
প্রিন্ট: ০১ মে ২০২৫, ১২:৫৫ এএম
শুদ্ধি অভিযান চলমান থাকুক

মো. মইনুল ইসলাম
প্রকাশ: ০৭ অক্টোবর ২০১৯, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

কাকরাইলে রোববার যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের রাজনৈতিক কার্যালয় ঘিরে রেখে অভিযান চালায় র্যাব। ছবি: যুগান্তর
আরও পড়ুন
বেশ কয়েকদিন ধরে দেশজুড়ে ক্যাসিনোবিরোধী শুদ্ধি অভিযান চলছে। ফলে জুয়াখোর, মাদকসেবী, মাদক ব্যবসায়ী, চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ, দুর্নীতিপরায়ণ সন্ত্রাসীরা ধরা পড়ছে। রাজধানীতেই এরা বেশি ধরা পড়েছে।
ঢাকা দেশের রাজধানী বিধায় এখানে সম্পদ আহরণের সুযোগ যেমন বেশি, তেমনি এখানে বসবাসকারী দুর্নীতিবাজদের সংখ্যাটিও বড়। কয়েকজন উল্লেখযোগ্য দুর্নীতিবাজের নাম হচ্ছে- খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, জি কে শামীম, সফিকুল আলম ফিরোজ, ইসমাইল হোসেন সম্রাট, লোকসান হোসেন ভূঁইয়া, এনামুল হক তথা এনু ভূঁইয়া এবং রূপন ভূঁইয়া।
অভিযান অব্যাহত থাকলে (প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যে এ ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিয়েছেন) এ ধরনের সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিবাজ আরও অনেক নেতার নাম প্রকাশিত হবে। এ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, এদের অধিকাংশই সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী সংগঠন- যুবলীগ, কৃষক লীগ ইত্যাদির বড় বা পাতি নেতা।
দেশের শিক্ষিত ও সমাজসচেতন মানুষ জানে, সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিবাজরা দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পতাকা তলে আশ্রয় নেয় এবং তাদের নেতাকর্মী সাজে। বিএনপি ক্ষমতায় এলে এরা বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের নেতাকর্মী। আবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হলে এরা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মী হয়ে যায়।
এদের আসল আদর্শ বা উদ্দেশ্য একটাই। তা হল সন্ত্রাস ও দুর্নীতির পথে ধনসম্পদ ও বিত্তবৈভবের মালিক হওয়া। তবে মুখের বুলি ও গায়ের লেবাসটা থাকে আওয়ামী লীগের বা বিএনপির। বিএনপি আমলে এ ধরনের দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী, ক্যাডারদের চেহারা আমাদের খুবই পরিচিত। বিএনপির সাবেক কয়েকজন মন্ত্রীকে দেখি বর্তমান অভিযানকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বেজায় উচ্চকণ্ঠ। চোরের মায়ের বড় গলা বলে দেশে একটি প্রবাদ আছে। সেটাই এ প্রসঙ্গে মনে আসে।
যুবলীগ, কৃষক লীগ ও আওয়ামী লীগের প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডের কিছু আলোচনা করতে চাই। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দল ক্ষমতায় আসার পর এমন একটি সপ্তাহ কি পাওয়া যাবে ছাত্রলীগের নানা রকমের সন্ত্রাস ও দুর্নীতির খবর গণমাধমে প্রকাশিত হয়নি? দোকানপাটে চাঁদাবাজি, সিটবাণিজ্য, ভর্তিবাণিজ্য, ঝগড়া, মারামারি, প্রতিপক্ষ ছাত্রদলের ওপর হামলা, নিজেদের মধ্যে কোন্দল, সংঘর্ষ ও নিরীহ ছাত্রদের বেয়াদবির নামে কিংবা তাদের মিছিলে যোগ না দেয়ার কারণে গেস্টরুমে নির্যাতনের মতো অসংখ্য অন্যায়-অবৈধ ও সন্ত্রাসী কাজের কাজী হিসেবে তারা দেশে পরিচিতি লাভ করে। ঠিকাদারদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় ছিল তাদের লোভনীয় ব্যবসা। সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এ ব্যাপারে তাদের সহায়ক ভূমিকা পালন করে দেশব্যাপী নিন্দা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মানসম্মান সাংঘাতিকভাবে নষ্ট করেছেন। সর্বকালে সর্বদেশে ছাত্রদের কাজ পড়াশোনা বলেই স্বীকৃত। প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে তারা সুনাগরিক হবে এবং জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে অবদান রাখবে; এটাই দেশবাসীর আশা। মুখে এটি আমাদের রাজনীতির শীর্ষ নেতারাও স্বীকার করবেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, বাংলাদেশের বড় দলগুলো কিছুসংখ্যক ছাত্রকে দলীয় লাঠিয়াল বানাতে চায়। ছাত্রনামধারী এ লাঠিয়ালরা পড়াশোনা পাটে তুলে সন্ত্রাসী কার্যকলাপে লিপ্ত হয়। নিজেরাও পড়ে না এবং পড়াশোনায় আগ্রহী সুবোধ সুশীল ছাত্রদেরও পড়াশোনা করতে দেয় না। বরঞ্চ তাদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে।
মূল বিষয় চলমান ক্যাসিনোবিরোধী শুদ্ধি অভিযানে ফিরে আসা যাক। যুবলীগ, কৃষক লীগ এবং আওয়ামী লীগের কতিপয় দুর্বৃত্তের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বিপুল ধনসম্পদ অর্জনের ফিরিস্তি দেখলে বিস্মিত হতে হয়। জি কে শামীমের বাসায় হানা দিয়ে র্যাব ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা পেয়েছে এবং তার সঙ্গে পেয়েছে ১৬৫ কোটি টাকার এফডিআর ও বেশকিছু ডলার। গণপূর্ত বিভাগের প্রায় সবরকম কাজের টেন্ডার সে নিয়ন্ত্রণ করত এবং বর্তমানে ১২টি বড় ধরনের সরকারি কাজের ঠিকাদার শামীম নিজে। ৭ জন গানম্যানের প্রহরায় সে চলাফেরা করত। আরেক সন্ত্রাসী খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া শাজাহানপুর-কমলাপুর ও মতিঝিলের বিভিন্ন বাজার, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ফুটপাত ও বস্তিতে চাঁদাবাজি করত। তার ধনসম্পদের বহর দেখলেও বিস্মিত হতে হয়। এরশাদ আমলে ফ্রিডম পার্টির ক্যাডার হিসেবে তার সন্ত্রাসের পথে যাত্রা। বিএনপির আমলে মির্জা আব্বাসের ভাইয়ের ডান হাত হিসেবে সে শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হলে সে কয়েকজন আওয়ামী নেতার মদদে যুবলীগের একটি শীর্ষ পদ বাগিয়ে নেয়।
একইভাবে কলাবাগান, ধানমণ্ডি ও গ্রিন রোডের কিছু অংশে সন্ত্রাসের একচ্ছত্র রাজত্ব কায়েম করে কৃষক লীগের ফিরোজ। খবরে প্রকাশ, ফিরোজকে একটি ফ্ল্যাট বা বড় অঙ্কের চাঁদা না দিয়ে এসব এলাকায় কেউ কোনো নির্মাণকাজ বা জমি-সম্পত্তি বেচাকেনা করতে পারত না। পুরান ঢাকার এনু ও রূপন ভূঁইয়া ভ্রাতৃদ্বয় তাদের এলাকায় একই কাজ করত এবং ঢাকা শহরে তাদের ৫০টি প্লট-ফ্ল্যাট আছে বলে জানা যায়। মোহামেডান ক্লাব ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের শীর্ষ কর্মকর্তা লোকমান হুসেন ভূঁইয়া উপরোক্ত শামীম, খালেদ ও সম্রাটের মতো ক্যাসিনো তথা জুয়া-মদ বাণিজ্যের মাধ্যমেই বিপুল অর্থ-বিত্তের মালিক হয়, যার অংশমাত্র ৪১ কোটি টাকা অস্ট্রেলিয়ার ব্যাংকে জমা রেখেছে। এ দেশের বড় দুর্নীতিবাজরা, যাদের মধ্যে কিছু আমলাও আছে, বিদেশে টাকা পাচার করে থাকে। যার ফলে কানাডার বড় দুটো শহরে বেগমপাড়া গড়ে উঠেছে এবং মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম কেনার হিড়িক পড়েছে বলে শোনা যায়। এখানে এটাও উল্লেখ করা দরকার, উল্লিখিত সন্ত্রাসীরা অনেকেই গানম্যান বা দেহরক্ষী নিয়ে চলাফেরা করত।
চলমান অভিযান দেশজুড়ে দুর্নীতি ও দুষ্কর্মের যেমন পরিচয় বহন করে, তেমনি দেশে সুশাসনের বড় ধরনের অভাবের চিত্রও তুলে ধরে। একটু তলিয়ে দেখলে দেখা যায়, এক অর্থে এরা অর্থাৎ সন্ত্রাসীরা রাষ্ট্রের ভেতরে রাষ্ট্র (state within state) কায়েম করেছিল। নিজস্ব গানম্যান, নিরাপত্তা বাহিনী, নির্যাতন কক্ষ বা Torture cell পরিচালনা এবং সরকারের বড় বড় অফিসে টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি তথ্য এটা প্রমাণ করে। তাহলে দেশে আইন ও প্রশাসন কোথায় ছিল এবং থাকলেও এদের রাজত্বে হানা বা বাধা তারা দিত না কেন? এ প্রশ্নটি যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী পুলিশকে অভিযুক্ত করে তাদের আঙুল চোষার কথা বলেছেন। আর অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালও প্রশাসনের ব্যর্থতাকে দায়ী করেছেন। কয়েকদিন আগে ১৪ দলের এক বৈঠকে প্রশাসনের এই নিষ্ক্রিয়তাকে নিন্দা জানানো হয়েছে। তাদের এই নিষ্ক্রিয়তা বা ব্যর্থতার কারণ আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি, যখন ২০-৯-১৯ তারিখের দুটি দৈনিকের শীর্ষ শিরোনামে আমলা ও তথাকথিত জনপ্রতিনিধিদের এ ব্যাপারে জড়িত থাকার খবর পাই। একটি পত্রিকার শিরোনাম ছিল, ক্যাসিনোর টাকার ভাগ : ওসি, ডিসি, নেতা, ওয়ার্ড কমিশনারের পকেটে। আর অন্যটির শিরোনাম হল- পুলিশ পাহারায় চলত জুয়া।
আইন নিজস্ব গতিতে চলার কথা এবং কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয় বলে মানুষ জানে এবং সরকারও তাই বলে। কিন্তু তার ব্যত্যয় ঘটল কেন? এটা অনুমান করতে অসুবিধা হয় না, ব্যর্থতার মূলে আছে কিছু আমলা ও রাজনীতিকের ব্যক্তিগত লোভের দুর্বার তাড়না। তারাও এই দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের সুবিধাভোগী। তারাই এদের গডফাদার তথা আশ্রয় ও প্রশ্রয়দাতা। কিছুসংখ্যক আমলা ও রাজনীতিক, যাদের মধ্যে সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যও আছেন, তাদের বিপুল ধনসম্পদের খবর আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কানেও আসে। কিন্তু এসব ক্ষমতাধর ব্যক্তির বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস ও শক্তি সাধারণ মানুষের নেই। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়ায় সাধারণ মানুষ ও সুশীলসমাজ বেজায় খুশি। সন্ত্রাস ও দুর্নীতির মারাত্মক কুফলের ব্যাপারে তিনি কয়েকদিন আগে নিউইয়র্কে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সভায় চমৎকার বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি সভায় বলেছেন, ‘দুর্নীতি না হলে দেশের চেহারা পাল্টে যেত’।
কিন্তু প্রশ্ন হল, সব ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীকেই উদ্যোগ নিতে হবে কেন? তার অনেক কাজ। তাছাড়া দেশে আইন আছে, নিয়ম-কানুন আছে, আমলাদের দায়িত্ব-কর্তব্য নির্ধারিত আছে। তা পালিত হয় না কেন?
যাহোক, আমরা চাই চলমান এই অভিযান যেন বিএনপির অপারেশন ক্লিনহার্টের মতো স্বল্প সময়ের জন্য চমক সৃষ্টিকারী না হয়। এটা যেন ঝিমিয়ে না পড়ে। এটা যেন স্থায়ী একটি ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে এ ব্যাপারে মানুষের উৎকণ্ঠাও কম নয়। ১ অক্টোবর (২০১৯) থেকে সরকারি আমলাদের ব্যাপারে যে আইন কার্যকর হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া সরকারি কর্মচারীদের গ্রেফতার করা যাবে না। অথচ সবাই জানে ঘুষ-দুর্নীতির মূল হোতা হচ্ছে সরকারি কর্মকর্তারা। তাহলে তাদের ব্যাপারে এই সুবিধা প্রদান কেন? আশা করি সরকার ও জনবান্ধব প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করে দেখবেন। তাছাড়া রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও সত্য ও সততার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কারণ রাজনীতিক ও রাজনৈতিক দলগুলো রাষ্ট্রক্ষমতা চর্চা করে। তারা যদি সত্য ও সততার ধারক ও বাহক না হন, তাহলে আমলাতন্ত্রকে সত্য ও সততার পথে আনার ব্যাপারটি দুরূহ হয়ে পড়বে। সম্প্রতি একটি দৈনিকে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্ব কেনা-বেচার যে তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে তাদের চরম অবক্ষয়ের চিত্র উঠে এসেছে।
দেশ ও সরকার পরিচালনাকারী নেতারা যদি কেনা-বেচার বিষয় হন, তাহলে দুর্নীতি দূর হবে কী করে? কথায় আছে- যে শর্ষে দিয়ে ভূত তাড়াব, সে শর্ষেতে যদি ভূত থাকে তাহলে ভূত তাড়াব কী করে? তাই শর্ষের ভূত তাড়াতে হবে এবং আশা করি শ্রদ্ধেয় প্রধানমন্ত্রী তার দলে ভূত থাকলে, তাদের তাড়াবেন। অন্য দলগুলোও এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিলে দেশ ও দেশের মানুষ উপকৃত হবে। পরিশেষে আবারও বলব, অভিযান চলমান থাকুক।
মো. মইনুল ইসলাম : সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়