Logo
Logo
×

খেলা

বিনা চিকিৎসায় ধুঁকছেন গোলকিপার মহসিন

Icon

মোজাম্মেল হক চঞ্চল

প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

‘আমি সুস্থ হতে চাই। আমি বাঁচতে চাই। দয়া করে আমাকে বাঁচার সুযোগ করে দিন’, আবেগভরা কণ্ঠে কথাগুলো বলেছেন বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা গোলকিপার মহসিন। গোলপোস্টের নিচে অতন্দ্রপ্রহরী ছিলেন। বাঘা বাঘা ফরোয়ার্ডদের আক্রমণ রুখেছেন দৃঢ়হস্তে। সেই হাতই এখন অনেকটাই নিস্তেজ। নিজ হাতে খেতে পারেন না ঢাকার মাঠের একসময়কার এই সেরা গোলকিপার। বিছানায় শুয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। কথা বলার শক্তিটুকুও যেন হারিয়ে ফেলেছেন। পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি উচ্চতার দেহের দিকে তাকালে যে কারও চোখে জল আসতে বাধ্য। এই প্রতিবেদকেরও চোখ ভিজে গিয়েছিল। মহসিন যেন জীবনের শেষ লগ্নে পৌঁছে গেছেন। ওষুধ দূরে থাক, খাবার কেনাই তার জন্য দুরূহ। সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা এই সাবেক গোলকিপার আজ জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।

স্বাধীন বাংলাদেশের সেরা গোলকিপারদের একজন ছিলেন মহসিন। ১৯৬৫ সালের ১ আগস্ট ঢাকার মানিকগঞ্জে জন্ম তার। ১৯৭৮ সালে দ্বিতীয় বিভাগে খেলেন রেলওয়ে ব্লুজের হয়ে। একই বছর রেলওয়ে দলের হয়ে শেরেবাংলা কাপে অংশ নেন। ওই বছর আবাহনীর আশরাফউদ্দিন আহমেদ চুন্নুও জাতীয় ফুটবলে রেলওয়ের হয়ে খেলেন। মহসিনের খেলায় মুগ্ধ হয়ে তাকে আবাহনীতে নিয়ে আসেন চুন্নু। যদিও তখন মহসিন ছিলেন তৃতীয় গোলকিপার। কিন্তু একাগ্রতা ও অধ্যবসায় দিয়ে ১৯৮১ সালে তিনি প্রথম একাদশে জায়গা করে নেন। এক ধরনের চ্যালেঞ্জ নিয়েই ১৯৮২ সালে যোগ দেন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে। ওই সময়ে সাদা-কালো শিবিরে ছিলেন দেশসেরা গোলকিপার লাল মোহাম্মদ। মোহামেডানে যোগ দেওয়ার পর মহসিন নিজেকে পরিপূর্ণভাবে মেলে ধরেন। টানা পাঁচ বছর মোহামেডানের গোলপোস্ট আগলিয়েছেন পরম মমতায়। ১৯৮৫ সালে তিনি মোহামেডানের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৭ সাল থেকে আবারও তার ঠিকানা হয়ে ওঠে আবাহনী ক্রীড়া চক্র। টানা সাত বছর তিনি হয়ে ওঠেন আবাহনীর রক্ষণভাগের প্রাণ। ১৯৯১ সালে তার নেতৃত্বে আবাহনী অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়। তিনিই একমাত্র ফুটবলার একই সঙ্গে যিনি মোহামেডান ও আবাহনী দেশের দুই ঐতিহ্যবাহী দলেরই অধিনায়ক ছিলেন। আবাহনীর হয়ে তিনবার (১৯৮১, ১৯৮৯-৯০, ১৯৯১) এবং মোহামেডানের হয়ে দুইবার (১৯৮২ ও ১৯৮৬) লিগ চ্যাম্পিয়ন এবং মোহামেডানের হয়ে দুইবার (১৯৮২ ও ১৯৮৩) ও আবাহনীর হয়ে একবার (১৯৮৮) ফেডারেশন কাপ চ্যাম্পিয়ন দলের হয়ে খেলেছেন। এছাড়া ১৯৮২ সালে ভারতের কলকাতায় আশীষ জব্বার স্মৃতি ফুটবল টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন মোহামেডানের দলের সদস্য ছিলেন। ১৯৯০ সালে স্বাধীনতা দিবস ফুটবল চ্যাম্পিয়ন, ভারতের নাগজি ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন, ১৯৯১ সালে বিটিসি কাপ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন এবং ১৯৯৪ সালে কলকাতার চার্মস কাপে চ্যাম্পিয়ন আবাহনীর হয়ে তিনি দুর্দান্ত ক্রীড়াশৈলী উপহার দেন। ১৯৯৪ সালে পুল ভেঙে যোগ দেন মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া চক্রে। তার অধিনায়কত্বে মুক্তিযোদ্ধা ফেডারেশন কাপ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়।

মহসিন ঘরোয়া ফুটবলের মতো আন্তর্জাতিক ম্যাচেও সুনামের সঙ্গে খেলেছেন। ১৯৮২ সাল থেকেই জাতীয় দলে খেলার সুযোগ হয়। সেটা ছিল বাংলাদেশ সবুজ দলের হয়ে। যদিও সেবার মাঠে নামা হয়নি। ওই বছরেই দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসে মাঠে নামার সুযোগ হয় তার। নিয়মিত গোলকিপার মোতালেব প্রথম ম্যাচে ভারতের সঙ্গে ভালো খেলতে না পারার কারণে দ্বিতীয় ম্যাচে চীনের বিপক্ষে মাঠে নামানো হয় মহসিনকে। চীনের কাছে ১-০ গোলে হেরে যায় বাংলাদেশ। তবে মহসিন ছিলেন স্বপ্রতিভ। ১৯৮৮ সালে তেহরানে ইরানের বিপক্ষে এবং ১৯৯৬ সালে আরব আমিরাতের বিপক্ষে যদিও ম্যাচ হেরেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু দারুণ খেলেছিলেন গোলকিপার মহসিন। ১৯৮৩ সালে ঢাকায় তৃতীয় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ, মালয়েশিয়ায় ২৭তম মারদেকা ফুটবল, ১৯৮৪ সালে ঢাকায় ২৪তম এশীয় যুব ফুটবলের গ্রুপ-২ এর বাছায়পর্ব, ইন্দোনেশিয়ায় অষ্টম এশিয়ান কাপের কোয়ালিফাইং রাউন্ড, ১৯৮৫ সালে পাকিস্তানের পেশোয়ারে কায়েদে আযম ট্রফি, ঢাকায় দ্বিতীয় সাফ গেমস, ১৯৮৬ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ ফুটবলে বাংলাদেশ লাল দল, সিউলে দশম এশিয়ান গেমস, ১৯৮৭ সালে প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ ফুটবলে বাংলাদেশ সাদা দল, ১৯৯১ সালে সিউল ও কুয়ালালামপুরে প্রি-অলিম্পিক, কলম্বোয় পঞ্চম সাফ গেমস, ১৯৯২ সালে ব্যাংকক এশিয়া কাপ, ১৯৯৩ সালে সপ্তম প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ ফুটবলে বাংলাদেশ লাল দল এবং জাপান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে অংশ নেন মহসিন। তিনি ১৯৭৯-৮১, ১৯৮৭-৯৩ পর্যন্ত খেলেন আবাহনীতে। ১৯৮২-৮৬ সাল পর্যন্ত খেলেন মোহামেডানে এবং ১৯৯৪-৯৫ মৌসুমে খেলেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদে। খেলা শেষ করে ১৯৯৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র হয়ে কানাডায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। নিজের স্কিল, আই সাইট, পজিশন জ্ঞান এবং বিচক্ষণতা দিয়ে বারবার প্রমাণ করেছেন তিনিই দেশসেরা গোলকিপার। আর তাই বাংলাদেশ ফুটবলের ইতিহাসে দুই প্রতিপক্ষ মোহামেডান ও আবাহনীর লাখ লাখ সমর্থকের হৃদয়ে আজও দীপ্যমান গোলকিপার মহসিন। তিনি ঢাকা ফুটবলের তিন প্রধান মোহামেডান, আবাহনী এবং মুক্তিযোদ্ধা সংসদের অধিনায়ক ছিলেন। তাছাড়া বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯, সবুজ দল, লাল দল এবং বাংলাদেশ জাতীয় মূল দলের অধিনায়ক ছিলেন পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি উচ্চতার এই গোলকিপার। ১৯৯৫ সালে অবসান ঘটে তার ফুটবল ক্যারিয়ারের। ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি তাকে সেরা ফুটবলার নির্বাচিত করে। পরে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারও পেয়েছেন এই মহসিন। অসীম দক্ষতায় গোলবার আগলে রাখা সেই মানুষটিই আজ বিছানায় শুয়ে দিন কাটাচ্ছেন। ২০১৪ সালে অসুস্থ মাকে সেবা করার জন্য কানাডা থেকে চলে আসেন এই ফুটবলার। স্ত্রী সঙ্গে আসেননি। পরে বিচ্ছেদ হয়ে যায় তাদের। মাকে ছেড়ে এক মুহূর্তের জন্যও কোথাও যেতেন না মহসিন। ৯০ বছর বয়সি মায়ের সেবা করাই ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান। সেই ছেলেই এখন মায়ের চেয়েও যেন বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। হাতে কোনো অর্থ নেই। কোনো রকমে ছোট ভাই পিন্টুর সহায়তায় দিনাতিপাত করছেন। ডান হাতের বুড়ো আঙুল বাঁকা হয়ে গেছে। দুই চোখে অপারেশন করাতে হয়েছে। সহায়-সম্বল বলতে যা ছিল, তাও ভূমিদস্যুরা দখল করে নিয়েছে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে মহসিন জানান, ‘সাভারের ইমাদিপুর পাকিজা শাড়ির ফ্যাক্টরির দেওয়ালঘেঁষা

দুই বিঘার বেশি জায়গা ছিল আমাদের।

সেটি আব্বার আর আমার কষ্টের টাকায় কেনা। অনেক দিন হলো তা বেদখল হয়ে আছে। আমার জমি আমাকে ফিরিয়ে দেওয়ার ন্যায়বিচারের আশা তো আমি করতেই পারি। দেশের জন্য আমি এত কিছু করেছি, দেশ কি আমাকে এটুকু দেবে না?’

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম