশ ছাড়বে না, ছোট-বড় দেশি কোম্পানিগুলোও কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ড. মুনীরউদ্দিন আহমদ : প্রফেসর, ফার্মেসি বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ঢাকা
drmuniruddin@gmail.com