খালেদা জিয়া। ফাইল ছবি
লম্বা টানা বারান্দার ছোট্ট একটা অংশ লোহার গরাদ দিয়ে আলাদা করা। পর্দা টানা থাকায় গরাদের ওপাশটা ঠিক বোঝা যায় না। গরাদের মধ্যেই ছোট একটা দরজা।
সেই দরজা দিয়ে ঢুকলে হাতের বাঁয়ে একটা ঘর। সেই ঘর পেরোলে কাঠের দরজা। সেই দরজা বেশিরভাগ সময় ভেজানোই থাকে। ভেতরে আট বাই দশ ফুটের ছোট্ট একটা খুপরি; এটাই কেবিন ৬১২। সেই খুপরিতে আছে একটা খাট, বসার একটি ছোট চেয়ার, একটি কাঠের ছোট ওয়াড্রোব, প্লাস্টিকের ছোট একটি র্যাক।
তাতেই ঘরটা যেন জিনিসে বোঝাই। কিন্তু আশ্চর্য, খুপরিটিই ধারণ করেছে যেন পুরো বাংলাদেশকে। ঘরটি আলো করেছেন বাংলাদেশের জনপ্রিয় নেত্রী, তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রনায়ক বেগম খালেদা জিয়া।
২ অক্টোবর ২০১৯, সময় বিকাল ৩টা। ওই আলোকিত ঘরটাতে ঠিক ৬ মাস পর দেখা হল তার সঙ্গে। যেদিন আলিয়া মাদ্রাসার অস্থায়ী আদালত থেকে কারাগারে নেয়া হয় তাকে সেদিনও নিজ শক্তিতে হেঁটে গাড়িতে উঠেছিলেন তিনি। ঋজু, স্থির ভঙ্গি।
আমাদের অশ্রুসিক্ত চোখের দিকে তাকিয়েছিলেন সান্ত্বনার দৃষ্টিতে। সাবেক কেন্দ্রীয় কারাগারের নির্জন, পরিত্যক্ত ২৫০ বছরের পুরনো স্যাঁতস্যাঁতে ভবনে একাকী বন্দি হিসেবে রাখা হয়েছিল এ আপসহীন লৌহমানবীকে। অদ্ভুত কাণ্ড!
এরপর নজিরবিহীনভাবে কারাগারেই বসানো হল আদালত। আইনজীবী হওয়ার সুবাদে সেই কারাগারে বহুবার দেখা হয়েছে তার সঙ্গে। হুইল চেয়ারে আসতেন তিনি। হুইল চেয়ারের হাতল ধরে ঠিক তার পাশেই দাঁড়িয়ে থাকতাম প্রতিবার। দেশের খবর, দলের খবর নিচু স্বরে তার কাছে বলে যেতাম।
কখনও চুপচাপ শুনতেন; কিন্তু বেশিরভাগ কথার উত্তরেই কোনো না কোনো নির্দেশনা পেয়েছি তার কাছ থেকে। দু’একবার মজার কথায় হেসেও ফেলেছেন স্বল্পবাক মানুষটি। প্রতিবারই আগের বারের চেয়ে স্বাস্থ্য ভাঙতে দেখেছি তার। ধীরে ধীরে ক্রমাবনতির দিকে গেছে তার অবস্থা।
আমাদের সবার চোখের সামনে খারাপ থেকে খারাপতর হয়েছে তার স্বাস্থ্য। আমরা তাকিয়ে দেখেছি। আইনজীবীরা জামিন চেয়েছি। আদালতে বলেছি। ক্রুড়ভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছি। নিু থেকে উচ্চ, বাদ যায়নি কোনো আদালত।
এবারের দেখা হওয়াটা অন্য সব বারের চেয়ে একদম আলাদা। ছোট্ট একটা ঘরে কালো একটা চেয়ারে বসা তিনি। ঘরে ঢোকা মাত্রই চোখ তুলে তাকালেন। সেই মৃদু হাসি ঠোঁটে। আমরা যে চারজন দেখা করতে গেছি, কেউই চোখের পানি আটকে রাখতে পারিনি তাকে দেখে। কিন্তু তিনি স্থির, অবিচল।
আমাদের সব শক্তি আর সাহসের উৎস যিনি, আমাদের লড়াই করার প্রেরণা যিনি, তাকে কি ভাঙলে চলে? তিনি সব সয়েছেন, সয়ে চলেছেন সর্বংসহার মতো। কী ভীষণ শান্ত অথচ দৃঢ় ঋজু তার বসার ভঙ্গি। অনেকখানি কৃশকায় হয়ে গেছেন তিনি। ধীরে ধীরে শুনলাম সাহায্য ছাড়া চলা তো দূরের কথা, দাঁড়াতে পর্যন্ত পারেন না।
পোশাক পরিবর্তন, চুল আঁচড়ানো সবকিছুতে একজন সাহায্যকারী দরকার হয়। পানি পর্যন্ত খেতে হয় অন্যের সাহায্য নিয়ে। মাত্র দু’বেলা সামান্য খান। তারপরও ডায়াবেটিস কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে নেই।
কথা ছিল অনেক। বাধাও ছিল তেমনি। ওনাকে দেখার প্রাথমিক ধাক্কা কাটার সঙ্গে সঙ্গেই লক্ষ করলাম, ছোট্ট এ খুপরিতে মন খুলে দুটো কথা বলার পরিবেশ পর্যন্ত নেই। এখানেও সাদা পোশাকে দায়িত্ব পালন করছে সরকারের পাইক-পেয়াদারা।
তারপরও যথাসম্ভব নিচু স্বরে যতটা সম্ভব দেশের খবর, দলের খবর, এমনকি নিজের ব্যক্তিগত-পারিবারিক কিছু কথাও জানালাম তাকে। সারা পৃথিবী থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন থেকেও তার অসাধারণ প্রজ্ঞা দিয়ে দিলেন গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা, সিদ্ধান্ত।
সংসদ নিয়ে কথা বলার এক পর্যায়ে জিজ্ঞেস করলাম আমাদের কারও বক্তব্য দেখার সুযোগ হয়েছে কি তার? বিষণ্ণ কণ্ঠে বললেন, রুমে একটা টিভি ছিল; কিন্তু সেটাও সরিয়ে ফেলেছে।
কী বিচিত্র এই দেশ, কী ভয়ানক রাজনৈতিক প্রতিহিংসা! হাসপাতালে আছেন তিনি; কিন্তু হাসপাতালের স্বাভাবিক যে সুবিধাগুলো, সেগুলো থেকেও তাকে বঞ্চিত করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
তার সামনে বসে আমার মানসপটে ভেসে উঠল এরশাদবিরোধী আন্দোলনের কথা। পুরো নব্বইয়ের দশকে রাস্তায় থেকে, ছিয়াশি সালের নির্বাচনে না গিয়ে আপসহীন ভূমিকায় একাই লড়ে গেছেন বেগম খালেদা জিয়া।
এই একই খালেদা জিয়াকে আমরা দেখেছি ওয়ান-ইলেভেনের আর্মি ব্যাকড কেয়ারটেকার সরকারের সময়। তাকে দেশ ছাড়তে বলায় তীব্র কণ্ঠে বলেছিলেন, এই দেশ ছাড়া আমার কোথাও আর কোনো জায়গা নেই।
অকালে স্বামীহারা হয়েছেন, পুত্রশোক সইতে হয়েছে, আরেক পুত্র নির্বাসিত। জেলে থাকা অবস্থায় হারিয়েছেন মাকে। রাজনীতি বহু কিছু কেড়ে নিয়েছে তার জীবন থেকে। শুধু পারেনি দেশের প্রতি, মানুষের প্রতি তার মমত্ববোধ, ভালোবাসা আর দায়িত্ববোধকে কেড়ে নিতে।
বারবার নির্যাতিত হয়েছেন, ৭৪ বছর বয়সে কারাবরণ করেছেন, কেবল দেশকে ভালোবেসে, দেশের মানুষকে মুক্ত করতে। দলের ক্ষুদ্র গণ্ডিতে তাকে বাধা যায়নি কোনো কালে। তিনি দল আর মতের বহু ঊর্ধ্বে উঠেছিলেন। মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে তার আরেক নাম হয়েছে ‘দেশনেত্রী’।
মানুষও দিয়েছে তাকে, দিয়েছে অকৃত্রিম ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা। জীবনে কোনোদিন কোনো নির্বাচনে কোনো আসন থেকে পরাজিত হননি তিনি। গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, লক্ষাধিক মিথ্যা, গায়েবি, রাজনৈতিক মামলা, ২৬ লাখের ওপর আসামি, এলাকায় থাকতে না পারাসহ হেন কোনো নির্যাতন নেই যা এ দলের নেতাকর্মীদের ওপর করা হয়নি।
