শিক্ষকদের জন্য বৈশাখী ভাতা ও ইনক্রিমেন্ট ঘোষণা একটি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া
কাজী ফারুক আহমেদ
প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০১৮, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি তাৎক্ষণিক কৃতজ্ঞতা জানানোর উদ্দেশ্যেই আমার আজকের এ লেখা। স্পষ্ট করে বললে, প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন ব্যক্তির চেয়ে শিক্ষানুরাগী, শিক্ষক-সুহৃদ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার উদ্দেশে লেখাটি নিবেদিত। ক্ষমতার পালাবদলে সরকার আসে সরকার যায়; কিন্তু আন্তরিকতার স্পর্শে মানুষকে আপন করে নিতে পারেন ক’জন?
অনভিপ্রেত প্রতিকূল পরিবেশকে অনুকূলে নিয়ে আসার যোগ্যতা সবার থাকে না। বলতে দ্বিধা নেই, সংখ্যায় অতি স্বল্প সেসব মানুষের কাতারে স্থান করে নিয়েছেন শেখ হাসিনা। বৃহস্পতিবার ৫ লাখ শিক্ষক-কর্মচারীকে ইনক্রিমেন্ট ও বৈশাখী ভাতা প্রদানের ঘোষণা এ দেশে শিক্ষার ৯০ ভাগের বেশি ভার বহনকারী বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য শুধু সুসংবাদই বয়ে আনেনি, শিক্ষকতা পেশায় ত্মাবিশ্বাসের সঙ্গে স্থিত হতেও তাদের অনুপ্রাণিত করবে।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় গণভবনে বিভিন্ন ট্রাস্টের চেক বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এ ঘোষণা দেন। আজ সকালে আমাকে টেলিফোনে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বিষয়টি নিশ্চিত করেন। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবসময়ই শিক্ষকদের পাশে দাঁড়ান। আবারও তিনি সেটা প্রমাণ করলেন। প্রধানমন্ত্রী শিক্ষকদের জন্য বার্ষিক ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট ও সরকারি চাকরিজীবীদের মতো ২০ শতাংশ বৈশাখী ভাতার ঘোষণা দিয়েছেন।’
দেশে বর্তমানে এমপিওভুক্ত স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার সংখ্যা প্রায় ২৮ হাজার। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৫ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছেন। তাদের ইনক্রিমেন্টের জন্য বছরে বাড়তি ৫৩১ কোটি ৮২ লাখ ৩৯ হাজার টাকা লাগবে। আর বৈশাখী ভাতার জন্য লাগবে ১৭৭ কোটি ২৭ লাখ ৪৯ হাজার টাকা। সরকার ২০১৫ সালে অষ্টম বেতন কাঠামোর আওতায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য বৈশাখী ভাতা চালু করে।
কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বাংলা নববর্ষে তাদের মূল বেতনের ২০ শতাংশ হারে এ ভাতা পান। ওই বেতন কাঠামোতেই আগের সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেলের বিধান বাতিল করে ৫ শতাংশ হারে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি বা ইনক্রিমেন্টের নিয়ম চালু করা হয়। এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা অষ্টম বেতন কাঠামো অনুযায়ী মূল বেতন পেলেও ইনক্রিমেন্ট ও বৈশাখী ভাতা থেকে এতদিন বঞ্চিত ছিলেন। এ জন্য তারা বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে নানা কর্মসূচি পালন করেছেন।
ষাটের দশকে কলেজজীবনে একটি সময়োপযোগী, বৈষম্য ও বঞ্চনামুক্ত শিক্ষানীতির জন্য আন্দোলন করেছি। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে বাহাত্তরে খুলনার একটি বেসরকারি কলেজে প্রথমে বিনা বেতনে, পরে মাসে ৬০ টাকার টিচার্স বেনিফিট সম্বল করে শিক্ষকতায় কর্মরত থাকি। বঙ্গবন্ধু সরকার ওই বেনিফিটের অর্থ ৬০ থেকে ১০০ টাকায় উন্নীত করে এবং ১০০ টাকা দ্বিগুণ করার ঘোষণা দেয়।
ড. কুদরাত-ই-খুদার নেতৃত্বে জাতীয় শিক্ষা কমিশন ১৯৭৪ সালের ৫ মে বঙ্গবন্ধুর হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের রিপোর্ট তুলে দেয়। কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধী, গণমানুষের শত্রু ও প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর নির্মম বুলেট জাতির পিতার বুক ঝাঁঝরা করে দেয়ার পর শিক্ষার যাত্রা পশ্চাৎদিকে ধাবিত হয়। কুদরাত-ই-খুদা রিপোর্টের মূল বিষয়বস্তুকে ধারণ করে ২০০০ সালে একটি শিক্ষানীতি প্রণীত হলেও তা কার্যকর হতে পারেনি। এরপর আবার নেমে আসে একরাশ অন্ধকার। কিন্তু অন্ধকারের দাপট চিরস্থায়ী হয় না। ২০০৮ সালে গণরায়ে ক্ষমতায় এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য একটি কমিটি গঠন করেন।
এ কমিটির রিপোর্ট জাতীয় শিক্ষানীতি হিসেবে ২০১০ সালে জাতীয় সংসদে অনুমোদিত হয়। এ শিক্ষানীতি প্রণয়নে আমি প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলাম। ২০১০ সালের শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের গতি নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও আমি মনে করি অনেক অর্জনও রয়েছে। অবশ্য সমন্বয় ও প্রকৃত বাস্তবায়নের তথ্য প্রকাশে সরকারের দিক থেকে দক্ষতার ঘাটতি ছিল। তবে এ কথা মানতে হবে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের ইনক্রিমেন্ট ও বৈশাখী ভাতা প্রদানের ঘোষণার মাধ্যমে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ সরকারি-বেসরকারি শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে বৈষম্য দূর করার প্রস্তাব বাস্তবে রূপ লাভ করেছে।
লেখার শুরুতে শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি প্রধানমন্ত্রীর পদটিকে ছোট করার জন্য নয়। চার দশকের বেশি সময় শিক্ষক আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকার অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য শেখ হাসিনার ঘোষণা তাদের মধ্যে একদিকে সন্তুষ্টি বয়ে আনবে, অন্যদিকে নতুন প্রত্যাশারও জন্ম দেবে। আগে থেকে বিরাজমান অপূরিত প্রত্যাশা পূরণেও তাদের নতুন করে আশাবাদী করে তুলবে।
এর মধ্যে রয়েছে- এমপিও’র জন্য নির্বাচিত শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তি, অনার্স-মাস্টার্স পাঠদানকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সরকারপ্রদত্ত বেতন কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসা, প্রাথমিক-মাধ্যমিক থেকে শিক্ষার সব ধাপ ও স্তরের মধ্যে সমন্বয়, শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনুকূল পরিবেশ তৈরি এবং শিক্ষকদের প্রাপ্য আর্থ-সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিতকরণের মতো বিষয়।
প্রত্যাশা পূরণ যে নতুন করে প্রত্যাশা তৈরিও করে, শিক্ষক নেতৃত্ব ও সরকার উভয়কে তা অনুধাবন করতে হবে। একই সঙ্গে শিক্ষক আন্দোলনে ধারা বদলও যে অপরিহার্য এ বিবেচনাও শিক্ষক নেতৃত্বের উপলব্ধিতে আসতে হবে। ক্ষুদ্র মানুষ হয়েও সব সরকারের আমলে শিক্ষকদের দাবি আদায়ের কর্মসূচিতে এ চেতনা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছি যে, শিক্ষার জন্যই শিক্ষকের প্রয়োজন এবং শিক্ষকের বেতন-ভাতা-মর্যাদা বৃদ্ধির পক্ষে যুক্তি শানিত ও শক্তিশালী হয় উন্নততর পাঠদান ও গুণগত শিক্ষার প্রসারে পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে।
উপসংহারে আমি শিক্ষা ও শিক্ষকদরদি শেখ হাসিনার প্রতি আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। আমি নিশ্চিত দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে সব শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী তাদের অনুকূলে গৃহীত সুবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট ও আশ্বস্তবোধ করবেন। ভবিষ্যতে আরও অর্জনের জন্য তাকে যথাসম্ভব অকৃপণ ও স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা প্রদান করবেন। কারণ কোনো ভালোবাসাই একপক্ষীয় হয় না।
অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ : জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়ন কমিটির সদস্য; শিক্ষক আন্দোলনের প্রবীণ নেতা
principalqfahmed@yahoo.com
