‘১০’ নম্বর জার্সি
ঢাকার মাঠে সেরা কে?
মোজাম্মেল হক চঞ্চল
প্রকাশ: ১৭ মে ২০২০, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফুটবলে জার্সি ১০ শুনলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে দুই জীবন্ত কিংবদন্তি ব্রাজিলের পেলে ও আর্জেন্টিনার দিয়াগো ম্যারাডোনার মুখ। ভেসে ওঠে হাল আমলের মেসি ও নেইমারদের চেহারাও। যাদের চোখ ধাঁধানো নৈপুণ্যের জন্য ‘১০’ নম্বর জার্সি দর্শকদের খেলা উপভোগে ভিন্নমাত্রা যোগ করে। দর্শকদের চোখ আটকে থাকা খেলোয়াড়দের সঙ্গে ‘১০’ নম্বর জার্সিও জনপ্রিয়তা পেয়েছে। যে কেউ ‘১০’ নম্বর জার্সি গায়ে চাপাতে পারেন না। যে কাউকে এ জার্সি দেয়া হয় না। বিশ্ব ফুটবলের মান থেকে যোজন যোজন মাইল দূরে থাকলেও বাংলাদেশেও ‘১০’ নম্বর জার্সির একটি আলাদা মর্যাদা ছিল। জাতীয় দলতো বটেই আবাহনী ও মোহামেডানের দশ নম্বর জার্সি নিয়ে ছিল এক ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা।
কর্মকর্তাদের উদাসীনতায় ফুটবল এখন নিম্নমুখী। দর্শকরা ফুটবলমুখো হন না। মাঠের ফাঁকা গ্যালারি হাহাকার করে। যেন তিরষ্কার করে দেশের ফুটবলকে। তারপরও প্রবীণ ফুটবল দর্শকরা মাঝে-মধ্যে পুরনো খেলোয়াড় ও তারকা ফুটবলারদের নিয়ে তর্কের খাতিরে আড্ডায়, চায়ের কাপে ঝড় তোলেন। ঢাকার মাঠে ‘১০’ নম্বরে কে সেরা? এ নিয়ে তর্কের শেষ নেই। স্বাধীনতার আগে মারি চৌধুরী, মো. মুসা, আবদুল জব্বার, আলী নেওয়াজ, আশরাফ চৌধুরী এবং স্বাধীনতার পরে এনায়েতুর রহমান, মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ, কাজী মো. সালাউদ্দিন, বাদল রায়, মো. মোহসিন, সৈয়দ রুম্মান বিন ওয়ালী সাব্বির, ইমতিয়াজ আহমেদ নকীব, আলফাজ আহমেদরা ‘১০’ নম্বর জার্সি গায়ে দিয়ে মাঠ মাতিয়েছেন। সর্বশেষ জাহিদ হাসান এমিলি কিছুটা ঝিলিক দেখাতে পেরেছিলেন ১০ নম্বর জার্সিতে।
‘জাতীয় দলের দশ নম্বর জার্সি কে পরেন এখন?’ কিছুক্ষণ ভেবেও মনে করতে পারলেন না বাফুফের বর্তমান কমিটির এক কর্মকর্তা। বাফুফে কর্তাদেরই যখন জাতীয় দলের ১০ নম্বর জার্সির খেলোয়াড় চিনতে গলদঘর্ম হতে হয়, তখন সাধারণ ফুটবলপ্রেমীদের কি অবস্থা, তার আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
১৯৪৮ সালে শুরু হওয়া ঢাকার ফুটবলে এই জার্সির গুরুত্ব শুরু থেকেই ছিল। সাধারণত ফরোয়ার্ডদের দেয়া হতো ‘১০’ নম্বর জার্সি। কিন্তু ফরোয়ার্ড না হয়েও এ জার্সির মর্যাদা রেখেছিলেন মোহামেডানের সৈয়দ রুম্মান বিন ওয়ালী সাব্বির। ঢাকার মাঠে ‘১০’ নম্বর জার্সিধারীদের সেরার তালিকায় সাব্বিরের নামটি আজও উচ্চারিত হয় মর্যাদার সঙ্গে। ধানমণ্ডি থেকে ১৯৮৭ সালে মোহামেডানে যোগ দেয়া সাব্বিরের গায়ে শুরুর দিকে ‘১০’ নম্বর জার্সি ছিল না। ১৯৯২ সালে তিনি পান এ জার্সি। মোহামেডানের অনেক জয়ের পেছনে মুখ্য ভূমিকা ছিল সাব্বিরের। ঢাকার মাঠে ‘১০’ নম্বর জার্সিধারীদের মধ্যে এনায়েতকেই সেরা মনে করেন সাব্বির। মোহামেডানের সাবেক এই মিডফিল্ডার বলেন, ‘১৯৭৩ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত এনায়েত ভাই ‘১০’ নম্বর জার্সি পরে নিয়মিত খেলতেন। তার পায়ের প্রচণ্ড গতির শট প্রতিপক্ষের গোলকিপারদের কাঁপন ধরিয়ে দিত। একজন জাত ফুটবলারের সব গুণাবলী ছিল উনার মধ্যে। দক্ষতা ও নৈপুণ্যের বিচারে এনায়েত ভাইয়ের ধারেকাছেও কেউ ছিলেন না। অসাধারণ ফুটবল খেলতেন তিনি। দলের জয়ে উনার ভূমিকা ছিল না এমন নজির কম। শুধু নিজে গোল করতেন না, পুরো দলকে খেলাতেন। কখনও মধ্যমাঠ, কখনও ডিফেন্স, রাইট, লেফট আউট সবক্ষেত্রেই এনায়েত ভাইয়ের বিচরণ ছিল। এককথায়, যেখানে বল সেখানেই ছিলেন তিনি। ১৯৭৮ সালে মোহামেডানে যোগ দেয়া এনায়েত ভাইয়ের গায়ে ‘১০’ নম্বর জার্সিই ছিল। উনার তুলনা উনি নিজেই।’
বাফুফে সভাপতি হিসেবে অনেক ব্যর্থতা ও সমালোচনা থাকলেও বাংলাদেশের জনপ্রিয় ফুটবলার ছিলেন কাজী মোহাম্মদ সালাউদ্দিন। মোহামেডান থেকে আবাহনীতে যোগ দেয়ার পরেও ‘১০’ নম্বর জার্সি ছিল সালাউদ্দিনের গায়ে। আবাহনীতে টানা ১১ বছর খেলে ডাবল হ্যাটট্রিক, হ্যাটট্রিকসহ শতাধিক গোল করেছেন সালাউদ্দিন। জনপ্রিয়তা থাকার পরেও সালাউদ্দিনকে ‘১০’ নম্বর জার্সিতে সবার সেরা বলা যাবে না। কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা দিলেন জাতীয় দলের সাবেক তারকা ফুটবলার ও জাতীয় দলের সাবেক কোচ হাসানুজ্জামান খান বাবলু। তার কথা, ‘এত গোল করার পরেও পুরো মাঠে সতীর্থদের খেলানোর মতো দক্ষতা বা যোগ্যতা কোনোটাই ছিল না উনার। প্রশ্ন জাগাটা স্বাভাবিক, তাহলে এত গোল তিনি কিভাবে পেলেন? আমি বলব, সালাউদ্দিন একজন স্টাইলিস্ট ও দক্ষ ফরোয়ার্ড ছিলেন। তিনি সঙ্গী হিসেবে আবাহনীতে পেয়েছিলেন আশরাফউদ্দিন আহমেদ চুন্নু, কাজী আনোয়ার, খুরশিদ আলম বাবুল, অমলেশ দা ও আশিষ ভদ্রের মতো তুখোড় ফুটবলারদের। সত্যি কথা বলতে কি, এরাই সারা মাঠ খেলে সালাউদ্দিনকে গোলের পথ দেখাতেন। তাদের আক্রমণটা এত নিখুঁত ও পরিকল্পনামাফিক ছিল যে, বল জালে পাঠানোটা সালাউদ্দিনের কাছে সহজ হয়ে যেত। আমি বলব, গোল না পাওয়াটাই তখন কঠিন ছিল। নিজের প্রচেষ্টায় সালাউদ্দিন গোল করেছেন, এমন খেলার সংখ্যা কমই রয়েছে। মিডিয়াও সালাউদ্দিনকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে তোলার পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেছিল, যা পাননি এনায়েত ভাই।’
সাবেক মন্ত্রী হাফিজউদ্দিনও মোহামেডানের হয়ে ‘১০’ নম্বর জার্সি পরে ঢাকার মাঠ মাতিয়েছেন। ঢাকা লিগে প্রথম ডাবল হ্যাটট্রিকের কৃতিত্ব তারই। মোহামেডানের অনেক বিজয়ের নায়ক ছিলেন তিনি। ঢাকার মাঠে সেরা স্ট্রাইকারদের নাম উচ্চারিত হলে হাফিজের নাম আসবেই। ব্রাদার্সের মোহসিনও ‘১০’ নম্বর জার্সিতে চোখে পড়ার মতো নৈপুণ্য দেখিয়েছেন। প্রতিপক্ষ সবসময় মোহসিন আতঙ্কে ভুগত। সালাউদ্দিন, হাফিজ অধিকাংশ সময় অপেক্ষায় থাকতেন, সতীর্থরা কখন বল দেবেন? কিন্তু মোহসিন ছিলেন ব্যতিক্রম। পরিশ্রমী ফুটবলার। দলের প্রয়োজনে সব পজিশনেই খেলতে পারতেন তিনি। মোহসিন সম্পর্কে রাষ্ট্রীয় ক্রীড়া পুরস্কার পাওয়া বাবলু বলেন, ‘আমি এককথায় বলব, স্বাধীনতা উত্তর ৫০ বছরে ১০ নম্বর জার্সিধারীদের মধ্যে সেরা ফুটবলার হলেন এনায়েত ভাই। তারপর মোহসিন। ঢাকা লিগে এক খেলায় ৭ গোল করার কৃতিত্ব ছিল মোহসিনের। কমপ্লিট ফুটবলার বলতে যা বোঝায় তাই ছিল সে।’
মোহামেডানের বাদল রায় ছিলেন আরও বেশি পরিশ্রমী। ‘৭’ নম্বর জার্সি দিয়ে ঢাকার ফুটবলে ক্যারিয়ার শুরু হলেও ১৯৮১ সালে ‘১০’ নম্বর জার্সির সঙ্গে মোহামেডানের অধিনায়কত্বও পান বাদল রায়। তিনি নিজে খেলতেন এবং পুরো দলকে খেলাতেন। স্ট্রাইকার মানেই যে প্রতিপক্ষের গোলপোস্টের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা, এটা মিথ্যা প্রমাণ করেছিলেন বাদল রায়। ফুটবলে অসম্ভব জনপ্রিয় শেখ মো. আসলাম ও সালাম মুর্শেদীর গায়ে ‘১০’ নম্বর জার্সি ছিল না। ঢাকা লিগের সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড আসলাম ও সালামের যে দক্ষতা ও নৈপুণ্য ছিল, তাতে ‘১০’ নম্বর জার্সি পরার যোগ্যতাও ছিল। ’৯০ দশকে ‘১০’ নম্বর জার্সি পরে মাঠ মাতিয়েছেন নকীব-আলফাজরা। সতীর্থদের কাছ থেকে বল না পেলেও নিজের চেষ্টায় অনেক গোল করেছিলেন আলফাজ। এ প্রজন্মের সর্বশেষ তারকা ছিলেন জাহিদ হাসান এমিলি। বর্ষীয়ান ক্রীড়া সাংবাদিক মুহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, ‘আমার দৃষ্টিতে ‘১০’ নম্বর জার্সিধারীদের মধ্যে সেরা সাব্বির। অসম্ভব স্কিলধারী এ ফুটবলার দলের জন্য পুরো মাঠ চষে বেড়াতেন। সেরার তকমাটা আমি তাকেই দেব।’
সাবেক তারকা ফুটবলার শেখ মো. আসলাম স্মৃতিচারণ ও আক্ষেপ করে বলেন, ‘ফুটবলে দশ নম্বর জার্সি একটি বিশেষ কিছু। জাতীয় দল তো বটেই; আমাদের আবাহনী ক্লাবে সব সময় আলোচনা হতো কে পাচ্ছে এই মৌসুমে দশ নম্বর জার্সি। আর এখন কোনো আলোচনা নেই।’ এর পেছনে অবশ্য কারণও বের করেছেন সাবেক এই স্ট্রাইকার, ‘দশ নাম্বার জার্সি জনপ্রিয় হয়েছে স্ট্রাইকারদের কল্যাণে। আমাদের এখনকার স্ট্রাইকারদের গোল কম। গোলের খেলা ফুটবল, গোল না হলে সেই ১০ নম্বরের আবেদন থাকে কিভাবে।’