রাষ্ট্র নিয়ে যত কথা
আবুল কাসেম ফজলুল হক
প্রকাশ: ০২ অক্টোবর ২০১৯, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
গত ১৫ জুলাই আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের আমন্ত্রণে ‘হরপ্রসাদ-শহীদুল্লাহ দ্বিতীয় স্মারক বক্তৃতা’ প্রদান করি। সমাজবিজ্ঞান অনুষদ ভবনের মুজাফফর আহমদ চৌধুরী মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ওই বক্তৃতায় আমি প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলাম- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি রাষ্ট্রভাষা রূপে বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠা চায়?বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের প্রতি যত্নবান না হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি গৌরবজনক ভবিষ্যতে উত্তীর্ণ হতে পারবে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ কিংবা কোনো শিক্ষক, কিংবা ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্র ফেডারেশন ইত্যাদি সংগঠনের কোনো ছাত্রনেতা এ সম্পর্কে কোনো কথাই বলেন না।
যারা বিশিষ্ট নাগরিক, যারা গবেষক, লেখক, চিন্তাবিদ, শিল্পী-সাহিত্যিক, বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে তাদেরও কি কোনো বক্তব্য আছে? বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, শিশু একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, বিআইডিএস, এশিয়াটি সোসাইটি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানও এ প্রশ্নে নীরব।
বাংলাদেশে ইংরেজি ভাষার স্থান কী হওয়া উচিত? সরকারের ভাষানীতি কী? বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ভবিষ্যৎ কী? এ প্রশ্নে সততার সঙ্গে, আন্তরিকভাবে, অকপটে মতপ্রকাশ করার মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি কেউ কি আছেন এ দেশে?
বাংলা ভাষার প্রতি এক রকম পাইকারি দরদ অনেকেই প্রকাশ করেন। ফেব্রুয়ারি এলে সেই দরদ প্রকাশ অনেক বেড়ে যায়। আমি সে রকম দরদ প্রকাশের কথা বলছি না। আমি বলছি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার এবং রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার কথা।
যে কথাগুলো পূর্বোক্ত স্মারক বক্তৃতায় আমি বলেছিলাম তার কিছু আমি এখানে উল্লেখ করছি।
গোটা ঐতিহাসিক কালব্যাপী সর্বত্র দেখা যায়- মানুষের জীবনের সঙ্গে তার ভাষার কিংবা নিজের ভাষার সঙ্গে মানুষের জীবনের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। ভাষা ছাড়া জীবনযাপন চলে না। মানুষের আত্মবিকাশের একপর্যায়ে তার জীবনের বিমূর্ত অঙ্গরূপে দেখা দিয়েছে ভাষা।
দেখা যায়, জীবন যেখানে উন্নত ভাষাও সেখানে উন্নত এবং ভাষা যেখানে উন্নত জীবনও সেখানে উন্নত। ভাষার উন্নতি সাধিত হয় ভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টির এবং জাতীয় উন্নতির মধ্য দিয়ে। নিজের ভাষাকে উন্নত না করে কোনো ব্যক্তি কিংবা জাতি উন্নতি করতে পারে না। যে ব্যক্তি ভাষায় নিপুণ, সমাজে তার সাফল্য ও মর্যাদা বেশি।
আরও দেখা যায়- ভাষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান আর জ্ঞান-বিজ্ঞান ও ভাষা অবিচ্ছেদ্য। সাহিত্য, সঙ্গীত, শিল্পকলা ইত্যাদি সৃষ্টির মধ্যেও কাজ করে চিন্তা বা ভাষা। ভাষা থেকে চিন্তাকে কিংবা চিন্তা থেকে ভাষাকে আলাদা করা যায় না। অবশ্য ভাষা সৃষ্টির আগেও মানুষের অনুভূতি, চিন্তা ও আবেগ ছিল। কিন্তু ভাষা সৃষ্টির পর অবস্থা অন্যরকম হয়ে গেছে।
জাতি ও রাষ্ট্রের উন্নতির সঙ্গে ভাষার উন্নতি কিংবা ভাষার উন্নতির সঙ্গে জাতি ও রাষ্ট্রের উন্নতি অবিচ্ছেদ্য। কোনো জাতির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উন্নতি আর ভাষার উন্নতিও অবিচ্ছেদ্য। ভাষার উন্নতি আর চিন্তা-চেতনার উন্নতি এক ও অভিন্ন।
ভাষাকে উন্নত না করে আত্মনির্ভর, স্বাধীন, আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক উন্নতি সম্ভব হয় না। মানুষের জীবন ও পরিবেশ বিকাশশীল। ভাষাও বিকাশশীল। উন্নত জাতিগুলো তাদের ভাষার উন্নতির জন্য পরিকল্পনা নিয়ে অনেক কাজ করে। সাম্রাজ্যবাদীরা তৎপর থাকে নিজেদের ভাষার উন্নতি সাধনে, সেই সঙ্গে দুর্বল জাতিগুলোকে ভাষার দিক দিয়েও নির্ভরশীল রাখতে।
মানুষ ভাষা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না, ভাষা আয়ত্ত করে। ভাষা আয়ত্ত করার এবং ভাষাকে বিকশিত করার সামর্থ্য ইতিহাসজুড়ে এক অবস্থায় দেখা যায় না। মানুষ হয়ে-ওঠা প্রাণী। এই হয়ে-ওঠোর বা উন্নতির প্রক্রিয়া চলমান।
পরিবেশের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার, সেই সঙ্গে সমাজের অভ্যন্তরীণ বিরোধের মধ্য দিয়ে মানুষ বর্তমান অবস্থায় উত্তীর্ণ হয়েছে। মানুষের এই হয়ে-ওঠা, বা উন্নতির মূলে আছে ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত জীবনের ইচ্ছাশক্তি, চিন্তাশক্তি ও শ্রমশক্তি, চিন্তাই ভাষা, ভাষাই চিন্তা। চিন্তা ছাড়া ভাষা হয় না, ভাষা ছাড়া চিন্তা হয় না।
আদিতে মানুষের ভাষা ছিল না, মানুষই ভাষা সৃষ্টি করেছে। আদিম মানুষ যৌথ জীবনযাত্রার ও প্রকৃতির সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিজেদের প্রয়োজনে, নিজেদের জৈবিক সামর্থ্যরে বলে নিজেদের ভাষা সৃষ্টি করেছে এবং প্রয়োজনের তাগিদেই তারা তাদের ভাষাকে বিকশিত ও উন্নত করে চলছে। কেবল বাকযন্ত্রের ক্রিয়া দিয়ে ভাষার মর্ম বোঝা যায় না।
ভাষার সঙ্গে মানুষের গোটা অস্তিত্ব ও পরিবেশ জড়িত থাকে। ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত জীবনপ্রয়াসে মানুষের ইচ্ছাশক্তি, চিন্তাশক্তি ও শ্রমশক্তি একসঙ্গে কাজ করেছে ভাষা সৃষ্টিতে। ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, রুশ, চীনা, জাপানি, সংস্কৃত, হিব্রু, লাতিন, আরবি, ফারসি, বাংলা, উর্দু ইত্যাদি ভাষার ইতিহাস যতই সন্ধান করা যায়, ততই এটা বেশি করে বোঝা যায়।
মানুষ ছাড়া আর কোনো প্রাণীরই ভাষা সৃষ্টি করার মতো জৈবিক সামর্থ্য নেই। মানুষের মতো নিজেকে এবং নিজের পরিবেশকে উন্নত করার সামর্থ্যও আর কোনো প্রাণীর নেই।
দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয় এমন মাত্র ২০০ ভাষা দুনিয়ায় আছে। এসব ভাষা বিকাশমান। এগুলোর মধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্যের দিক দিয়ে বাংলা ভাষার স্থান এখনও উপরের দিকেই আছে। এগুলো ছাড়া বিভিন্ন মহাদেশে কয়েক হাজার ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী আছে; তাদেরও আলাদা আলাদা ভাষা আছে; তাদের ভাষা বিলীয়মান।
বাংলাদেশে পঁয়তাল্লিশটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর পঁয়তাল্লিশটি বিলীয়মান মাতৃভাষা আছে। এই পঁয়তাল্লিশটি জনগোষ্ঠীর মোট জনসংখ্যা বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার এক শতাংশের সামান্য বেশি। এরা জন্মের পর থেকেই নিজেদের ভাষার মতো বাংলা ভাষাও বোঝে। এদের বলা যায় দ্বিভাষিক।
বাংলা ভাষাকেই তারা উন্নতির অবলম্বন মনে করে। বিভিন্ন রাষ্ট্রের, এবং বাংলাদেশেরও, বিলীয়মান মাতৃভাষাগুলোকে রক্ষা করার চেষ্টা বাস্তবসম্মত নয়। এ ক্ষেত্রে ইউনেস্কোর প্রচার ও কাজ বাস্তবতাবিরোধী।
ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর লোকেরা জীবনযাত্রার ও উন্নতির প্রয়োজনে নিজেদের ভাষার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে বাংলা ভাষা শিখছে। এর মধ্যে রয়েছে তাদের উন্নতির সম্ভাবনা। বিভিন্ন রাষ্ট্রে ছড়িয়ে থাকা ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর উন্নতির ও মানবজাতির মূলধারায় আসার সুযোগ সর্বত্র বাড়াতে হবে। তাদের চিরকাল আদিবাসী করে রাখার নীতি বর্জনীয়।
আমাদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মূল চেতনা ও উদ্দেশ্য থেকে ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের উদ্দেশ্য ও কার্যক্রম ভিন্ন প্রকৃতির। এর দ্বারা রাষ্ট্রভাষা রূপে বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠা ব্যাহত হচ্ছে, রাষ্ট্ররূপে বাংলাদেশের গড়ে ওঠার সম্ভাবনাও নষ্ট হচ্ছে।
বিলীয়মান মাতৃভাষার উন্নতির জন্য রাষ্ট্রভাষা বাংলার উন্নতিকে স্থগিত রাখা ঠিক হবে না। নতুন ভবিষ্যৎ সৃষ্টিতে আমাদের এগোতে হবে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ধারা ধরে।
সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন, এনজিও ও ইউনেস্কো ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর উন্নয়নের জন্য যে পথপ্রদর্শন করে, যেসব পরিকল্পনা ও কার্যক্রম চালায়, অনেক সময় সেগুলো ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর উন্নতির অন্তরায় হয়।
ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোকে নিজেদের উন্নতির জন্য পার্শ্ববর্তী বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিলে রাষ্ট্র গঠন করতে হয় এবং রাষ্ট্রভাষা শিখতে হয়। তারা যদি বাইরে থেকে কিছুই গ্রহণ না করে এবং কেবল নিজেদের বিলীয়মান মাতৃভাষা ও অভ্যস্ত জীবনযাত্রা নিয়ে থাকে, তাহলে তারা কোনোকালেই উন্নতি করতে পারবে না। যে কোনো জনগোষ্ঠীর জন্যই না নিয়ে, না দিয়ে নিজেদেরকে নিজেদের মধ্যে গুটিয়ে রাখার ফল খারাপ হয়।
আত্মবিকাশের ও উন্নতির জন্য ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোকে বাইরে থেকে ভালো জিনিস গ্রহণ করতে হবে। নিজেদের উন্নতির প্রয়োজনে রাষ্ট্রভাষাকে নিজেদের মাতৃভাষার চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিয়ে তাদের জীবনব্যাপী আয়ত্ত ও বিকশিত করে চলা সমীচীন।
মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্রভাষা দ্বারা কেবল অফিসের ভাষা বোঝায় না, বোঝায় তার সঙ্গে আরও অনেক কিছু। রাষ্ট্রভাষার মধ্যে অফিস চালানোর ভাষা আছে, সেই সঙ্গে আছে জাতীয় জীবনে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টির ভাষা, আছে জাতির আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ভাষা। রাষ্ট্রভাষার উন্নতি হলে রাষ্ট্রের অন্তর্গত জাতির সভ্যতা উন্নত হয়।
কোনো ভাষার অর্থনৈতিক ভিত্তি বিকাশশীল থাকলে সে ভাষা বিকাশশীল থাকে। কোনো ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীই তার বিলীয়মান মাতৃভাষা নিয়ে জীবিকার ব্যবস্থা করতে পারে না। সাম্রাজ্যবাদীরা সাম্রাজ্যবাদী উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে বিলীয়মান মাতৃভাষাগুলোকে রক্ষা করার প্রচার চালিয়ে বাংলা ভাষার আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাষ্ট্রিক ভিত্তিকে দুর্বল করার চেষ্টা করছে।
আমাদের উপলব্ধি করা দরকার, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব ও উন্নতির জন্য রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার অস্তিত্ব ও উন্নতি অপরিহার্য। চলমান বহু ঘটনা আছে যেগুলো দেখে বলা যায়, রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা না টিকলে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ টিকবে না।
দেশ থাকবে, মাটি-মানুষ-গাছপালা-পশুপাখি-নদীনালা ও আকাশ-বাতাস থাকবে, কিন্তু রাষ্ট্র থাকবে না। যারা বাংলাদেশে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার বদলে ইংরেজি চান, তারা রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে রক্ষা করার প্রশ্নে মনোযোগী নন।
দেশ ও রাষ্ট্র এক নয়। দেশ প্রকৃতির সৃষ্টি, রাষ্ট্র মানুষের। আমাদের রাষ্ট্র না থাকলে, কেবল দেশ থাকলে আমরা কি ভালো থাকব? নিজেদের রাষ্ট্র না থাকলে আমরা কি স্বাধীন থাকব? ১৯৭১ সালে কেন আমরা স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছিলাম?
ছয় দফা আন্দোলনে কেন আমরা যোগ দিয়েছিলাম? কেন আমরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করেছিলাম? কেন আমরা ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হতে চেয়েছিলাম? বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে গড়ে তোলার লক্ষ্য বাদ দিয়ে চললে এসব চাওয়া অর্থহীন হয়ে যায়।
ভৌগোলিক বাস্তবতা ও বাঙালি চরিত্র লক্ষ করে ১৯৭৩ সাল থেকেই কোনো কোনো চিন্তাশীল ব্যক্তি বলে আসছেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকার মতো নয়। তারা জোর দিয়েছেন বাঙালি চরিত্রের নিকৃষ্টতায়।
তাদের যুক্তি ও মত কখনও আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। তারা অনেকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় নাগরিকত্ব নিয়েছেন এবং প্রায় সবাই তাদের সন্তানদের ওইসব রাষ্ট্রে নাগরিক করেছেন।
আমি সবসময় বাঙালি চরিত্রের উন্নতি সম্ভব বলে মনে করেছি। আমি সবসময় মনে করেছি এবং এখনও মনে করি বাংলাদেশকে অবশ্যই দেশের জনগণের প্রগতিশীল রাষ্ট্ররূপে গড়ে তোলা যাবে। সে লক্ষ্যেই আমাদের চিন্তা ও কাজ।
জাতীয় হীনতাবোধ বাংলাদেশের ধনী-গরিব, শিক্ষিত-শিক্ষাবঞ্চিত, ক্ষমতাবান-ক্ষমতাবঞ্চিত সব মানুষকে ভেতর থেকে কুরে কুরে খাচ্ছে। জনসাধারণ ঘুমন্ত। জাতীয় হীনতাবোধ থেকে জাতিকে মুক্ত করতে হবে। ঘুমন্ত জনসাধারণকে জাগাতে হবে। অবস্থার উন্নতির জন্য যা কিছু দরকার, সবই আমাদের করতে হবে।
সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশনগুলো বাংলাদেশের রাজনীতিকে বৃহৎ শক্তিবর্গের স্থানীয় দূতাবাস-অভিমুখী করে দিয়েছে। বড় দুই রাজনৈতিক দল জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের কথা না ভেবে দূতাবাসমুখী রাজনীতি নিয়ে চলছে।
বাংলাদেশের সব প্রচারমাধ্যম ১৯৮০ ও ’৯০-এর দশকে বিবিসি রেডিওর অন্ধ অনুসারী হয়ে কাজ করেছে। বিরোধী দলগুলোও তাই করেছে। ক্ষমতার বাইরে থাকাকালে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রতিনিধিরা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সাহায্যের আবেদন নিয়ে ক্রমাগত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার এবং ভারতেরও স্থানীয় দূতাবাসগুলোয় গণতন্ত্রের জন্য সাহায্য চাইতে যান।
তারা চলে যান যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের নির্দিষ্ট ডেস্কে। জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্যও একটি দলের নেতারা নিউইয়র্কে জাতিসংঘের হেড অফিসে গিয়ে তদবির করেছেন।
সাম্রাজ্যবাদী অর্থ সংস্থাগুলো ‘দাতা সংস্থা’ ও উন্নয়ন-সহযোগী নাম নিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণে যুক্ত হয়। উচ্চ ও উচ্চমধ্য শ্রেণির লোকেরা, সরকারি ও সরকারবিরোধী উভয় মহল, তাদের ছেলেমেয়েদের যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি রাষ্ট্রের নাগরিক করে চলেছেন। মন্ত্রিপরিষদ, জাতীয় সংসদ, প্রশাসন ব্যবস্থার উচ্চপর্যায়, বিচারব্যবস্থার উচ্চপর্যায়, শিক্ষাব্যবস্থার উচ্চপর্যায়, পুলিশ-র্যাব, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর উচ্চপর্যায় লক্ষ করলেই এটা দেখা যায়।
এই ব্যক্তিরাই বাংলাদেশে রাষ্ট্রব্যবস্থার ও ব্যবসা-বাণিজ্যের কর্তৃত্বে আছেন। সরকার গঠন ও রাজনীতির যে অবস্থা তা বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র বলে প্রমাণ করে না। বাংলাদেশে একদিকে আছে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ব্রিটিশ কাউন্সিল ও ক্যামব্রিজ বিদ্যালয়ের মাধ্যমে পরিচালিত ও-লেভেল, এ-লেভেল এবং অপরদিকে আছে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নব-প্রবর্তিত ইংলিশ ভার্সন।
কওমি মাদ্রাসা ও আলীয়া মাদ্রাসা আছে। বাংলা মাধ্যমের ধারাকে গুরুত্ব কম দেয়া হচ্ছে। এ শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষানীতি বাংলাদেশের ভূভাগে জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
এসব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও নতুন রেনেসাঁস ও এর ধারাবাহিকতায় নতুন গণজাগরণ সৃষ্টি করে, সেই সঙ্গে উন্নত চরিত্রের রাজনৈতিক নেতৃত্ব সৃষ্টি করে, বাংলাদেশের জনগণ অবশ্যই বাংলাদেশকে নিজেদের প্রগতিশীল রাষ্ট্ররূপে গড়ে তুলতে পারবে। জনগণ ঘুমিয়ে আছে বটে তবে জাগবে।
অভীষ্ট নেতৃত্বের জন্য অবশ্যই উন্নত চরিত্রের রাজনৈতিক দল গড়ে তুলতে হবে। বর্তমান দলগুলোও চাইলে তাদের রাজনৈতিক চরিত্র উন্নত করতে পারে। নেতৃত্বের জন্য রাজনৈতিক দল অপরিহার্য। দলের চরিত্রই নেতৃত্বের চরিত্র। রেনেসাঁসের জন্য উন্নত চরিত্রের বৌদ্ধিক নেতৃত্বও লাগবে।
নিকৃষ্ট বৌদ্ধিক চরিত্রের বুদ্ধিজীবীদের বা বিশিষ্ট নাগরিকদের দিয়ে রেনেসাঁস সম্ভব নয়। রাষ্ট্র গঠনের ও রাষ্ট্রীয় উন্নতির জন্য রাষ্ট্রভাষা রূপে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত ও উন্নত করার সার্বিক আয়োজন লাগবে।
রাজনীতির জন্য বাংলা ভাষায় উন্নত রাষ্ট্রচিন্তা ও রাজনৈতিক দলে তার অনুশীলন লাগবে। ১৯৮০-র দশকের শুরু থেকে নিঃরাজনীতিকরণের যে প্রক্রিয়া বাংলাদেশে চালানো হচ্ছে, তার জায়গায় উন্নত নতুন রাজনীতির সূচনা করতে হবে। নিঃরাজনীতিকরণের কার্যক্রম কারা কীভাবে চালাচ্ছে, পরিপূর্ণ গুরুত্ব দিয়ে তা বুঝতে হবে।
জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের প্রয়োজনে শিল্প খাতে শর্তযুক্ত সবরকম বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্য পরিহার করে চলতে হবে। প্রচলিত শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কার অপরিহার্য। প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যসূচি, পাঠক্রম ও পাঠ্যপুস্তক উন্নত করতে হবে। কথিত সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতির জায়গায় অনুসন্ধিৎসামুখী, জ্ঞানমুখী পরীক্ষা পদ্ধতি প্রবর্তন করতে হবে। ইংলিশ ভার্সন বিলুপ্ত করতে হবে।
বাংলাদেশে বিদেশি সরকার কর্তৃক পরিচালিত সব স্কুল বন্ধ করতে হবে। মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে বিতর্ক, যতটা সম্ভব, এড়িয়ে চলতে হবে। সর্বজনীন কল্যাণে প্রথমে বাংলা মাধ্যমের শিক্ষাকে উন্নত করতে হবে।
প্রাথমিক শিক্ষার পর থেকে পর্যায়ক্রমে পেশামূলক শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটাতে হবে। অনেকে বিশ্বমান অর্জনের কথা বলেন। তারা যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতি নির্বিচারে অনুসরণ করে চলার কথা বলেন। এটা ঠিক নয়। উচ্চশিক্ষার লক্ষ্য ও নীতিবিধি সংস্কার করতে হবে। চলমান শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে জাতি ও রাষ্ট্র গড়ে উঠছে না, উঠবে না।
বাংলা উন্নত ভাষা। এর ভিত্তিতে আছে আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাষ্ট্রিক বিরাট সম্ভাবনা। এ ভাষাকে তুচ্ছ জ্ঞান করে ইংরেজি ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করে বাংলাদেশে রাষ্ট্র গঠন সম্ভব হবে না।
বাংলাদেশের উন্নতির জন্য ইংরেজি ও আরও কয়েকটি বিদেশি ভাষা শেখার ভালো ব্যবস্থা বাংলাদেশে করতে হবে। ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষার মাধ্যমে জ্ঞান আহরণ করে তা দিয়ে বাংলা ভাষার জ্ঞান ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করতে হবে।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবার সময় চলে যাচ্ছে। সময় থাকতে চিন্তা ও কাজ করতে হয়, সময় চলে গেলে সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যায়। আজকের মূল প্রশ্ন- বাংলাদেশকে আমরা রাষ্ট্ররূপে গড়ে তুলব কী তুলব না।
যদি সিদ্ধান্ত হয় গড়ে তুলব, তাহলে সময় নষ্ট না করে কাজ আরম্ভ করতে হবে। রাষ্ট্র গঠনের জন্য চেষ্টা লাগবে। বাংলাদেশের জনগণের চেতনায় নিজেদের রাষ্ট্র গঠনের মহান লক্ষ্য দরকার। যারা রাষ্ট্র গঠনে গুরুত্ব দিতে চান না, তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি।
একুশে ফেব্রুয়ারিকে উদযাপন করতে হবে রাষ্ট্রভাষা দিবস রূপে। রাষ্ট্রভাষা দিবস উদযাপনের মধ্য দিয়ে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের এবং রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নবচেতনা সৃষ্টি করতে হবে।
বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে এবং বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা রূপে প্রতিষ্ঠা করার জন্য বহুমুখী কার্যক্রম আরম্ভ করা দরকার। বাংলাদেশে এটাই এখন প্রগতির দাবি।
আবুল কাসেম ফজলুল হক : প্রগতি প্রয়াসী চিন্তাবিদ; সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়