শতফুল ফুটতে দাও
ভগৎ সিং দেশপ্রেমের যে শিক্ষা দিয়েছেন
ড. মাহবুব উল্লাহ্
প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০১৯, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বাংলাদেশে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক ‘কথাবার্তা’ হয়। ‘কথাবার্তার’ চেয়ে আলোচনা আরও একটু গভীর পর্যায়ের। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিঃসন্দেহে দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশের একটি অনন্য ঘটনা। বস্তুত স্বাধীনতা ও মুক্তি অর্জনের জন্য একটি জাতি গোষ্ঠীর সমগ্র অংশের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ এ উপমহাদেশে অতীতে কখনও এমন আকারে ঘটেনি। এ সশস্ত্র যুদ্ধের ফলে উপমহাদেশের যে অংশে আমাদের বসবাস, অর্থাৎ বাংলাদেশে অনেক রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের এ তাৎপর্যগুলো নিয়ে সত্যিকার অর্থে মহৎ কোনো ডিসকোর্স হয়নি। কিন্তু হওয়াটা অত্যন্ত জরুরি ছিল। এ রকম একটি যুদ্ধ শুধু ইতিহাসের বিষয় নয়, এটাকে উপজীব্য করে রচিত হতে পারত বিশাল বিশাল উপন্যাস, এমনকি মহাকাব্যও। ১৯৭১ নিয়ে সিরিয়াস পর্যায়ের ডিসকোর্স আমরা তৈরি করতে পারিনি। তারও চেয়ে দুঃখের বিষয় হল, মনে হয় আমাদের ইতিহাসের যাত্রা শুরু হয়েছে ’৭১-এ।
আমরা নিজেদের হাজার বছরের বাঙালি হিসেবে দাবি করি। হাজার বছরের ইতিহাসটা কোথায়? পাণ্ডুরাজার ঢিপিতে দুই হাজার বছরের পুরনো বাঙালি বসতির সাক্ষ্য পাওয়া গেলেও তার পরবর্তীকালে বেশ দীর্ঘকালজুড়ে ইতিহাস যেন বিলুপ্ত হয়ে ছিল। যা এখনও বিলুপ্ত। দুই হাজার বছর আগের কথা বলব কী, এদেশের ক’জন নাগরিক, এমনকি শিক্ষিত নাগরিক ২০০ বছরের ইংরেজ শাসনের দুঃসহ অধ্যায় সম্পর্কে জানে। এই ২০০ বছরে বহু লড়াই সংগ্রাম হয়েছে।
একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় দেশাত্মবোধক গানের কলি হল, ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে কত প্রাণ হল বলিদান, লেখা আছে অশ্রুজলে।’ এমনই এক মহৎ প্রাণ ব্যক্তি যিনি দেশের জন্য মুক্তির মন্দির সোপান তলে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন, তিনি হলেন ভগৎ সিং। ২৮ সেপ্টেম্বর ছিল তার জন্মদিন। তাকে কি আমরা স্মরণ করেছি? এমন ত্যাগী বীরকে স্মরণ করতে ব্যর্থ হলে কিংবা বিস্মৃত হলে অন্য কাউকে স্মরণ করাও অর্থহীন ও তাৎপর্যহীন হয়ে যায়। দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশে এখন আর ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রাম নিয়ে তেমন কোনো কথাবার্তাও হয় না। বিষয়টি অত্যন্ত লজ্জাজনক। ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম না হলে এবং তার ফল হিসেবে ইংরেজ শাসকরা এদেশ থেকে বিতাড়িত না হলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমরা কোনো গর্ব করতে পারতাম কি?
ভগৎ সিং ছিলেন একজন বিপ্লবী নেতা। তিনি ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য লড়াই করেছিলেন। তিনি ছিলেন একজন মার্কসবাদী এবং বিচিত্র ধরনের গ্রন্থাবলি পাঠ করা বুদ্ধিজীবী। তিনি আইরিস, ব্রিটিশ, মার্কিন, রুশ, ভারতীয় ও ইউরোপীয় সাহিত্য পাঠ করেছিলেন। মাত্র ১২ বছর বয়সে জালিয়ানওয়ালা বাগের হত্যাকাণ্ড তাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। এ হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছিল একটি ঘেরাও দেয়া পার্কে, যেখান থেকে জনসাধারণের মূল দরজা ছাড়া অন্য কোনো পথে বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। ব্রিটিশ জেনারেল ডায়ারের নেতৃত্বে ও নির্দেশে ব্রিটিশ বাহিনী সেখানে এক নির্মম হত্যাকাণ্ড চালায়। এ হত্যাকাণ্ডে শত শত নারী, পুরুষ ও শিশু নিহত হয়েছিল।
ভগৎ সিং যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন কখনই তিনি জালিয়ানওয়ালা বাগের হত্যাকাণ্ডের বিষাদ স্মৃতি ভুলতে পারেননি। একটি প্রতিশোধস্পৃহা তার মনে কাজ করেছিল। ১৯২৮ সালে ভগৎ সিং আরেকজন মুক্তি সংগ্রামী লালা লাজপত-এর হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য ব্রিটিশ পুলিশ অফিসার জন স্যান্ডার্সের ওপর গুলি চালান। গুলি চালানোর পর ভগৎ সিং লিখেছিলেন, এ মানুষটির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এমন একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধির মৃত্যু ঘটল যেই প্রতিষ্ঠানটি খুবই নির্দয়, নীচ এবং অধঃপতিত। এ প্রতিষ্ঠানটিকে অবশ্যই উচ্ছেদ করতে হবে। এ মানুষটির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ভারতে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের একজন দালালের মৃত্যু ঘটল।
‘বধিররা যাতে কর্ণপাত করে’ তার জন্য তিনি এবং তার কমরেড বি কে দত্ত দিল্লির সেন্ট্রাল অ্যাসেম্বলিতে ২টি বোমার বিস্ফোরণ ঘটান। এর পরপরই তারা স্বেচ্ছায় গ্রেফতার বরণ করেন। ভগৎ সিং এবং তার কমরেড ডি কে দত্ত ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ভিত্তিতে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিলেন। এর ফলে ব্রিটিশ শাসকরা তাদের চিরতরে শেষ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ভগৎ সিং মাত্র ২৩ বছর বয়সে ২৩ মার্চ ১৯৩১ জীবন উৎসর্গ করেন।
আমির মালিক নামে একজন ভারতীয় সাংবাদিক তার জন্মদিবস উপলক্ষে তার বিপ্লবী ধ্যান-ধারণা স্মরণ করে ভগৎ সিংকে একটি খোলা চিঠি লিখেছেন। এ সাংবাদিক মনে করেন, ভগৎ সিংয়ের ধ্যান-ধারণা ব্রিটিশ শাসনামলের মতোই আজও প্রাসঙ্গিক। এ খোলা চিঠির ভাবানুবাদ এমন :
‘‘প্রিয় কমরেড ভগৎ সিং
শুভ জন্মদিন
৭০ বছর আগে ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে গেছে। আপনি সঠিকভাবেই বলেছিলেন যে, সাদা চামড়ার শাসকদের পরিবর্তে বাদামি চামড়ার শাসকদের ক্ষমতায় বসালে ভারত স্বাধীন হবে না। স্বাধীন হয়নি। আমি আপনাকে আপনার আত্মোৎসর্গ করার প্রায় ১ শতাব্দী পর লিখছি। এখন আপনাকে জানাতে চাই বাদামিদের পরিবর্তে গেরুয়া বসনধারীরা ভারতের শাসন ক্ষমতায় বসেছে। গেরুয়া রংটি অতি দক্ষিণপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকারের প্রতীক।
আপনার স্বপ্ন ও ধ্যান-ধারণা এ সময়ের ভারতের জন্যও প্রয়োজনীয়। কারণ ভারতীয় প্রশাসন এখন অতি দক্ষিণপন্থী বিজেপির হাতে। আপনার আত্মাহুতি ব্যর্থ হয়নি। ব্রিটিশ সরকার আপনার দৈহিক মৃত্যু ঘটিয়েছে। কিন্তু আপনার আদর্শের মৃত্যু ঘটাতে পারেনি। আপনি লিখেছিলেন, অপমানের মধ্যে বেঁচে থাকার চেয়ে মর্যাদার সঙ্গে মৃত্যুবরণ করাই শ্রেয়। আপনি বলেছিলেন, বধির কর্ণে কথা পৌঁছাতে হলে উচ্চ কণ্ঠে কথা বলতে হয়। এসব আপনি দেখিয়েছেন আপনার ‘লাল ইশতিহারে’।
এতে আপনি বলেছেন, ব্রিটিশ সরকার নতুন নতুন দমন ও নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে জননিরাপত্তা আইন, বাণিজ্য বিরোধ আইন এবং সংবাদপত্রে রাষ্ট্রদ্রোহিতা বিল। আপনার মতে এসব বিল ছিল অপমানকর প্রহসন। ব্রিটিশদের মতোই ভারতের বর্তমান অতি দক্ষিণপন্থী সরকার কাশ্মীর সংক্রান্ত সংবিধানের ৩৭০ ধারাটি বাতিল করেছে।
৮২ বছর বয়সী কাশ্মীরি নেতা ফারুক আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে প্রহসনমূলক জননিরাপত্তা আইন ব্যবহার করা হয়েছে। ফারুক আবদুল্লাহর জন্ম হয়েছিল ব্রিটিশ শাসনের শৃঙ্খল থেকে ভারতের বেরিয়ে আসারও আগে। এ সরকার ফারুক আবদুল্লাহকে অপমান করছে। আমলাতন্ত্র সম্পর্কে সাবধানবাণী উচ্চারণ করে আপনি ভগৎ সিং লিখেছিলেন, ‘পৃথিবীর তাবৎ সরকারের মধ্যে ব্রিটিশ সরকারগুলো সবচেয়ে অত্যাচারী। ভারতের গেরুয়া ব্রিগেড তার প্রভুর কাছ থেকে ছবক নিয়েছে।’
আমি এ সুযোগে আপনাকে জানাতে চাই যে, উগ্র দক্ষিণপন্থী এ সরকার দেশে বিদ্যমান শ্রম আইন পরিবর্তনের প্রস্তাব করেছে এবং ৪৪টি বিদ্যমান আইনকে ৪টি কোডে সমন্বিত করার পদক্ষেপ নিয়েছে। ফলে বিশাল কর্পোরেট হাউসগুলো আরও সম্পদশালী হবে এবং কোটি কোটি শ্রমিকের জীবন বিপন্ন হবে।
১৯২৬ সালে ট্রেড ডিসপিউট বিল দ্বারা ব্রিটিশ সরকার যে কোনো ধরনের ধর্মঘট নিষিদ্ধ করেছিল। শ্রমিক ধর্মঘটকে সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের শামিল বলে গণ্য করা হয়েছিল। এর ফলে শ্রমিকদের বিনা বিচারে সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়েছিল। ভারতের ফ্যাসিস্ট সরকার বলছে, শ্রমিকরা যদি কোনো প্রতিবাদ করতে চায় তাহলে ৪২ দিনের আগাম নোটিশ দিতে হবে। আগে এটা ছিল ১৪ দিন।
কাজেই গাণিতিকভাবে দেখা যাচ্ছে গেরুয়া শাসন ব্রিটিশ শাসনের চেয়ে ৩ গুণ বেশি অত্যাচারী। আপনি যে দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন সেই দেশকে ভয় দেখিয়ে নিস্তব্ধতায় নিক্ষেপ করা হচ্ছে। যারা আপনাকে অনুসরণ করে কথা বলার সাহস দেখায় তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদোহিতার অভিযোগ দেয়া হচ্ছে। সরকার বিদ্যমান সন্ত্রাসবিরোধী আইনের একটি সংশোধনী আনয়ন করেছে। এরা Unlawful Activities Prevention Act (UAPA) সংশোধন করেছে এবং ‘সন্ত্রাসবাদের’ অর্থ পরিবর্তন করেছে।
ন্যায়বিচারের নীতি অনুযায়ী বিচারে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেক ব্যক্তিই নির্দোষ এবং কর্তৃপক্ষকেই প্রমাণ করার দায়িত্ব নিতে হয় যে অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষী। বিচারের নিয়ম-নীতি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে সরকারবিরোধী দল কংগ্রেস এবং বহুজন সমাজ পার্টির সমর্থন নিয়ে সংশোধনী বিলটি পাস করেছে। এ আইন অনুযায়ী যে কোনো ব্যক্তিকে এজাহার, চার্জশিট এবং বিচার ছাড়াই সন্ত্রাসবাদী বলা যাবে। কমরেড, পৃথিবীর কোথায় এমন ঘটনা ঘটে, ব্রিটিশরা যখন আপনাকে একজন সন্ত্রাসবাদী আখ্যা দিল, তা যতই প্রহসনমূলক হোক না কেন তারা আপনাকে বিচারের কাঠ গড়ায় দাঁড় করিয়েছে। এখন এসব ব্যাপার সেকেলে হয়ে গেছে। আজকের দিনের ভগৎ সিং এত ভাগ্যবান নয় যে, সরকারের চেহারা উলঙ্গভাবে তুলে ধরবে। ভারতে রাষ্ট্রদ্রোহিতার বিষয়টি কি পরিহাসে পরিণত হয়নি?
প্রিয় কমরেড, আপনি জেনে সুখী হবেন যে, আমি আপনার খুরতুতো ভাই দেশবিখ্যাত অধ্যাপক জগমোহন সিংয়ের সঙ্গে আলাপ করেছি। তিনি বলেছেন, রাষ্ট্রদোহিতার ধারণাটি এসেছে এমন এক চিন্তা থেকে যেখানে শাসক ও শাসিত একে অপরের শত্রু। মান্ধাতার আমলের আইনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে সমালোচনা করার জন্য অথবা তার দলের বিরুদ্ধাচরণ করার জন্য শত শত ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সাংবাদিক এবং কর্মীরা জেলে পচে মরছে। কী করে সরকারের সমালোচনা রাষ্ট্রদ্রোহিতা হতে পারে? সুপ্রিমকোর্টের একজন জ্যেষ্ঠ বিচারক আমাকে বলেছেন যে, ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের এদেশ ছেড়ে যাওয়ার পরপরই রাষ্ট্রদোহিতা আইন বাতিল করা উচিত ছিল। কী করে একজন ভারতীয় তার নিজস্ব জনগণের বিরুদ্ধে বিদ্বিষ্ট হতে পারে?
প্রিয় কমরেড, আপনাকে অবশ্যই জানানো উচিত যে, এ সরকার ব্রিটিশদের দুর্গন্ধযুক্ত ধারাবাহিকতাকে সামনে এগিয়ে নিচ্ছে। শুধু তাই নয়, এগুলোকে বিভিন্ন সময়ে জোরদার করছে। অধ্যাপক জগমোহনের বক্তব্য থেকে সমতুল্য ধারণা ধার করে বলা যায়, ব্যাপারটি স্পষ্ট যে শাসকরাই জনগণের শত্রু, কিন্তু জনগণ শাসকদের শত্রু নয়। হয়তো বা অতীতের তুলনায় অনেক বেশি করে দেশের জন্য আপনার প্রয়োজন রয়েছে। হয়তো সময় এসেছে আপনার আবার আসার, যাতে করে উচ্চ কণ্ঠস্বর বধির কর্ণে প্রবেশ করতে পারে।
আপনারই একান্ত আমির মালিক।
৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯’’
ভগৎ সিংয়ের মতো আত্মত্যাগী পুরুষ বাংলাদেশেরও প্রয়োজন। কিন্তু এটা নিছক দূরাশাও হতে পারে। ইংরেজিতে একটি কথা আছে, ‘Eternal vigilance is the price of liberty’- স্বাধীনতা অর্জনের পর স্বাধীনতা রক্ষার জন্য চিরকাল জাগ্রত থাকতে হয়। আমরা কি সেই পবিত্র দায়িত্বটি পালন করছি? শাসকদের হাতে সবকিছু সমর্পিত করে আমরা কি নির্ঝঞ্ঝাট পুরনো ভৃত্যের মতো নিঃশব্দে সবকিছু সহ্য করছি? মনে হয় এরকম সুখী আর কখনও ছিলাম না!
ড. মাহবুব উল্লাহ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