
প্রিন্ট: ০১ মে ২০২৫, ০৫:৪৯ এএম
ছাত্র রাজনীতি: কোথায় আমাদের গন্তব্য

জিয়া আহমেদ
প্রকাশ: ১৭ অক্টোবর ২০১৯, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আবরার ফাহাদ। ছবি-ফেসবুক
আরও পড়ুন
বুয়েট দেশের প্রকৌশল শিক্ষায় সবচেয়ে নামি ও খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান। যে বুয়েট থেকে আবরারের প্রকৌশলী হয়ে বের হওয়ার কথা ছিল, সেখান থেকে তার মৃতদেহ নিয়ে আসতে হল।
চিরনিদ্রায় শায়িত আবরারের আত্মা হয়তো ধিক্কার দেবে, চিৎকার করে বলে উঠবে- কী দোষ ছিল আমার; আমরা কি এমন দেশ চেয়েছিলাম? কী উত্তর দেবেন আমাদের রাজনীতিকরা; যারা রাজনীতির কলকাঠি নাড়ান, ছাত্রসংগঠনগুলোকে ব্যবহার করেন এবং ফায়দা নেন।
ছাত্রসংগঠনগুলো ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। অনেক পালাবদল দেখেছি আমরা ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের, আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার সংখ্যাও কম নয়।
যে সংগঠনের এক সময় ঐতিহ্য ছিল, যে সংগঠন জন্ম দিয়েছে কয়েকশ’ তুখোড় নেতা; সেই সোনালি সংগঠনের আজ কেন এ দুরবস্থা- এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে বিষয়টির ভেতরে যেতে হবে। এক ধরনের অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে আমাদের সময়। মানবতাবোধ, বিবেকবোধ, আজ ধূলিসাৎ।
আওয়ামী লীগ সরকার দিনবদলের ইশতেহার নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল সেটা ভুলে গেলে চলবে না। দেশের মানুষ যখন চারদলীয় জোট সরকার ও হাওয়া ভবনের অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিল, তখনই দেশের জনগণ বর্তমান সরকারের পক্ষে রায় দিয়েছে।
সেই দিনবদলের ইশতেহার বাস্তবায়নের জন্য সরকারদলীয় অঙ্গসংগঠনগুলোর সহযোগিতা দরকার; আগ্রাসী মনোভাব নয়।
সময় এসেছে চিন্তা করে দেখার, বিগত ২০ বছরের ছাত্র রাজনীতি দেশের জন্য এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের জন্য কতটুকু সুফল এনেছে।
এখনকার ছাত্র রাজনীতি লেজুড়বৃত্তি, দলীয় ক্ষমতাবানদের হাতিয়ার হওয়া, চাঁদাবাজি কিংবা টেন্ডারবাজি ছাড়া তারা ছাত্রসমাজের জন্য কী কী মঙ্গলজনক কাজ করেছে- হিসাব করলে দেখা যাবে, হিসাবের খাতায় কিছুই নেই; বরং যখন ন্যায্য কোনো বিষয় নিয়ে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলনে নেমেছে, সেটাকে তারা প্রতিহত করেছে। হয়তো হাতেগোনা কয়েকজন নেতাকর্মী সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনের পক্ষে সমর্থন দিয়েছে।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পড়–য়া ছেলেমেয়েরাই দেশকে নেতৃত্ব দেয়; কারণ দেশের সত্যিকার মেধাবীরা একটা বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আসে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মৃত্যুর খবরগুলো নিঃসন্দেহে অস্বস্তিকর ও গ্লানিকর।
বিষয়টি অভিভাবকদের মনে এক ধরনের উদ্বেগ তৈরি করছে এবং অদূর ভবিষ্যতে তাদের ছেলেমেয়েদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভর্তি করবেন কিনা, তা নিয়ে তারা দ্বিধান্বিত। দেখা যাবে, যাদের সামর্থ্য আছে; তারা ছেলেমেয়েদের বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছেন।
এতে করে ‘ব্রেন-ড্রেন’ প্রক্রিয়াটি আরও বেশি বেগবান হবে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যখন খর্ব হয়, তখন মানুষজন জেগে ওঠে। ভিন্নমতাদর্শী হলেই তাকে আক্রমণ করতে হবে, পিটিয়ে মেরে ফেলতে হবে? যদি আবরারের সর্বশেষ ফেসবুক স্ট্যাটাস আমরা দেখি, তাহলে দেখব- ফেসবুক স্ট্যাটাসটিতে ভারত-বাংলাদেশের রাজনৈতিক কূটকৌশল নিয়ে মন্তব্য করে সে উল্লেখ করেছিল, আমাদের এ বন্ধুপ্রতিম দেশ থেকে আমাদের অর্জন কতটুকু?
তার লেখাটিতে এমন কোনো কিছু নেই, যার মধ্যে বিদ্বেষ আছে কিংবা দেশদ্রোহিতার বিন্দুমাত্র কিছু আছে। ধরলাম, আবরার শিবিরকর্মী ছিল (যদিও বাস্তবে এর কোনো ভিত্তি নেই)। কিন্তু তার পরিণতি কিংবা বিচারকার্য করার এবং বিচারের সম্মুখীন করার দায়িত্ব কি রাষ্ট্র তাদের দিয়েছে?
আবরার হত্যাকাণ্ড আমাদের চোখের সামনে কি এই বার্তা দিচ্ছে না- বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করা জরুরি। অবশ্য রাষ্ট্রবিরোধী এবং ধর্মীয় উসকানিমূলক মতামতগুলো পর্যবেক্ষণ রাখাও জরুরি।
বিচারিক কাজ করার জন্য দেশে আইন-আদালত রয়েছে। কোনো রাষ্ট্রই তার নাগরিকদের আইন হাতে তোলার অধিকার দেয়নি। বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি দেশে তৈরি হচ্ছে, দীর্ঘমেয়াদে তার প্রতিফলন কতটুকু ভয়ংকর হতে পারে; আবরার হত্যাকাণ্ড আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।
আমাদের সংবিধানে ৩৯(২) ধারায় সুস্পষ্টভাবে বলা আছে- দেশের নাগরিকদের বাক-স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। স্বাধীনতার পর দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল অনেকবার দেশে শাসন করেছে কিন্তু দুই দলের কেউই কি জনসাধারণের বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পেরেছে?
তোমরা যারা ছাত্রলীগ করো, তাদের উদ্দেশে বলব- এ সংগঠন জাতির পিতার হাতে গড়া সংগঠন। সেই সংগঠনকে যারা কলুষিত কিংবা কলঙ্কিত করছে তাদের শনাক্ত করা জরুরি, নইলে আবরারের মতো হাজারও আবরারকে বলি হতে হবে।
পৃথিবীতে সবচেয়ে ভারি বস্তু হচ্ছে বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ। আবরারের বাবার কান্না জর্জরিত ও ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠা মুখ দেখে দেশের অনেক বাবাই হয়তো রাতে ঘুমাতে পারেননি। সবাই কল্পনা করেছেন, তার সন্তান কতটা নিরাপদ কিংবা তার সন্তানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে কে! গত দু’দিন ধরে কবি রোমেন রায়হানের একটি কবিতা ফেসবুকে ভাইরাল হচ্ছে-
দুমড়ে মুচড়ে স্বপ্নের
মালা, আকাশ ছোঁয়ার সাধ
প্রিয় বাবা, তুমি প্রস্তুত করো
তোমার চওড়া কাঁধ।
আগে চড়েছিল ছোট্ট আমিটা,
এবারে আমার লাশ।
মুখোশে মুখোশে
মানুষের সাথে
শুয়োরের বসবাস।
সন্তানের এই আর্তনাদের জবাব কি আমাদের কাছে আছে?
জিয়া আহমেদ : সহকারী অধ্যাপক, জিওগ্রাফি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট বিভাগ, শাবিপ্রবি, সিলেট
yia38env@gmail.com