
প্রিন্ট: ২৯ মার্চ ২০২৫, ০২:৫৯ এএম
‘চোখের সামনে ফুটবল ধ্বংস হয়ে গেল’

মোজাম্মেল হক চঞ্চল
প্রকাশ: ১৫ মে ২০২০, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আরও পড়ুন
‘সতীর্থ অনেকেই পরকালে চলে গেছেন। ওদের কথা খুব মনে পড়ে। এখন মাঝেমধ্যে বন্ধু সুরুজের সঙ্গে কথা বলে মন হালকা করি,’ কথাগুলো বলেছেন মইনুদ্দিন আহমেদ। জাতীয় ফুটবল দলের একসময়ের সাড়া জাগানো ডিফেন্ডার মইন। আবাহনী ও মোহামেডানের এই সাবেক ডিফেন্ডার জাতীয় দলেও খেলেছেন সুনামের সঙ্গে। মইনের আরেকটি পরিচয়, তার বড় ভাই স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু। চিকিৎসক বাবার পাঁচ ছেলের মধ্যে মইন দ্বিতীয়। হওয়ার কথা ছিল ডাক্তার। কিন্তু বড় ভাই পিন্টুর পথ ধরে হয়েছিলেন ফুটবলার। বাকি তিন ভাই দুই অগ্রজের পথে হাঁটেননি।
করোনার মধ্যে অনেকটা বন্দি অবস্থায় রয়েছেন। জিগাতলায় নিজের ফ্ল্যাটে স্ত্রী চায়না হেনাকে নিয়ে তার সংসার। ছেলে-মেয়ে দু’জনই থাকেন অস্ট্রেলিয়ায়। প্রায় প্রতিদিনই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সন্তানদের সঙ্গে কথা বলে সময় কাটান মইন। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সদস্য বরিশালের আমিনুল ইসলাম সুরুজের সঙ্গেও মাঝেমধ্যে কথা বলে নিজেকে হালকা রাখেন। বৃহস্পতিবার যুগান্তরের এই প্রতিবেদকের সঙ্গে জীবনের নানা বাঁক নিয়ে কথা বলেন একসময়ের এই তারকা ফুটবলার।
১৯৬৭ সালে ভিক্টোরিয়ার হয়ে ঢাকার মাঠে অভিষেক হয়েছিল মইনের। দু’বছর পর নাম লেখান মোহামেডানে। ’৭৬ সাল পর্যন্ত টানা খেলেন ঐতিহ্যবাহী এই দলটিতে। মোহামেডান ছাড়ার ইচ্ছা ছিল না মইনের। বড় ভাই পিন্টু একদিন সকালে ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে মইনকে ক্লাব থেকে বের করে দেন। সে আরেক ইতিহাস। মইনের জবানিতে, ‘মোহামেডান ক্লাবে আমি ও কায়কোবাদ একসঙ্গে ধূমপান করতাম। রাত জেগে তাস খেলতাম। তখন ক্লাবের কোচ ছিলেন গজনবী ভাই। শুধু কোচ বলা ভুল হবে, তিনি ছিলেন মোহামেডানের হর্তাকর্তা। প্রতি রাতে তিনি ক্যাম্পে ঢুঁ মারতেন। খেলোয়াড়রা কী করছে ঘুরে ঘুরে দেখতেন। একদিন গজনবী ভাইয়ের কাছে ধরা পড়ে যাই। পরের দিন উনি অনুশীলনের সময় সব ফুটবলারকে চারবার মাঠ প্রদক্ষিণ করতে বলেন। আমাকে ও কায়কোবাদকে বলেন তিন চক্কর বেশি দিতে। কায়কোবাদ রাজি হলেও আমি চক্কর না দিয়েই রুমে ফিরে আসি। গজনবী ভাই পিন্টু ভাইয়ের কাছে বিচার দেন। পিন্টু ভাই আমাকে খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। আমি ভয়ে পালিয়ে বেড়াই। একদিন সকালে দেখি পিন্টু ভাই বিছানার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে আমাকে বাক্সপেটরাসহ ঘাড় ধরে বের করে দেন। তখনই পণ করি, মোহামেডানে আর খেলব না। আবাহনীতে যোগ দিই (১৯৭৭ সাল)। ওই বছর আবাহনী অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়। লীগের দুই পর্বেই আমরা মোহামেডানকে হারাই।’
মইনের কথা, ‘মোহামেডানে খেলা আমার স্বপ্ন ছিল। কিন্তু আবাহনীতে এক বছর খেলার পর কীভাবে যেন আবাহনীর ভক্ত হয়ে যাই। এখন আমি আবাহনীর সমর্থক। অথচ ১৯৭৪ সালে আবাহনীর সঙ্গে আমার তিক্ত সম্পর্ক ছিল। ওই সময় এক ম্যাচে মোহামেডানের সুরুজকে ফাউল করেন গোলাম মোস্তফা সারোয়ার টিপু। আমার মাথা গরম হয়ে যায়। আমি দৌড়ে গিয়ে টিপু ভাইয়ের পিঠে বুট দিয়ে আঘাত করি। মাঠে গণ্ডগোল বেধে যায়। আবাহনীর সমর্থকরা আমার ওপর ক্ষেপে যায়। আমি কয়েকদিন পালিয়ে ছিলাম।’ মইন বলেন, ‘পরের বছর আবাহনীকে চার গোলে হারিয়েছিল মোহামেডান। একটি গোল ছিল আমার। কী সব সোনালি দিন ছিল ফুটবলের। মোহামেডানের হয়ে ছয়বার এবং আবাহনীর হয়ে একবার লিগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বাদ পেয়েছি আমি। ওই সময়ে আমরা আন্তর্জাতিক ম্যাচ তেমন খেলার সুযোগ পাইনি বটে, তবে বাংলাদেশের ফুটবল কিন্তু এশিয়ার পর্যায়ের ছিল। আমাদের স্বপ্ন ছিল, এশিয়ান চ্যাম্পিয়ন হওয়ার। এখন দক্ষিণ এশিয়ার চ্যাম্পিয়ন হওয়াটাই আমাদের জন্য কষ্টকল্পনা।’ করোনার আগে মাঝেমধ্যে খেলা দেখতে স্টেডিয়ামে আসতেন। ফুটবলের টানে এলেও খেলা তাকে মোটেই আকৃষ্ট করত না। তার কথা, ‘এখনকার ফুটবলারদের খেলা দেখলে গায়ে জ্বালা ধরে। ফুটবল চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে গেল। কষ্ট হয়, যখন দেখি খেলোয়াড়দের হাতে ফুটবলের কফিনে পেরেক ঠোকা হচ্ছে। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) নেতৃত্বে এখন সাবেক ফুটবলাররা। তাদের হাতেই ফুটবল ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এটা আমাকে বড্ড পীড়া দেয়।’