এখনও প্রাসঙ্গিক ‘আবার তোরা মানুষ হ’

এ কে এম শামসুদ্দিন
প্রকাশ: ২৩ মে ২০১৯, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

পাবনা সরকারি শহীদ বুলবুল কলেজের শিক্ষককে মারধরের ঘটনায় আটক দুই ছাত্র। ফাইল ছবি
১৬ মে বাংলাদেশের বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত পাবনা সরকারি শহীদ বুলবুল কলেজে পরীক্ষা চলাকালে খাতা দেখে লিখতে না দেয়ায় বাংলা বিভাগের প্রভাষক মাসুদুর রহমানের ওপর হামলা, মারধর ও লাঞ্ছনার খবরটি যখন পড়ছিলাম, তখন ১৯৭৩ সালের একটি বাংলা ছবির কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। ছবির নাম ‘আবার তোরা মানুষ হ’। পরিচালক ছিলেন প্রথিতযশা চলচ্চিত্র পরিচালক খান আতাউর রহমান।
সিনেমার একটি দৃশ্যে দেখা যায়, পরীক্ষা চলাকালে একজন ছাত্র নকল করে খাতায় লিখতে গেলে পরীক্ষা হলে উপস্থিত শিক্ষক তাকে বাধা দেন, তাতে ছাত্রটি ক্ষিপ্ত হয়ে কোমর থেকে একটি ড্যাগার (বিশেষভাবে তৈরি ছুরি) বের করে তার খাতার পাশে রেখে দেয়।
এ দৃশ্যটি এতদিন পরও আমার মনে আছে। কারণ আমি যে মহল্লায় থাকতাম, তার পাশেই অবস্থিত নটর ডেম কলেজে ওই দৃশ্যটি ধারণ করা হয়েছিল। সে সময় স্কুলপড়ুয়া ছাত্র হলেও আমি ছবির ওই অংশের শুটিং দেখে খুব খুশি হয়েছিলাম।
কারণ, নকলবাজ ওই ছাত্রটির ভূমিকায় তখন অভিনয় করেছিলেন নায়ক ফারুক, যিনি বর্তমানে ক্ষমতাসীন দলের একজন মাননীয় সংসদ সদস্য। আর তার আশপাশে যারা পরীক্ষা দেয়ার অভিনয় করেছিলেন তাদের বেশিরভাগ অভিনেতাকেই তখন টেলিভিশনে দেখা যেত।
তারা হলেন রাইসুল ইসলাম আসাদ, আল্ মনসুর, টেলিভিশন ঘোষক সরকার ফিরোজ, প্রখ্যাত নৃত্য পরিচালক ও অভিনেতা আমিরুল ইসলাম বাবু প্রমুখ। একসঙ্গে এতজন অভিনেতাকে চাক্ষুষ দেখে ওই ছোট বয়সে নিজেকে বেশ ভাগ্যবান মনে হয়েছিল।
‘আবার তোরা মানুষ হ’ সিনেমাটি তখনকার যুবসমাজের অস্থিরতাকে নিয়ে নির্মিত হয়েছিল। একদল তরুণ মুক্তিযোদ্ধার বেকারত্ব ও হতাশা থেকে জন্ম নেয়া সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি পুঞ্জীভূত ক্ষোভ প্র্রশমন করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার আহ্বান জানানোই ছিল চলচ্চিত্রটির গল্পের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় বা উদ্দেশ্য।
স্বাধীনতার পরপর দেশে বিরাজমান বাস্তব পরিস্থিতিকে উপজীব্য করে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘আবার তোরা মানুষ হ’ সাধারণ দর্শক ভালোভাবেই গ্রহণ করেছিল। কারণ সিনেমাটি দেখার জন্য তখন প্রেক্ষাগৃহগুলোতে মানুষের ভিড় দেখেছি অনেকদিন।
পাঠক, ছোটবেলায় নকল করতে বাধা দেয়ায় শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার শুটিংয়ের দৃশ্য দেখে যতটুকু না থ্রিলড হয়েছিলাম, বর্তমানে পরিণত বয়সে নকল করতে না দেয়ায় চড়-থাপ্পড়, ঘুষি ও ফ্লাইং কিক মেরে পাবনার সরকারি কলেজের সম্মানিত শিক্ষককে যেভাবে অপমান ও অসম্মান করা হল, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সে দৃশ্য দেখে তার চেয়েও বেশি বিচলিত হয়েছি।
ভিডিও ক্লিপটি দেখার পর মনে হয়েছে, ইস্ এ দৃশ্যটি যদি বাস্তবে না হয়ে ছোটবেলায় দেখা চলচ্চিত্রের শুটিংয়ের কোনো অংশ বা দৃশ্য হতো, তাহলে আমার মতো সমাজের অনেকের তা মর্মপীড়ার কারণ হতো না।
ফেসবুকে এ দৃশ্য দেখে অনেকেই অনেক বিরূপ মন্তব্য করেছেন। এর মধ্যে একজনের মন্তব্য আমার দৃষ্টি কেড়েছে। মন্তব্যটি হল, ‘এরা ছাত্র নামের কলঙ্ক, এরা ছাত্র না, এরা কুলাঙ্গার!’ বাংলা একাডেমির আধুনিক বাংলা অভিধান অনুযায়ী কুলাঙ্গার শব্দটির অর্থ হল, চরিত্র দোষে কলঙ্কিত অথবা বংশের কলঙ্ক।
এ চরিত্রের সন্তানরা সাধারণত বাবা-মা’র অবাধ্য হয়ে থাকে। এরা তাদের অপকর্মের দ্বারা বংশের মুখে কালিমা লেপন করে। আমাদের সমাজে এদের ‘কুলাঙ্গার সন্তান’ বলে ডাকা হয়। এ মন্তব্যটি পড়ে অন্য আরও একজন ফোড়ন কেটে ফেসবুকে লিখেছেন, ‘না না এরা কুলাঙ্গার না, এরা ছাত্রলীগ!’
পাবনা সরকারি কলেজের ঘটনার পরদিন আমি একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় ভালো করে লক্ষ করে দেখলাম, শিক্ষকের সঙ্গে অপকর্মটি যারা করেছে ‘তারা ছাত্রলীগের কর্মী।’ ফেসবুকের মন্তব্যটি পড়ে মনে হয়েছে, একটি সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের সদস্যদের কর্মকাণ্ডে সাধারণ মানুষ কতটুকু ক্ষুব্ধ হলে তাদের নির্দ্বিধায় ‘কুলাঙ্গার’ বলে অভিহিত করে।
শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠায়, জেলা ছাত্রলীগ সরকারি শহীদ বুলবুল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের কমিটি স্থগিত করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি করেছে। এ ব্যাপারে স্থানীয় থানায় একটি মামলাও হয়েছে।
দেশজুড়ে ছাত্রলীগ কর্মীদের ধারাবাহিক অপকর্মের কাহিনী এদেশের মানুষের এখন গা-সহা হয়ে গেছে। তাদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে সমাজের সাধারণ মানুষ এখন বিরক্ত, ভীতসন্ত্রস্ত। তাদের এসব অপকর্মের সরাসরি প্রতিবাদের শক্তিও যেন মানুষ দিন দিন হারিয়ে ফেলছে! এ কারণেই অপদস্ত ও অপমাণিত হওয়া সত্ত্বেও নিজ কলেজের ছাত্রলীগের কর্মীদের নাম মুখে নিতে সাহস পাননি নকলে বাধা দিয়ে লাঞ্ছিত হওয়া শিক্ষক মাসুদুর রহমান।
ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি একবারের জন্যও অপরাধীদের নাম উচ্চারণ করার সাহস পাননি। তিনি যে ভীতসন্ত্রস্ত তা প্রকাশ পেয়েছে তারই দেয়া বক্তব্যে, ‘আমার ওপর কেন হামলা হয়েছে, কীভাবে হামলা হয়েছে, কারা হামলা করেছে, এর সবই ভিডিও ফুটেজে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। কিন্তু বিভিন্ন ভয়ভীতির কারণে আমি কিছু বলতে পারছি না। আমাকে প্রতিনিয়ত নজরদারিতে রাখা হয়েছে। তাই একজন শিক্ষকের ওপর হামলা যদি রাষ্ট্রের কাছে অসম্মানের হয়, তবে আশা করি রাষ্ট্র এর বিচার করবে।’
আইনের শাসনের অভাব এবং সরকারের একচোখা নীতির কারণে দেশজুড়ে ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ-সংগঠনগুলোর দৌরাত্ম্য এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সাধারণ মানুষ আজ অসহায় হয়ে পড়েছে। এদেশের নাগরিক হিসেবে মানুষ যে কত অসহায় এবং নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে তা শুধু গত মাসে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার বর্ণনা দিলে পরিষ্কার হবে।
এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ফেনী জেলার ফুলগাজী আলিম মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহানকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার প্রধান হোতা ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা। জামায়াতের নেতা হয়েও ক্ষমতাসীন দলের নেতা রুহুল আমিন ও কাউন্সিলর মকসুদুল আলমের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় সে দীর্ঘদিন ধরে দোর্দণ্ড প্রতাপে অপকর্ম চালিয়ে আসছিল। এমনকি এসব গডফাদারের নির্দেশনায় নুসরাতের ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টাও করা হয়। শেষ পর্যন্ত ঘটনাটি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করায় সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওর উপজেলার নালী ইউনিয়ন যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আলী হোসেন উজ্জ্বল প্রবাসী এক ব্যক্তির স্ত্রীকে ট্র্যাপে ফেলে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধর্ষণ করে এবং আগে থেকে সেট করে রাখা মোবাইলে ধর্ষণের দৃশ্য ভিডিও করে। যুবলীগ নেতা তার ইচ্ছেমতো শারীরিক সম্পর্ক না করলে ভিকটিম নারীর স্বামীর কাছে ভিডিও ফুটেজ পাঠিয়ে দেবে এবং ইন্টারনেটে তা ছড়িয়ে দেবে বলে ভয়ভীতি দেখিয়ে গত চার বছর ধরে ওই অসহায় নারীকে ধর্ষণ করে আসছে।
শুধু তাই নয়, একেকদিন একেক বন্ধু নিয়ে এসে তাদের সঙ্গেও শারীরিক সম্পর্ক করতে বাধ্য করে। ধর্ষিতা নারীর নামে গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক এবং অন্য আরও কয়েকটি এনজিও থেকে ৪ লাখ টাকার ঋণ উত্তোলন করে সম্পূর্ণ টাকা হাতিয়ে নেয়।
এখানেই শেষ নয়, যুবলীগ নেতার দৃষ্টি পড়েছিল ওই নারীর স্কুলপড়ুয়া মেয়ের ওপরও। মেয়েকে তার কাছে না এনে দিলে ব্যাংক ঋণের কোনো টাকা আর শোধ করবে না বলে হুমকিও দেয়। অবশেষে ১৬ এপ্রিল ধর্ষিতা নারী তার মেয়েকে উজ্জ্বলের কাছে নিয়ে যেতে বাধ্য হয়। তবে স্থানীয় লোকজন বিষয়টি টের পেয়ে গেলে যুবলীগ নেতা পালিয়ে যায়।
১৮ এপ্রিল লালমনিরহাট জেলা এলজিইডির উপসহকারী প্রকৌশলী জাকিরুল ইসলামের কাছে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি একেএম হূমায়ুন কবীরসহ ১০-১৫ জন কর্মীসহ দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে প্রকৌশলীকে বর্বরোচিত আক্রমণ চালিয়ে মারাত্মকভাবে জখম করে। ফলে প্রকৌশলী জাকিরুল ইসলাম আহত অবস্থায় লালমনিরহাট সদর হাসপাতালে ভর্তি হন।
১৯ এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি আবুল বাশার দিনদুপুরে শত শত মানুষের সামনে পূর্বশত্রুতার জের ধরে দা ও চাপাতি দিয়ে একই গ্রামের নিরীহ কালা মিয়ার হাঁটু থেকে পা কেটে সবার সামনে দিয়ে বীরদর্পে স্থান ত্যাগ করে।
শুধু কালা মিয়া নয়, তার ছেলে বিপ্লবকেও টেঁটা দিয়ে মারাত্মকভাবে আহত করে। থানায় মামলা হলে পুলিশ অদ্যাবধি কালা মিয়ার পা উদ্ধার করতে পারেনি। অপরদিকে পুলিশ যথাবিহিত আজও বাশারসহ অন্য আসামিদের ধরার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানায়।
উপরের বর্ণনায় যে ভয়াবহ চিত্র আমরা দেখতে পেলাম তা জানা সম্ভব হয়েছে কেবল ঘটনাগুলো মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে বলে। ক্ষমতাসীন দলের জন্য এসব খবর নিশ্চয়ই সুখকর নয়। বরং অপ্রত্যাশিত ও লজ্জার। এসব কুকর্মের সঙ্গে জড়িত সদস্যদের ওপর তাদের কতটুকু নিয়ন্ত্রণ আছে, তা বলা যাচ্ছে না।
কারণ, ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে সরকারি দলের অঙ্গ-সংগঠনগুলোর কর্মীরা একের পর এক যে ঘটনার জন্ম দিয়ে যাচ্ছে, তাতে দেশের মানুষের ভেতর যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হচ্ছে তা নিয়ে শাসকদল কতটুকু চিন্তিত বোঝা যাচ্ছে না। যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেই, ক্ষমতাসীন দল তাদের কর্মীদের ওপর নিয়ন্ত্রণে সচেষ্ট, তাহলে এসব কুকর্ম থেকে কিছুতেই তাদের বিরত রাখা সম্ভব হচ্ছে না কেন?
সরকারি দলের পক্ষ থেকে হাজার টাকার এ প্রশ্নের কোনো উত্তরও পাওয়া যাচ্ছে না। সাংগঠনিকভাবে ক্ষমতসীন দল দুর্বল একথা বলা যাবে না। তা না হলে বিগত দশ বছরেরও বেশি এ দলটি ক্ষমতায় থাকতে পারত না।
প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা, প্রশাসনকে প্রয়োজনে ব্যবহার করা এবং নির্বাচনে নতুন নতুন উদ্ভাবনী কলাকৌশলের মাধ্যমে পুনঃপুনঃ ক্ষমতায় আসীন হওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হতো না। তবে এসব অঙ্গ-সংগঠনের প্রতি যে মাত্রাতিরিক্ত দুর্বলতা আছে তা বলাই যায়। এ ধরনের দুর্বলতা বাংলাদেশের সব বড় রাজনৈতিক দলের মধ্যেই বিরাজমান। এর বড় একটি কারণ হতে পারে, রাজনৈতিক ফায়দা নিতে গিয়ে এসব কর্মীকে অনৈতিক কাজে নিয়োজিত করা।
দেখা গেছে, রাজনৈতিক দলগুলো তাদের কর্মীদের শুধু প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক আন্দোলন মোকাবেলায়ই কাজে লাগায় না, বরং অনেক সামাজিক, অর্থনৈতিক বা পরিবেশ আন্দোলন দমনেও পেটোয়া বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করে। বিগত কয়েক বছরের খতিয়ান দেখলে এর প্রমাণ মিলে। প্রশাসনের ছত্রছায়ায় কোটা আন্দোলনে হাতুড়ি পার্টি কিংবা নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনে হেলমেট পার্টির কুকর্ম ইত্যাদি এর প্রকৃত উদাহরণ।
দেখা যায়, এত বড় অপরাধ করেও তারা দলের পক্ষ থেকে ছাড় পেয়ে যায়। এসব অপরাধের জন্য তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কোনো ব্যবস্থাও নেয়া যাচ্ছে না। দল বা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অপরাধের যথাযথ বিচার না হওয়ার এ সংস্কৃতির ফলে তারা এক ধরনের আশকারা পেয়ে যায় এবং এসব অনৈতিক কাজে সাহসী হয়ে ওঠে। অতএব স্বাভাবিক নিয়মেই তাদের ভেতর রাজনৈতিক ভাবাদর্শের বিচ্যুতি ও সামাজিক আচরণে নীতি-নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটে।
এ অবক্ষয় যেন ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর আরও বেড়ে গেছে। জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনী ফল নিজেদের পক্ষে নিতে গিয়ে তাদের অঙ্গ-সংগঠনগুলোকে যথেচ্ছ ব্যবহার করেছে। ফলস্বরূপ নির্বাচনকালে এসব সংগঠনের কর্মীদের স্বেচ্ছাচারী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা গেছে। নির্বাচন-উত্তর এ স্বেচ্ছাচারিতার শুরু হয় সুবর্ণচরের গৃহবধূকে গণধর্ষণের মধ্য দিয়ে।
নিজ পছন্দের মার্কায় ভোট দিতে গিয়ে ফেনী জেলার সুবর্ণচরের ছয় সন্তানের এক অসহায় মাকে তাদের ভোগের শিকার হতে হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় দেশব্যাপী একের পর এক এসব ঘটনা ঘটে চলেছে। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বাংলাদেশের গণতন্ত্র যে খাদে পতিত হয়েছে, নিকট ভবিষ্যতে সেই খাদ থেকে তার পুনরুদ্ধারের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
ফলে দেশের সামাজিক জীবনে এক ধরনের অস্থিরতা বেড়েছে। এ কারণে এদেশের সমাজ, রাজনীতি ও প্রশাসনের ওপর মানুষের আস্থা দিন দিন কমে যাচ্ছে। ক্ষমতাসীন দল যদি শক্তহাতে নিজ কর্মীদের লাগাম টেনে না ধরতে পারে তাহলে মানুষের অবশিষ্ট বিশ্বাস ও আস্থাও তলানিতে গিয়ে ঠেকবে।
এ পরিণতির দায়ভার ক্ষমতাসীন দলকেই নিতে হবে। উন্নয়নের গণতন্ত্র বলে যতই তৃপ্তির ঢেকুর তোলা হোক না কেন, সেই ‘গণতন্ত্র’র ওপর সাধারণ মানুষের বিশ্বাস জন্মানো সম্ভব হবে না। মনে রাখতে হবে, জমির ফসল যদি জমির বেড়ায়ই খেয়ে ফেলে, তখন অন্যকে দোষারোপ করে আর যাই হোক জমির ফসল উদ্ধার করা সম্ভব হবে না।
মুক্তিযুদ্ধের মাত্র দুই বছর পরই সমাজে কীভাবে দুর্নীতির বিস্তার ঘটেছে, কিছু মানুষ যারা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ কোনোভাবেই ধারণ করে না, তারা কীভাবে বিত্তশালী হয়ে উঠেছে, অপরদিকে দেশপ্রেমিক, সাধারণ মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীন সমাজে কতটা হতাশাগ্রস্ত এবং টাকার জোরে ক্ষমতাবান হওয়া মানুষের দ্বারা নিগৃহীত এবং অবহেলিত- সেই অশুভ দিকগুলোই ‘আবার তোরা মানুষ হ’ ছবিতে তুলে ধরা হয়েছে।
ছবিটি নিয়ে তখন বিতর্ক হলেও স্বাধীনতা-উত্তর দেশের সার্বিক পরিস্থিতির একটি খোলামেলা খণ্ডচিত্র ফুটে উঠেছে ছবিটিতে। ছবির শেষ পর্বে কলেজের অধ্যক্ষ এক আবেগঘন বক্তব্যে তার ছাত্রদের বলেন, ‘তোরা তো এদেশের সূর্য সন্তান। দেশের প্রয়োজনে একদিন হাতিয়ার হাতে তুলে নিয়েছিলি। তোদের কেন মানুষ মন্দ বলবে। তোরা কি পারিস না ওই অন্ধকার জীবন ছেড়ে আলোর পথে ফিরে আসতে? হাতে হাত রেখে আমাদের এই দেশটাকে গড়ে তুলতে?’
স্বাধীনতার এত বছর পরও অধ্যক্ষের সেই বক্তব্যের মর্মবাণী যেন আজও প্রাসঙ্গিক মনে হয়। আমাদের কি এমন কেউ নেই, যিনি হ্যামিলনের সেই বাঁশিওয়ালার মতো বিপথগামী তরুণদের কাছে টেনে নিতে পারবেন এবং অন্ধকারের পঙ্কিল পথ থেকে আলোর পথে নিয়ে যেতে সক্ষম হবেন?
একেএম শামসুদ্দিন : অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা