কারও সংগ্রহে নেই দেশের খেলাধুলার রেকর্ড!
মোজাম্মেল হক চঞ্চল
প্রকাশ: ৩১ মার্চ ২০২০, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ঢাকা লিগে এক মৌসুমে সবচেয়ে বেশি গোল কার? ১৯৮২ সালে মোহামেডানের ফরোয়ার্ড সালাম মুর্শেদী ২৭ গোল করেছিলেন। এ তথ্য সঠিক নয়। ১৯৫৫ সালে আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের আনোয়ার করেছিলেন ৪৯ গোল। প্রয়াত ফুটবলার মারি ক্যারিয়ারে ২৩৪ গোল করে সর্বাধিক গোলদাতাদের তালিকায় শীর্ষে রয়েছেন। এরপর আছেন স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সেরা ফরোয়ার্ড শেখ আসলাম। এ তথ্যগুলো বাফুফেতে নেই। তাদের যে কোনো আর্কাইভই নেই।
ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণ হয় না। আবদুল হাকিম নামে বাফুফেতে এক কর্মচারী ছিলেন। ব্যক্তিগত তাগিদে তিনি রেকর্ডপত্র সংগ্রহে রাখতেন। হাকিম অবসরে যাওয়ার পর ওই পথ মাড়ান না কেউ। বাফুফেতে একগাদা টাকা খরচ করে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো লাইব্রেরিয়ান নেই। কয়েক বছর আগে বাফুফে একটি ওয়েবসাইট চালু করে।
ওয়েবসাইটে ঘরোয়া ফুটবলের রেকর্ড, তথ্য, পরিসংখ্যান কিছুই নেই। অন্য ফেডারেশনগুলোর মতো তথ্য সংরক্ষণে উদাসীন ক্লাবগুলোও। আবাহনী-মোহামেডানের হয়ে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলেছেন কে? আবাহনী-মোহামেডানও তাদের রেকর্ড সংরক্ষণ করেনি।
দেশের সবচেয়ে বড় ফেডারেশন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। আন্তর্জাতিক রেকর্ড-তথ্য ক্রিকইনফোর মাধ্যমে পাওয়া গেলেও ঘরোয়া ক্রিকেটের কোনো পরিসংখ্যান দিতে পারে না বিসিবি। প্রায় একযুগ আগে এক ক্রীড়া সাংবাদিককে দিয়ে বিসিবি ঘরোয়া ক্রিকেটের রেকর্ড বুক তৈরি করেছিল। ভুলে ভরা ওই রেকর্ড বুক কোনো কাজেই আসেনি।
বিসিবির সাবেক সাধারণ সম্পাদক তানভীর মাজহার তান্না আক্ষেপ করে বলেন, ‘তোমাদের একটি সাংবাদিক সংস্থার সাবেক সভাপতিকে আমার কাছে থাকা বাংলাদেশ ক্রিকেটের অনেক অজানা তথ্য ও ছবি দিয়েছিলাম। কথা ছিল, বই বের করব। ওই সাংবাদিককে বড় অঙ্কের টাকাও দিয়েছিলাম। টাকা নেয়ার পর তাকে আর খুঁজে পাইনি। লোক মারফত খবর পাঠিয়েছিলাম টাকা লাগবে না, তুমি আমার ছবি ও কাগজপত্র ফেরত দাও। তারপরও আসেনি। খুব কষ্ট পেয়েছি। দুর্লভ অনেক তথ্য ও ছবি গায়েব হয়ে গেল।’
ক্রীড়াঙ্গনের রেকর্ডপত্র খুঁজতে সংশ্লিষ্টদের এখন দৌড়াতে হয় বর্ষীয়ান সংগঠক ও সাংবাদিকদের কাছে। খেলাধুলার রেকর্ড রাখতেন প্রয়াত ক্রীড়া সাংবাদিক আতাউল হক মলিক, মাসুদ আহমেদ রুমি ও বদিউজ্জামানরা। বর্তমানদের রেকর্ড সংগ্রহে বেগ পেতে হচ্ছে। অনেক সময় সঠিক ইতিহাস ও তথ্য পাওয়া যায় না। বাংলাদেশে ক্রীড়া সাংবাদিকদের তিনটি সংস্থা রয়েছে। তারাও রেকর্ড-তথ্য সংরক্ষণে উদাসীন।
২০ বছর আগের রেকর্ড খুঁজে পাওয়া যাবে না কোথাও। এত বছরেও তৈরি হয়নি খেলাধুলার ইতিহাস-ঐতিহ্যের কোনো পাঠাগার। শুটার শাহানা পারভীন নাকি গলফার সিদ্দিকুর, কে প্রথম সরাসরি অলিম্পিক গেমসে অংশ নেয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন? প্রিমিয়ার হকি লিগের এক মৌসুমে সর্বোচ্চ গোলদাতা কে? জাতীয় ফুটবল দলের সর্বোচ্চ গোলদাতা নিয়ে বিতর্ক ছিল। আসলাম, চুন্নু, এমিলি, আলফাজরা সবাই সর্বোচ্চ গোলদাতার দাবি তুলেছিলেন।
সেই বিতর্কেরও সুরাহা হয়নি। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) কাছে কোনো রেকর্ড নেই। খেলাধুলার সঙ্গে পরিসংখ্যান ও রেকর্ডের নিবিড় সম্পর্ক। কিন্তু প্রকৃত তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণে ফেডারেশন, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ও বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন (বিওএ) মনোযোগী নয়। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ও উদাসীন।
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) ওবায়দুল্লাহর উদ্যোগে ১৯৯০ সালে ‘আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ২০ বছরের বাংলাদেশের খেলাধুলা’ শীর্ষক একটি রেকর্ড বুক ছাপানো হয়েছিল। এরপর কেটে যাচ্ছে ৩০ বছর। ক্রীড়া পরিষদের কোনো উদ্যোগ নেই ওই রেকর্ড বইয়ের সর্বশেষ সংস্করণ বের করার। একটি ক্রীড়া আর্কাইভের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এ প্রসঙ্গে সাবেক তারকা ফুটবলার সৈয়দ রুম্মান বিন ওয়ালী সাব্বিরের মন্তব্য, ‘সংরক্ষণের অভাবে দেশের খেলাধুলার ইতিহাস-ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে। অতীত রেকর্ড কারও সংগ্রহে নেই।’