ফুটবল শিল্পী মারীকে মনে রাখেনি কেউ

মোজাম্মেল হক চঞ্চল
প্রকাশ: ১০ মে ২০২০, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
২০১২ সালের ৯ মে পুব আকাশে উদিত হয়েছে ঝলমলে সূর্য। পাখির কলতানে ঘুম ভেঙেছে কোটি মানুষের। ওই ভোরেই চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছেন বাঁ পায়ের শিল্পী ফুটবলার চিং হ্লা মং মারী চৌধুরী। ৭৩ বছর বয়সে মর্ত ছেড়ে চলে যান ওপারে। আট বছরেই ব্রাত্য হয়ে গেলেন ফুটবলের এই বাঁ পায়ের শিল্পী।
কিংবদন্তি ফুটবলার ‘মারী’র নাম বিবেচনায় আসেনা স্বাধীনতা পুরস্কার মনোনয়নে। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) কিংবা যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় স্বাধীনতা পুরস্কারে বিবেচনার জন্য মারীর নাম সুপারিশ করে না। হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে যখন ইহলোকের মায়া ছেড়ে পরপারে চলে গিয়েছিলেন মারী, সেই সময়ে লাশের পাশে দাঁড়িয়ে ছেলে সুমনের আবেগময় কথায় উপস্থিত সবার চোখ ছলছল করছিল, ‘বাবার বড্ড আশা ছিল, স্বাধীনতা পুরস্কার পাবেন। কিন্তু সেই পুরস্কার পাননি। না পাওয়ার আক্ষেপ নিয়েই বাবা চলে গেলেন।’
বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে প্রতিভাবান এই খেলোয়াড়ের বিদায়টা ছিল বড্ড করুণ। অ্যালজাইমার্স রোগে আক্রান্ত হয়ে বেশ কয়েক বছর মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছিলেন মারী। কয়েক দফা চিকিৎসাও করিয়েছিলেন। কিন্তু অর্থাভাবে মারীর সুচিকিৎসা করা সম্ভব হয়নি তার পরিবারের। বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের (বিওএ) সাবেক মহাসচিব কুতুবউদ্দিন আহমেদ এবং বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সাবেক পরিচালক রিয়াজউদ্দিন আল মামুনের মতো কয়েকজন মহানুভব ক্রীড়া ব্যক্তিত্বের সহায়তায় কোনো রকমে চলেছিল মারীর চিকিৎসা।
১৯৩৯ সালে রাঙ্গামাটির চন্দ্রঘোনায় জন্ম নেন মারী। পুরো নাম চিং হ্লা মং চৌধুরী মারী। তবে সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে মারী চৌধুরী নামেই পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। ছোটবেলায় বাবা মারা যাওয়ায় মা অতিকষ্টে মানুষ করেন মারীদের। মারীর বাবা থয়সাউ চৌধুরী ছিলেন বোমাং রাজপরিবারের সন্তান। কিন্তু খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করায় রাজপরিবার থেকে বের করে দেয়া হয় মারীর বাবাকে। তিন ভাই ও এক বোনের সংসারে মারী ছিলেন সবার ছোট। মারী চৌধুরীর খেলোয়াড়ি জীবন শুরু হয় চন্দ্রঘোনা হাসপাতালের কাছে ছোট্ট একটি মাঠে। ভলিবল, ব্যাডমিন্টন, অ্যাথলেটিক্স ও ফুটবলে সামন পারদর্শী হয়ে ওঠেন মারী। ছাত্রজীবনে একজন ভালো অ্যাথলেট ছিলেন। হাইজাম্প, লংজাম্প, পোলভল্ট ও স্প্রিন্টে কখনও দ্বিতীয় হননি। তবে সবকিছু ছাপিয়ে ফুটবলই সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করে মারীকে। মা অচ্চাময়ী চৌধুরীর উৎসাহে মারী ফুটবলের দুর্দান্ত খেলোয়াড় হয়ে ওঠেন।
বরিশালের ব্যাপটিস্ট মিশন বয়েজ স্কুলে মারীর স্কুলজীবনের শুরু। নবম শ্রেণিতে থাকা অবস্থায়ই ১৯৫১ সালে মারী চট্টগ্রাম লিগে প্রথম খেলেন ফিরিঙ্গিবাজারের হয়ে। এই স্কুল থেকেই তিনি ১৯৫৩ সালে এসএসসি পাস করেন। ১৯৫৬ সালে ঢাকার জগন্নাথ কলেজ (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে এইচএসসি এবং ১৯৫৯ সালে একই কলেজ থেকে বিএ পাস করেন মারী।
মারীর প্রথম ক্লাব চট্টগ্রামের পোর্ট ট্রাস্ট। ১৯৫১ সালে ইস্টবেঙ্গল রেলওয়েতে যোগ দেন এই লেফট উইঙ্গার। ১৯৫২ সালে ভারতের আইএফএ শিল্ডে খেলতে গিয়ে নজর কাড়েন মারী চৌধুরী। ফায়ার সার্ভিসে এক মৌসুম কাটিয়ে যোগ দেন আজাদ স্পোর্টিংয়ে। আজাদে মারীর ফুটবল নৈপুণ্য তাকে বিখ্যাত করে তোলে। ১৯৫৩ সালেন পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ে ফুটবল দলের হয়ে খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন। ঢাকায় অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ের হয়ে তিনি ‘রোনাল্ড শিল্ড’ খেলেন। ১৯৫৪ সালে পাকিস্তান জাতীয় দলে জায়গা পাওয়া দু’জন বাঙালি ফুটবলারের মধ্যে একজন ছিলেন মারী। অন্যজন হলেন নবী চৌধুরী। ওই বছরেই অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় মুনশিয়ানার পরিচয় দেন। পাকিস্তান জাতীয় অলিম্পিকে হাইজাম্পে স্বর্ণ এবং ১০০ মিটার স্প্রিন্টে রুপা জেতেন। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান ভলিবল দলের অধিনায়ক নির্বাচিত হন মারী। পরের বছর পাকিস্তান সাদা দলের অধিনায়কত্বের আর্মব্যান্ড পরেন এই কিংবদন্তি ফুটবলার। খেলেছেন মোহামেডান, ইপিআইডিসি ও ঢাকা ওয়ান্ডারার্সে। ঢাকা লিগে মারীর গোল সংখ্যা দুইশ’র বেশি। এ মাইলফলক এখন পর্যন্ত অন্য কোনো ফুটবলার স্পর্শ করতে পারেননি। ১৯৫৭-’৫৮ দু’বছরে ঢাকা জগন্নাথ কলেজের পক্ষে খেলেছিলেন এবং সেই সময় ‘স্যার এএফ রহমান শিল্ড’ ও ‘গভর্নস কাপ’ জগন্নাথ কলেজ দলকে জেতান। এই কলেজ দলে তার সতীর্থ ছিলেন মুহাম্মদ কারুজ্জামান (বর্ষীয়ান ক্রীড়া সাংবাদিক) ও জাকারিয়া পিন্টু (স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক)।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মারী প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য শাখারিবাজার থেকে আগরতলা যান। সেখানে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও প্রয়াত সেক্টর কমান্ডার লে. জেনারেল (অব.) মীর শওকত আলীর সঙ্গে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলে খেলার জন্য প্রস্তুতি নেন এই জাত ফুটবলার। কিন্তু জিয়াউর রহমানের কথা ছিল, ‘ইউ প্লে লটস, নাউ ইউ প্লে উইথ বুলেটস।’ এ মন্ত্রে উদ্দীপ্ত হয়ে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলে যোগ দেয়া হয়নি মারীর। মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফেরার পর ফুটবলের সঙ্গে তেমন জড়াননি। ষাটের দশকে দর্শকদের মুখে মুখে ফিরত তিন ফুটলারের নাম। ঢাকার মাঠে ট্রায়ো বা ত্রয়ী হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছিলেন কবীর-আশরাফ-মারী। আশরাফ পরলোকে গেছেন সবার আগে। এরপর গেলেন মারী। আর গত বছরের ৩ জানুয়ারি চলে গেছেন কবীরও। জীবদ্দশায় স্বাধীনতা পুরস্কার পাননি মারী। ১৯৮১ সালে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পেয়েছেন। স্বাধীনতা পুরস্কার না পাওয়ায় আক্ষেপ নিয়ে না-ফেরার দেশে চলে গেছেন মারী।
এ প্রসঙ্গে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা জানান, ‘স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়া হয় নাম পাঠানোর জন্য। সে মোতাবেক আমরাও জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের মাধ্যমে বিভিন্ন ক্রীড়া সংস্থায় চিঠি পাঠাই। কিন্তু বাফুফে থেকে কখনও মারী সাহেবের নাম পাঠানো হয়নি। এটা অত্যন্ত নিন্দনীয়। ভবিষ্যতে মন্ত্রণালয় থেকে মারী সাহেবের নাম স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদানের সুপারিশ করব।’