ভয়-প্রলোভন দিয়ে দল ভাঙার, নেতাকর্মীদের বারবার লক্ষচ্যুত করার চেষ্টা করা হয়েছে, যা সফল হয়নি কোনোভাবেই। প্রাণ দিয়ে দলকে টিকিয়ে রেখেছে কর্মীরা। আর তা সম্ভব হয়েছে, কারণ আজও শত প্রতিকূলতার মাঝেও শক্ত হাতে ধরে রেখেছেন বেগম খালেদা জিয়া, যিনি কেবল ঐক্য আর সংহতি নয়, বরং গণতন্ত্র, মানুষের অধিকার, ন্যায়বিচার, মানুষের বাক আর চিন্তার স্বাধীনতার প্রতীক।
২০০৪ সাল থেকে আমার ওকালতি জীবন শুরু। এর মধ্যে একটি বড় অংশ আমি সরাসরি কাজ করেছি কিংবদন্তি আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের সঙ্গে। বিশেষ করে ওয়ান-ইলেভেনে তার সঙ্গে কাজ করার সুবাদে আমি দেখেছি দুদকের মামলাগুলোতে কীভাবে একটির পর একটি রুল, স্টে, কোয়াশ এবং বেইল হতে।
যে শর্তগুলোর অন্তত একটি পূরণ করলে একজন মানুষের জামিন পেতে কোনো সমস্যা হয় না, তার প্রতিটি তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কলামে, টকশোতে বারবার কথাগুলো বলেছি আমি। তাই তার প্রসঙ্গে যখন প্যারোলের কথা আলোচনায় আসে, সেটাকে একেবারেই অহেতুক আলোচনা বলে মনে হয়েছে আমার। তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ করেছি আমি।
তবুও তার সঙ্গে থাকার সময়ের একপর্যায়ে তার স্বাস্থ্যের দিকে তাকিয়ে অনেকখানি সাহস (কিংবা দুঃসাহস) নিয়ে জানালাম, সাংবাদিকরা জানতে চাচ্ছে প্যারোল নিয়ে। মৃদু কিন্তু শক্ত গলায় বললেন ‘কোনো অপরাধ করিনি আমি, ২ কোটি টাকা ব্যাংকে বেড়ে ৬ কোটি টাকা হয়েছে। জামিন আমার হক।’ সেই দৃঢ় কণ্ঠ, সাহসী উচ্চারণ, তীব্র দৃষ্টি।
কুঁকড়ে গেছি আমি, আমরা, যারা ছিলাম ওই ঘরে। বয়স, রাজনৈতিক প্রতিশোধপরায়ণতা, শারীরিক অসুস্থতা বাহ্যিকভাবে অনেকটাই কাবু করেছে তাকে; কিন্তু তার যে দৃঢ় মনোবল, মানসিক শক্তি, সাহস আর আপসহীনতা তাতে সামান্যতম আঁচড় পড়েনি। ১৬ কোটি মানুষের শক্তি, সাহস আর দৃঢ়তা একাই ধারণ করেন তিনি।
তিনি অমর, তিনি অজেয়। তাকে টলানো যায় না। তিনি একজনই, যাকে শত আঘাতেও ভাঙা যায় না। তিনি চাইলে কী না হতো? কিন্তু ন্যূনতম ছাড় দেননি তিনি। ১৬ কোটি মানুষের চাওয়া আর মুক্তির স্বপ্নের কাছে নিজেকে তুচ্ছ করেছেন, বাজি ধরেছেন নিজের জীবন।
পর্যাপ্ত সময় আমরা পাইনি; কিন্তু তার মতো একজন মানুষের সান্নিধ্যে সেই সময়টাও শেষ হয়ে যায় এক পলকেই। বেরিয়ে যাওয়ার চাপ আসে; বেরোতে হয় আমাদের। শেষ জন হিসেবে বেরিয়ে যাই আমি। বেরিয়ে যাওয়া পর্যন্ত চোখ ফেরাতে পারিনি তার দিক থেকে। তার দিকে তাকিয়ে ধীর পায়ে পেছনে হেঁটেছি আমি।
ক্লান্ত, অসুস্থ শরীরের মধ্যে সেই দেদীপ্যমান চোখগুলো তাকিয়ে আছে তীব্র সাহস, আত্মবিশ্বাস আর আপসহীনতা নিয়ে। কক্ষটি থেকে বেরিয়ে গিয়ে তীব্র বিষণ্ণতার মধ্যেই প্রথম যে কথাটি মনে হল সেটি হল- তার এ গুণগুলোর ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ আমরা পেতাম যদি!
ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা : সংসদ সদস্য; আন্তর্জাতিক বিষয়ক সহ-সম্পাদক, বিএনপি