বিআইডিএসের সমাপনী গবেষণা সম্মেলন
মূল্যস্ফীতি ও আয় বৈষম্য কমানোই প্রধান চ্যালেঞ্জ
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৯ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বিদ্যমান অবস্থায় মূল্যস্ফীতি ও আয় বৈষম্য কমানোই এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ। এ অবস্থায় কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
তবে সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে সরবরাহ বাড়াতে হবে। পাশাপাশি কর্মসংস্থান তৈরি, বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি, বিনিময় হার এক রেটে নিয়ে আসা, রিজার্ভ বাড়াতে রেমিট্যান্স হুন্ডিতে আসা বন্ধ করাসহ নানা উদ্যোগ নেওয়ার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
সেই সঙ্গে প্রকল্প তৈরি ও বাস্তবায়ন পর্যায়ের মিসম্যাচ দূর করতে হবে। বৃহস্পতিবার বিআইডিএসের সমাপনী গবেষণা সম্মেলনে এসব কথা বলা হয়।
রাজধানীর লেকশোর হোটেলে এ সম্মেলনের আয়োজন করে বিআইডিএস। এদিন প্রায় ১০টি গবেষণাপত্র উপস্থাপন করা হয়। সম্মেলনের সমাপনী অধিবেশনে প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।
বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেনের সভাপতিত্বে এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিআইডিএসের সিনিয়র রিসার্স ফেলো ড. কাজী ইকবাল। আলোচনায় অংশ নেন আইএমইডির সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য এমদাদ উল্লাহ মিয়ান, আব্দুল বাকী, পিআরআইর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর, সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান প্রমুখ।
ড. মসিউর রহমান বলেন, রাষ্ট্র ও সরকারের অঙ্গীকার থাকলে বৈষম্য কমানো সম্ভব। সরকার সেটিই করছে। ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ না হলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না। কিন্তু গত ৩-৪ বছর ব্যক্তি বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে। তিনি আরও বলেন, প্রকল্প অনুমোদন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও মিসম্যাচ আছে। এটি দূর করতে হবে। এখন থেকে ভূমি অধিগ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত করেই প্রকল্প হাতে নেওয়া উচিত।
পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। বর্তমান মূল্যস্ফীতি আমদানিকৃত। এটা বৈশ্বিক কারণে সৃষ্ট। কিন্তু এটা নিয়ন্ত্রণ সুদের হার বাড়িয়ে হবে না। সরবরাহ বাড়াতে হবে। সেজন্য আগামী বাজেটে মূল্যস্ফীতিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বাজেট হবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার। সেই সঙ্গে করোনার আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ায় বাজেটের মূল লক্ষ্য। তিনি আরও বলেন, ধনী গরিবের আয় বৈষম্য থাকবে। এটাই স্বাভাবিক। কারণ ধনীরা বেশি বিনিয়োগ করে বেশি আয় করে, সেখানে দরিদ্রদের বিনিয়োগ থাকে অল্প।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, সরকার ও ব্যাংক চাইলেও হুন্ডি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এজন্য ভারতের মডেল অনুসরণ করে অ্যাপের মাধ্যমে রেমিট্যান্স আনার কাজ করা হচ্ছে। প্রবাসীরা পছন্দ অনুযায়ী ব্যাংকের মাধ্যমে ঘরে বসেই অ্যাপসে রেমিট্যান্স পাঠাতে পারবে। অবশ্য এটা করতে ১-২ বছর সময় লাগবে।
গভর্নর বলেন, এখন মাল্টিপল ডলার রেট করা হয়েছে সাময়িক। আগামী ৩-৪ মাসের মধ্যে ডলারের দাম এক রেটে চলে আসবে। এছাড়া রিজার্ভ কমল কি বাড়লো সেটি বড় কথা নয়। যদি প্রতিদিন একটু একটু করে রিজার্ভ বাড়ে, তাহলেই ভালো। সেই সঙ্গে আমদানি খরচ যদি কম থাকে তাহলে সমস্যা নেই। কিন্তু রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন হলো আর খরচ একবারেই অনেক বেশি হয়ে যায়, তাহলে ঝামেলা আছে।
তিনি আরও বলেন, আগে বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা সস্তায় বিদেশি ঋণ আনত বলে রিজার্ভ বেড়েছিল। কিন্তু এখন সন্তা ঋণ নেই। সেই সঙ্গে যারা ঋণ নিয়েছিলেন তারা ডলারের মাধ্যমে পরিশোধ করছেন। এরই প্রভাব পড়েছে রিজার্ভের ওপর। বর্তমান ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্সের ঘাটতি মাইনাস ২ শতাংশ আছে। সেটি আগামী দুই মাসের মধ্যে শূন্যে নামিয়ে আনা হবে।
পলিসি রিসার্চ ইনিস্টিটিউটের (পিারআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। সরকার যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে সেগুলো কাজে দিচ্ছে না। ফলে আসন্ন বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ থাকতে হবে। বিনয়াক সেন বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী সহজ বিষয় পড়তে পারে না। অতএব মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
সেমিনারে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিকে মাথায় না রেখে আমাদের দেশে অধিকাংশ সময় পরিকল্পনা নেওয়া হয়। সমস্যা এখানেই। ভবিষ্যৎ বাজেট প্রণয়নে এই বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে। তিনি আরও বলেন, দেশে আয় বৈষম্য ব্যাপক হারে বেড়েছে।
দক্ষ কর্মীর অভাব : সেমিনারে বলা হয়, দেশের সরকারি ও বেসরকারি কোম্পানিগুলো দক্ষ কর্মী পাচ্ছে না। পাশাপাশি শিক্ষার দিক দিয়েও রয়েছে অনেক ঘাটতি। যেখানে প্রয়োজন উচ্চশিক্ষার লোক সেখানে তারা তা পাচ্ছে না। এর পেছনে অন্যতম কারণ শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি। মূলত দক্ষ কর্মীর এই ঘাটতি রয়েছে হালকা ও মাঝারি প্রকৌশল ও ইলেকট্রনিক্স খাতে। চামড়া ও অন্যান্য খাতে শ্রমিক পাওয়া গেলেও কাক্সিক্ষত শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। এ সংক্রান্ত গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন বিআইডিএসের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. কাজী ইকবাল।
অন্য এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্যানসার চিকিৎসায় ৯০ শতাংশ পরিবার নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া অপর একটি গবেষণায় বলা হয়, উন্নয়ন প্রকল্পের সময় বৃদ্ধির ফলে অনেক বেশি ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। গত কয়েক বছরে সড়কের ৩৬৯টি প্রকল্পের অডিট রিপোর্ট গবেষণা করে দেখা গেছে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে ৮০ শতাংশ প্রকল্পে। ব্যয় ও সময় বেড়েছে ৫০ শতাংশ প্রকল্পে। প্রকল্পগুলোর গড় ব্যয় বেড়ছে ২৬ শতাংশ এবং গড় সময় বেড়েছে ৯৫ শতাংশ। এছাড়া ভূমি, অধিগ্রহণ, দরপত্র প্রক্রিয়াকরণ, নতুন অঙ্গ সংযুক্তিসহ নানা কারণে ব্যয় ও মেয়াদ বাড়ছে।