Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

জাতিসংঘ কি এখনও প্রাসঙ্গিক?

Icon

ড. মুনীরউদ্দিন আহমদ

প্রকাশ: ০৯ অক্টোবর ২০১৯, ০২:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

জাতিসংঘ কি এখনও প্রাসঙ্গিক?

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৪তম অধিবেশন শেষ হল সম্প্রতি। পৃথিবীর বড় বড় নেতা বা তাদের প্রতিনিধিরা অধিবেশনে বক্তব্য রেখেছেন। কী দেখলাম, কী শুনলাম তার খতিয়ান বর্ণনা সংক্ষেপে বলা সম্ভব নয়।

তবে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে রাশিয়া ও চীনের সেই চিরাচরিত শীতল যুদ্ধ, আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের বয়ান, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যুদ্ধবিগ্রহ, জলবায়ুর পরিবর্তন, দোষারোপ, পাল্টা দোষারোপ আলোচনায় প্রাধান্য পেলেও প্রকৃত অর্থে কাজের কাজ কিছু হবে বলে কেউ আশা করে না।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির দু’বছরের মধ্যে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার সুপ্ত উদ্দেশ্য ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী মিত্রশক্তি হিসেবে পরিচিত দেশগুলোকে পৃথিবী শাসন ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেয়া, যদিও আদর্শিকভাবে প্রচার করা হয়- জাতিসংঘের মূল উদ্দেশ্য হল পৃথিবীতে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী নিরাপত্তা পরিষদই হল এ আন্তর্জাতিক সংস্থার চালিকাশক্তি।

আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গকারী কোনো দেশের বিরুদ্ধে শাস্তি প্রয়োগ বা নিষেধাজ্ঞা আরোপসহ যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার ক্ষমতা রাখে শুধু নিরাপত্তা পরিষদ। অন্যদিকে সাধারণ পরিষদ কোনো প্রস্তাব গ্রহণ করার ক্ষমতা রাখলেও তা বাস্তবায়নের কোনো কার্যকর ব্যবস্থা বা ক্ষমতা তার নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয়ী মিত্রপক্ষে ছিল যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও সোভিয়েত ইউনিয়ন।

চীনসহ এ দেশগুলোকে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যের মর্যাদা প্রদান করা হয়। এ পাঁচটি দেশের প্রতিটির রয়েছে ভেটো ক্ষমতা। কোনো স্থায়ী সদস্য কোনো প্রস্তাব বা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভেটো প্রয়োগ করলে ওই প্রস্তাব বা সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় না। নিরাপত্তা পরিষদে আরও ১০টি দেশ দুই বছরের জন্য নির্বাচিত হয়। পাঁচটি স্থায়ী সদস্যসহ নিরাপত্তা পরিষদের মোট সদস্য সংখ্যা ১৫। তবে দু’বছরের জন্য নির্বাচিত ১০টি দেশের কোনো ভেটো ক্ষমতা নেই।

জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ভেটো প্রদান করেছে তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও বর্তমান রাশিয়া। ভেটো প্রদানের সংখ্যা ১৪১। ভেটো প্রদানের ক্ষেত্রে রাশিয়ার পরই অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের। যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত ভেটোর সংখ্যা ৮৩, যার মধ্যে প্রায় অর্ধেক প্রয়োগ করা হয়েছে ইসরাইলের বিরুদ্ধে গৃহীত প্রস্তাব বা সিদ্ধান্তের বিপক্ষে। যুক্তরাজ্য ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে ৩১ বার।

এর মধ্যে ২৩টি ভেটো প্রদান করা হয় যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকে সমর্থন করে। ফ্রান্স ভেটো প্রয়োগ করেছে ১৮ বার এবং চীন ১৪ বার। তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ। ধনতান্ত্রিক পুঁজিবাদী দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আদর্শগত দ্বন্দ্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই স্নায়ুযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা একে অপরকে প্রতিহত ও জব্দ করার জন্য ভেটো ক্ষমতা ব্যবহার করে। ভেটো প্রয়োগের প্রবণতা এখনও পরিলক্ষিত হচ্ছে।

এ দুই পরাশক্তির লড়াইয়ে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য ছিল মূলত পেছনের সারির সদস্য। কারণ যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সকে একসময় খুব শক্তিশালী দেশ হিসেবে গণ্য করা হলেও কালক্রমে এদের সাম্রাজ্যের পতন ও ক্ষয়ের ফলে এরা দুর্বল হয়ে পড়ে। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পর্যায়ে জাতীয়তাবাদী চীন ছিল নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের একটি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে মাও সে তুংয়ের সমাজতান্ত্রিক দল জাতীয়তাবাদীদের মূল ভূখণ্ড থেকে তাড়িয়ে দিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের আসনটি নিয়ে নেয়।

প্রতিষ্ঠা লাভের পর থেকেই জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ছিল হতাশাব্যঞ্জক। কোনো সময়ই যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করেনি। জাতিসংঘকে যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই ব্যবহার করে আসছে তার অন্যায় দ্বিমুখী স্বার্থ সংরক্ষণের হাতিয়ার হিসেবে। জাতিসংঘের কর্মকাণ্ড যুক্তরাষ্ট্রের বা তার মিত্র দেশগুলোর স্বার্থের পক্ষে গেলে তখন তাকে প্রাসঙ্গিক বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

আর যখনই জাতিসংঘের কোনো প্রস্তাব বা সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্র বা তার মিত্ররাষ্ট্রের, বিশেষ করে ইসরাইলের বিপক্ষে গেছে, তখনই যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘকে অবজ্ঞা করেছে, জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করেছে এবং অনেক ক্ষেত্রে জাতিসংঘকে পাশ কাটিয়ে একক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে পৃথিবীতে সংকট ও সংঘাত সৃষ্টি করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ফিলিস্তিনে ভূমি দখল, নিরীহ মানুষ হত্যা, জখম, জুলুম নির্যাতনের জন্য ইসরাইলের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত নিন্দা প্রস্তাবের বিপক্ষে যুক্তরাষ্ট্র অসংখ্যবার ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে।

এসব ভেটো প্রদানের কারণে ইসরাইলের ভূমি সম্প্রসারণ নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, জুলুম-অত্যাচার-খুন-জখমের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কোনো প্রস্তাব বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেনি গত ৭২ বছর ধরে। তার বাস্তবায়ন তো দূরের কথা। যুগ যুগ ধরে ফিলিস্তিনিরা ইসরাইলের আগ্রাসন, ভূমি অধিভুক্তকরণ, হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হচ্ছে।

ইসরাইল গাজা ও পশ্চিমতীরে বছরের পর বছর ধরে গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্রের সাহায্যে নির্বিচারে নারী, শিশু হত্যা করছে; যুবক ও প্রাপ্তবয়স্কদের সন্ত্রাসী আখ্যায়িত করে গুপ্তহত্যার মাধ্যমে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিচ্ছে, বাড়িঘর ডিনামাইট ও বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। জাতিসংঘের এ মোস্ট পাওয়ারফুল নিরাপত্তা পরিষদ ফিলিস্তিনে বিগত বছরগুলোতে সামান্যতম নিরাপত্তা ও শান্তির ব্যবস্থাও করতে পারেনি, শুধু বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তির দ্বিমুখী অবস্থানের কারণে।

২০০২ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভাষণদানকালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বুশ ইরাকে ইঙ্গ-মার্কিন হামলাকে আইনগত বৈধতা প্রদানের জন্য জাতিসংঘকে ভয় দেখিয়েছিলেন। নতুবা জাতিসংঘকে Irrelevant বা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যেতে বলা হয়েছিল। সেই ভাষণ শোনার পর অনেক অভিজ্ঞ ব্যক্তিই আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে জাতিসংঘ কখন খুব বেশি relevant বা প্রাসঙ্গিক ছিল?

নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের স্বার্থসংশ্লিষ্ট স্বেচ্ছাচারিতার কারণে জাতিসংঘ কোনো সময়ই তার ভূমিকা যথাযথভাবে পালন করতে পারেনি। জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠাতা মূল দেশগুলোই যদি জাতিসংঘ সনদ লঙ্ঘন বা এর অবমাননা করে তাহলে এ আন্তর্জাতিক সংস্থাটি আর প্রাসঙ্গিক থাকে কী করে? বলা যায়, জাতিসংঘকে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের কারণেই বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা প্রদানে সক্ষম কোনো কার্যকর সংস্থা হিসেবে আর ভাবা যাচ্ছে না।

লেনিন লীগ অব নেশনকে ‘চোরের রান্নাঘর’ আখ্যায়িত করেছিলেন। বর্তমান যুগেও নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের কর্মকাণ্ডকে এর চেয়ে ভালো কোনো টার্মে বর্ণনা করার উপায় নেই। অনেকেই মনে করেন, বর্তমানে জাতিসংঘ হল একটি প্রতারণামূলক সংস্থা, যার কার্যকর ভূমিকা হল শুধু একটি স্বৈরাচারী গোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণ।

প্রেসিডেন্ট বুশ সাদ্দাম হোসেনকে নব্য হিটলার হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। সাদ্দাম যদি নব্য হিটলার হন তবে আরিয়েল শ্যারন ও স্তালিনের মধ্যে পার্থক্য থাকে কোথায়? সাদ্দাম-শ্যারন দু’জনই নিষ্ঠুর, দু’জনই ভয়ভীতি, প্রতারণা ও সহিংস নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। দুই নেতাই অসহায় নিরীহ মানুষ হত্যাকারী, দু’জনই প্রতিবেশী দেশে আগ্রাসন চালানোর দায়ে দোষী। তারপরও যুক্তরাষ্ট্র সরকার কর্তৃক একজনকে মিত্র এবং অন্যজনকে শক্র হিসেবে গণ্য করার মূল কারণ কী, তা বিশ্ববাসী কোনো দিনই বুঝে উঠতে পারেনি।

এটা কি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের উলঙ্গ-দ্বিমুখীনীতির বহিঃপ্রকাশ নয়? মধ্যপ্রাচ্যের দুটি দেশের প্রতি দুই ধরনের আচরণ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে আমেরিকানরা উত্তর দেন- Do not mix orange with apple. গণমাধ্যমের জন্য উত্তরটি অনেক লোভনীয় হলেও আমাদের কাছে এর অর্থ দাঁড়ায়- ঘোড়ার সঙ্গে গাধাকে মেলাবেন না। এ ধরনের উত্তর থেকে কারও বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়, সাম্প্রদায়িক মানসিকতায় বিশ্বাসীরাই শুধু এ ধরনের উত্তর দিতে পারেন।

জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো এ বাস্তবতার সঙ্গে অতি পরিচিত বলেই ইসরাইল কর্তৃক জাতিসংঘ প্রস্তাব বা সিদ্ধান্ত বরাবরই পদদলিত ও পরিত্যক্ত হওয়ার পরও এদের কার্যত কোনো কিছুই করার থাকে না। পৃথিবীর একটি ক্ষুদ্র দেশ বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তির মদদে সব ধরনের গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্রের অধিকারী হয়েছে, বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগও করছে, বিশ্ব সম্প্রদায়কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি-আইনকানুনকে অবজ্ঞা করে দিব্বি পার পেয়ে যাচ্ছে।

অন্যদিকে কোনো কোনো দেশ একটিমাত্র দেশকে পছন্দমাফিক তুষ্ট করতে না পারার কারণে ‘পাজি দেশ’ (Rogue country) হিসেবে বা ‘অ্যাক্সিস্ অব ইভ্ল’ হিসেবে আখ্যায়িত হচ্ছে। যে কোনো দেশের জন্য টার্মগুলো চরম অবমাননাকর। শুধু গণমাধ্যম বা বিশ্বসম্প্রদায়ের সামনে এসব দেশকে অপমান করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক নীতিমালা লঙ্ঘন করেই এসব দেশকে আক্রমণ করছে, ধ্বংস করছে এবং শেষে দখল করা শুরু করেছে। সিরিয়া, উত্তর কোরিয়া, ইরান, ভেনিজুয়েলা, কিউবা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এখন ‘পাজি দেশ’।

ৎইসরাইলের কাছে আণবিক বোমাসহ সব ধরনের জীবাণু ও রাসায়নিক অস্ত্র থাকায় ও ব্যবহারে কোনো বাধা নেই। কিন্তু উত্তর কোরিয়া ও ইরানের কাছে এসব মারণাস্ত্র থাকতে পারবে না। আন্তর্জাতিক আইন নাকি তা অনুমোদন করে না। এই হল যুক্তরাষ্ট্রের ‘জাস্ট কজ্’ নীতি।

প্রেসিডেন্ট বুশ ২০০১ সালের জানুয়ারি মাসে ক্ষমতা গ্রহণের অনেক আগেই সমগ্র পৃথিবীতে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য বিস্তারসহ ইরাকে সামরিক হামলার মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের নীলনকশা প্রণীত হয়ে গিয়েছিল। Global Pax Americana প্রতিষ্ঠার এই নীলনকশার কথা প্রথম ফাঁস করে দেয় সান্ডে হেরাল্ড। ২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে লিখিত এই নীলনকশার প্রণেতারা ছিলেন ডিক চেনি, ডোনাল্ড রামস্ফেল্ড, পল ওল্ফোভিট্স, জর্জ বুশের ছোট ভাই জেব বুশ এবং লুইস লিব্বি।

নব্য রক্ষণশীল এসব নেতা ‘দ্য নিউ আমেরিকান সেঞ্চুরি’ প্রকল্পের আওতায় যে দলিল প্রণয়ন করেছিলেন তার নাম দেয়া হয়েছিল ‘রিবিল্ডিং আমেরিকান ডিফেন্স : স্ট্র্যাটেজিস, ফোর্সেস অ্যান্ড রিসোর্সেস ফর এ নিউ সেঞ্চুরি’। এই নীলনকশার অনেক লক্ষ্যের মধ্যে একটি ছিল- সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে বুশ সরকার উপসাগরীয় অঞ্চলে সামরিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে। কারণ অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কারণে উপসাগরীয় অঞ্চলে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা যুক্তরাষ্ট্র বহুদিন ধরে উপলব্ধি করে আসছিল।

পাঠক, সেই কথিত নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবেই সাদ্দাম সরকারকে উৎখাতের মাধ্যমে ইরাক দখল করা হয়। সেই দলিলে গুরুত্ব দিয়ে বলা হয়, একমাত্র পরাশক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্বে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে। কোনো শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী যাতে যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করতে না পারে সেজন্য সার্বিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের নীতি-আদর্শ ও স্বার্থ সংরক্ষণের সহায়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থা সৃষ্টির মাধ্যমে পৃথিবীকে নতুন আঙ্গিকে গড়ে তুলতে হবে। দলিলে মার্কিন সেনাবাহিনীকে বিশ্বের নতুন সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

শিল্পোন্নত দেশগুলো যেন মাথাছাড়া দিয়ে উঠতে না পারে এবং আঞ্চলিক ও গ্লোবাল ইস্যুতে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে তৎপর না হয়; আর হলে যেন প্রতিহত করা হয় বা নিরুৎসাহিত করা হয়, সেই ব্যবস্থা গ্রহণের সার্বিক ক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে নেয়ার জন্য রিপোর্টে তাগিদ প্রদান করা হয়। রিপোর্টে অন্যসব লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়, বিশ্বে আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ বন্ধু দেশ হিসেবে যুক্তরাজ্যকে খুব কার্যকরভাবে কাজে লাগানোর ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে।

এ রিপোর্টে আরও বলা হয়, বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দমাফিক শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার কাজটি করবে জাতিসংঘের পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্ব নিয়ন্ত্রণে ইউরোপ আমেরিকার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। রিপোর্টে প্রস্তাব করা হয়েছে, ইরাক দখলের পর সৌদি আরব, কুয়েত ও কাতারে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি স্থায়ীভাবে বহাল রাখতে হবে, যদিও আরব বিশ্বের জনমত ও ইরান এ পরিকল্পনার প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

মজার ব্যাপার, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য চীনে সরকার পরিবর্তনের মাধ্যমে পুতুল সরকার বসিয়ে গণতন্ত্র চালুর ওপরও গুরুত্বারোপ করা হয়। সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয়ে ট্রাম্প প্রশাসন চীনের রফতানি বাণিজ্যের ওপর কঠোর শুল্ক আরোপ করে, দক্ষিণ চীন সাগরে সামরিক তৎপরতা বৃদ্ধি করে বিশ্বব্যাপী চীনের ক্রমবর্ধমান উন্নতি-অগ্রগতি ও রাজনৈতিক প্রভাবকে ঠেকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

মহাকাশ নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে ‘ইউএস স্পেস ফোর্সেস’ প্রতিষ্ঠাসহ যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে শত্রুর ইন্টারনেট ব্যবহার প্রতিহত করার জন্য সাইবার স্পেস পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করার ওপরও গুরুত্বারোপ করা হয়। রিপোর্টে উত্তর কোরিয়া, লিবিয়া, সিরিয়া ও ইরানকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য খুব বিপজ্জনক দেশ হিসেবে উল্লেখ করে অন্যান্য মারণাস্ত্রসহ জীবাণু ও রাসায়নিক যুদ্ধের সম্ভাব্য সব প্রস্তুতি নিতে সরকারকে আহ্বান জানানো হয়। সিরিয়া ও লিবিয়া ধ্বংসের নীলনকশা ইতিমধ্যে বাস্তবায়িত করে ফেলেছে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো জোট। বাকি রয়েছে ইরান ও উত্তর কোরিয়া।

মানমর্যাদা আর সমতার ভিত্তিতে জাতিসংঘ পরিবারের সদস্য হিসেবে মিলেমিশে বাস করার যে ধ্যান-ধারণা এতদিন চলে এসেছিল, বুশ সরকার ও তার পরবর্তী সরকারগুলো ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তা অতি দ্রুত বিলুপ্ত হতে চলেছে। বুশ সরকারের আফগানিস্তান আক্রমণ ও দখল, এক বছরের ব্যবধানে ইরাক আক্রমণ ও দখল, সিরিয়া ও লিবিয়া ধ্বংস ও গৃহযুদ্ধ বাধানো, উত্তর কোরিয়া ও ইরানের প্রতি বাণিজ্য অবরোধসহ হুমকি-ধমকি প্রদান, পুরো মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি, দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকায় সংকট সৃষ্টি, দক্ষিণ চীন সাগর ও কোরিয়া অঞ্চলে যুদ্ধাবস্থাসহ অন্যান্য ঘটনা বিশ্লেষণ করলে উল্লেখিত রিপোর্টের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের সত্যতা পরিষ্কার হয়ে যায়।

আমেরিকান এক বিশ্লেষকের মতে, এসব হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার ও তাদের রক্ষণশীল অনুসারীদের উদ্ভট, দুষ্ট, ভয়ংকর ও অবাস্তব চিন্তা। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান শক্তির দাপট আপেক্ষিক ও নিম্নমুখী এবং পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশের কাছে তা অগ্রহণযোগ্য।

এমনিতেই ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া ও আফগানিস্তান যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আফগানিস্তানে ১৮ বছর যুদ্ধ করেও জয়ের মুখ দেখছে না যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো সামরিক জোট। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ‘রিবিল্ডিং দ্য নিউ আমেরিকান সেঞ্চুরি’ বাস্তবায়নে যুক্তরাষ্ট্র সরকার এবং তাদের নব্য রক্ষণশীল অনুসারীরা কতটুকু সফল হবে সেটাই দেখার বিষয়।

ড. মুনীরউদ্দিন আহমদ : অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ঢাকা

drmuniruddin@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম