Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

শতফুল ফুটতে দাও

‘ঋষিতুল্য’দের কপালে কলঙ্কতিলক

Icon

ড. মাহবুব উল্লাহ্

প্রকাশ: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

‘ঋষিতুল্য’দের কপালে কলঙ্কতিলক

স্কুলে পড়ার সময় ইংরেজির শিক্ষক একটি Translation শিখিয়েছিলেন। সেটি হল, ‘সেই রামও নেই! সেই অযোধ্যাও নেই।’ বাক্যটিকে ইংরেজি ভাষায় রূপান্তরিত করা। ইংরেজিতে লিখলে বাক্যটি হবে ‘oh the man, oh the time!’ কথাটি যে কত সত্য, সেটা তখন অনুভব করিনি। এখন চারদিকে যা ঘটছে তা দেখে মনে হয়, ছোট বেলায় Translation পড়তে গিয়ে যে বাক্যটির সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল, তার তাৎপর্য কত গভীর। পাঠক নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, ইংরেজি বাক্যটির কোথাও ‘রাম’ কিংবা ‘অযোধ্যা’ শব্দ দুটি নেই।

এককথায় বলা যায়, এক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষাটি খুবই স্মার্ট। রাম মানুষের প্রতীক, আর অযোধ্যা সময়ের প্রতীক। বাক্যটির অর্থ হল, মানুষ ও সময় দুটোই বদলে গেছে। কিছুদিন আগে যুগান্তরে কলাম লিখতে গিয়ে পুরনো হিন্দি ছবির গানের একটি ছত্র উল্লেখ করেছিলাম। সেখানে ছিল, ‘চাঁদ না বাদ্লা, সুরাজ না বাদলা, কিত্না বাদ্ল গেয়া ইনসান। চাঁদ ও সূর্য কিছুরই কোনো পরিবর্তন হয়নি, কিন্তু মানুষ কীভাবে বদলে গেছে! এটা অন্তরাত্মার হাহাকার ছাড়া আর কিছু নয়।

আমার বাবার কাছে এক ন্যাংটা ফকিরের গল্প শুনেছিলাম। তার নাকি আধ্যাত্মিক ক্ষমতা ছিল। তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আপনি নির্বস্ত্র থাকেন কেন? জবাবে তিনি বলেছিলেন, মানুষ বস্ত্র পরিধান করে লজ্জা ঢাকার জন্য। মানুষ কার কাছে লজ্জা পায়? মানুষ লজ্জা পায় মানুষের কাছে। আমার চারপাশে যত লোকজন দেখছি এরা তো কেউ সত্যিকার অর্থে মানুষ নয়। এদের জানোয়ার বা হাইওয়ান বললে অত্যুক্তি হবে না। এই একই ফকির একদিন একজনকে তার দিকে আসতে দেখে অস্থির হয়ে লজ্জা ঢাকার জন্য কাপড় খুঁজছিলেন।

কারণ ওই মানুষটি ছিল সত্যিকারের মানুষ। এমন মানুষের সামনেই তো লজ্জাবোধ জাগ্রত হয়। আমাদের সমাজের কিছু মানুষ, সংখ্যায় যে খুব কম তা-ও নয়, এতই অধঃপতিত হয়ে পড়েছে যে এদের পশুর সঙ্গেই তুলনা করা যায়। গ্রিক দর্শনে বলা হতো, Man is a rational animal. মানুষের মধ্যে animality ও rationalityও আছে। animality-এর মাত্রা যদি rationalityকে ছাড়িয়ে যায়, তাহলে মানুষ ও পশুতে তফাত খুব একটা থাকে না।

মাঝে মাঝে চারদিকের অবস্থা দেখে মনে হয়, হিন্দুশাস্ত্রে চক্রাকার যে সময়ের কনসেপ্ট আছে সেটা বোধহয় সঠিক। হিন্দুশাস্ত্রে চারটি কাল পর্যায়ের কথা বলা আছে। এগুলো হল যথাক্রমে, সত্য যুগ, দাপর যুগ, ত্রেতা যুগ এবং কলি যুগ। এখন নাকি কলি যুগ চলছে। সেজন্যই আমরা চারদিকে অবাঞ্ছিত ঘটনাবলি, অনৈতিক আচরণ এবং ভয়ানক লোভ-লালসা দেখতে পাচ্ছি। বাংলাদেশে খুন-খারাবি, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দুর্নীতি এবং দুর্বিনীতের যে আস্ফালন লক্ষ করছি, তার মাঝে ভাবতে অবাক লাগে আমরা এখনও বেঁচে আছি।

আবারও বলছি, ছোটবেলায় স্কুলে পড়ার সময় আমাদের শিক্ষকরা এবং অন্য গুরুজনরা বলতেন, ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর বা উপাচার্য একজন অতি জ্ঞানী এবং ঋষিতুল্য ব্যক্তি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে মাত্র দুইজন উপাচার্য ছিলেন। একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং অপরজন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের। তখন পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়নি। উপাচার্যদের সম্পর্কে অতি উচ্চ ধারণা এমনি এমনি হয়নি। জেঙ্কিংস সাহেব নামে একজন উপাচার্য ছিলেন।

তাকে নাকি একবার শিক্ষা সচিব সচিবালয়ে টেলিফোনে মিটিংয়ে আসতে বলেছিলেন। টেলিফোনের জবাবে তিনি বলেছিলেন, Who is speaking? If you are the secretary of education, you are nobody to summon the vice-chancellor of Dacca University to a meeting. The vice-chancellor is only second to the chancellor who is the governor of the province. এভাবে সে সময়ের উপাচার্যরা নিজেদের আত্মমর্যাদা বজায় রাখতেন। আচার্য শব্দের অর্থ বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে লেখা হয়েছে, ১. যিনি কোনো শাস্ত্রে জ্ঞান অর্জন করে তদনুরূপ আচরণ করেন তাকে ‘আচার্য’ বলে- এই আচরণের মধ্যে শিক্ষাদানই প্রধান (বিজ্ঞানাচার্য)। ২. হিন্দু ধর্মের শিক্ষাগুরু (আচার্যের আসন)। ৩. যিনি শিষ্যকে বেদ পড়ান। ৪. গণক ব্রাহ্মণ।

বাংলাদেশে আচার্যের আসনটি রাষ্ট্রপতির। তারপরেই আসেন উপাচার্য। আচার্য শব্দের যেসব অর্থ লেখা হয়েছে, সেগুলোর অতি কাছেই উপাচার্যের অবস্থান। আজকাল পত্রপত্রিকায় উপাচার্যদের সম্পর্কে যেসব খবর পড়ি, তাতে মানসিকভাবে প্রচণ্ড হোঁচট খাই। দেশটার হয়েছে কী? কেউ কি পরিকল্পিতভাবে উচ্চতম বিদ্যাপীঠগুলোয় কলঙ্কের কাদা মাখিয়ে দেশটাকে বিশ্বসভায় নতমুখ করে ফেলছে? আরেকজন পূজনীয় উপাচার্যের কথা বলি। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মাহমুদ হোসেন। তিনি ভারতের পরলোকগত রাষ্ট্রপতি ড. জাকির হোসেনের অনুজ ছিলেন।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর আবদুল মোনায়েম খান ঢাকা কলেজে অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে তার বিরুদ্ধে কালো পতাকা ও বিক্ষোভ প্রদর্শনের অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্রকে (পরবর্তীকালে নামকরা রাজনীতিক) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের জন্য ড. মাহমুদ হোসেনের ওপর চাপ দেন। কিন্তু ড. মাহমুদ হোসেন সেই চাপের কাছে নতিস্বীকার না করে উপাচার্যের পদ থেকে পদত্যাগ করেন।

তার বক্তব্য ছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের বাইরে কোনো ঘটনার জন্য তিনি কোনো ছাত্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন না। ব্যবস্থা যদি নিতেই হয়, তাহলে সেটা পুলিশের কাজ হবে। তার পদত্যাগের পরদিন তৎকালীন পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় ফার্স্ট লিড নিউজ হয়েছিল, ‘I cannot police over my students’, says DU vice-chancellor. এ রকম মেরুদণ্ডসম্পন্ন ও ব্যক্তিত্বসম্পন্নদেরই উপাচার্য হওয়া উচিত। ব্যক্তিত্বহীন ব্যক্তিরা যদি ভিসির পদটি অলংকৃত করেন, তাহলে সেটা অলংকারের কাজ না হয়ে কলঙ্কের কাজ হবে।

২৫ সেপ্টেম্বরের একটি দৈনিকে শিরোনাম হয়েছে, পাবলিক ভার্সিটির ১৭ ভিসির অনিয়ম তদন্তে ইউজিসি। এদের সম্পর্কে অভিযোগ তুলে ধরতে গিয়ে পত্রিকাটি লিখেছে, ১. বেশির ভাগ অভিযোগ নিয়োগে অনিয়ম স্বজনপ্রীতি। ২. নিয়োগ নীতিমালার তোয়াক্কা না করা। ৩. আর্থিক অনিয়ম-অস্বচ্ছতা সব ভিসির বিরুদ্ধে। সংবাদে বলা হয়, ইউজিসি সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত ১৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা করার পর এগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। দুদক সম্পর্কে সংস্থাটির এক সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান দুঃখ করে বলেছিলেন দুদক হচ্ছে দন্ত-নখরহীন বাঘ।

এখন প্রশ্ন হল- ইউজিসির অবস্থাটা কী? এর কি দাঁত গজিয়েছে, নখ বড় হয়েছে? কামড় দিতে পারবে কিংবা আঁচড় কাটতে পারবে? তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দেখভালের দায়িত্ব যদি ইউজিসি সঠিকভাবে পালন করে তাহলে তার চেয়ে কাম্য আর কী হতে পারে? একটা কথা আছে- জ্বর সারাবে কুইনাইন, কিন্তু কুইনাইন সারাবে কে? ইউজিসি কতদূর কী করতে পারবে কী পারবে না, তা নির্ভর করে Man behind the plough, এর ওপর। অর্থাৎ লাঙল যে চালায় তার পেছনের মানুষটি কে?

তেমনি ইউজিসিতে ড. মাহমুদ হোসেনের মতো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নেতৃত্ব থাকলে কিছু করা যাক বা না যাক ঝাঁকুনিটা তো অন্তত দেয়া যাবে। এদিকে বঙ্গবন্ধু প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে ‘দীর্ঘদিনের ক্ষোভ থেকে এক দফার আন্দোলন’ (প্রথম আলো, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯)। এক্ষেত্রেও উপাচার্যের বিরুদ্ধে নিয়োগ ও ভর্তি থেকে শুরু করে বিস্তর অভিযোগ। শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি করছে। পত্রিকায় আরও লেখা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ভেবেছিল, দুটি ঘোষণা করলেই আন্দোলন থেমে যাবে। কিন্তু হয়েছে উল্টো।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন একটাই স্লোগান, ‘উপাচার্যের পদত্যাগ চাই।’ দেশের মানুষ কোনো অঘটন ঘটলে মন্ত্রীর পদত্যাগ চায়, প্রশাসনিক কর্মকর্তার পদত্যাগ চায়। কিন্তু উপাচার্য, যার জ্ঞানতাপস হওয়ার কথা, যিনি হবেন ঋষিতুল্য, তার যখন পদত্যাগের দাবি তোলেন তারই ছাত্ররা, তখন বুঝতে হবে দেশ ও সমাজ ভয়াবহ কোনো রোগে আক্রান্ত হয়েছে।

ড. মাহ্বুব উল্লাহ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম