পিআরআই-সিডিইআর’র সেমিনারে বক্তারা
কর্মসংস্থান বৃদ্ধির চ্যালেঞ্জে দেশ
বিদেশি শ্রমিকরা নিয়ে যাচ্ছে বছরে ৩-৪ বিলিয়ন ডলার
যুগান্তর রিপোর্ট
প্রকাশ: ০২ মার্চ ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের ব্যাপক অগ্রগতি থাকলেও কর্মসংস্থানে রয়েছে হতাশা। অর্থাৎ কর্মসংস্থান বিশেষ করে শোভন কর্মসংস্থান বাংলাদেশের জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ। সার্বিকভাবে এবং বিশেষ করে শিল্প খাতে কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধিতে বড় ধরনের পতন ঘটেছে। শিল্প খাতে কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি এত কমে যাওয়াটা বিশেষ দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ এ খাতে শ্রমের সুযোগ এবং মজুরি সাধারণত কৃষির চাইতে বেশি। বাংলাদেশের মতো অর্থনীতির দেশে উন্নয়নের প্রাথমিক পর্যায়ে শিল্প খাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করাটা অত্যন্ত জরুরি। সোমবার পলিসি রিসার্স ইন্সটিটিউট (পিআরআই) আয়োজিত সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন। রাজধানীর বনানীতে সংস্থাটির কার্যালয়ে আয়োজিত সেমিনারে সহযোগী আয়োজক ছিল সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট রিসার্স (সিডিইআর)। এতে আরও বলা হয়েছে- এ দেশ থেকে অদক্ষ শ্রমিক বিদেশে গেলেও বিদেশ থেকে দক্ষ শ্রমিক এসে বছরে ৩-৪ বিলিয়ন ডলার বেতন হিসেবে নিয়ে যাচ্ছেন। এটা চলতে দেয়া যায় না।
‘বাংলাদেশ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড লেবার মার্কেট ওয়াচ-২০১৯ : সেক্টরাল চ্যালেঞ্জ অ্যান্ড অপরচ্যুনিটিস’ শীর্ষক এ সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন পিআরআই চেয়ারম্যান জাইদী সাত্তার। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। বিশেষ অতিথি ছিলেন সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য ড. শামসুল আলম। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পিআরআই’র সম্মানীয় ফেলো ড. রিজওয়ানুল ইসলাম, সিডিইআর’র নির্বাহী চেয়ারপারসন ড. রুশিদান ইসলাম রহমান, সিডিইআর’র সিনিয়র ফেলো ড. কাজী শাহবুদ্দিন। আলোচক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এমএম আকাশ ও বিআইডিএস সিনিয়র রিসার্স ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ। মূল প্রবন্ধে ড. রিজওয়ানুল ইসলাম বলেন, কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধির হার কেন এত কমে গেছে- এ বিষয়ে তেমন কোনো গবেষণা হয়নি। প্রাথমিক বিশ্লেষণে কয়েকটি বিষয় উঠে আসে। এগুলো হল- ২০০৫-০৬ সময়কালে উৎপাদন বৃদ্ধিতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান দুইয়েরই অবদান প্রায় সমান ছিল; কিন্তু ২০১০ থেকে ২০১৬-১৭ সময়কালে এটি বদলে যায়। দেখা যায়- এ সময়ে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির অবদান কর্মসংস্থানের চাইতে অনেক বেশি। ২০১২ থেকে ২০১৯ সময়কালে শিল্প খাতের পুঁজিনিবিড়তা (অর্থাৎ পুঁজি এবং শ্রমের অনুপাত) অনেক বেড়ে যায় । ফলে কর্মসংস্থান কম বাড়িয়েও উৎপাদনশীলতা বেশি বাড়িয়ে প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হয়েছে। এছাড়া বেশ কয়েকটি শ্রম-নিবিড় শিল্প যেমন- তৈরি পোশাক, বস্ত্র, জুতা, ইলেকট্রনিক্স, আসবাব ইত্যাদি থাকা সত্ত্বেও শুধু একটি শ্রম-নিবিড় শিল্প তৈরি পোশাকই উল্লেখযোগ্য হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। এ খাতই কেবল বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পেরেছে। তবে পোশাক খাতে সাম্প্রতিককালে কর্মসংস্থান বাড়ছে বলে মনে হয় না। কর্মসংস্থান বাড়াতে এ খাতের গঠনে বৈচিত্র্য আনা অত্যন্ত জরুরি। রফতানি বৃদ্ধির জন্য প্রণোদনা একটি শিল্পের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সব খাতের জন্য সমানভাবে দেয়া প্রয়েজন। যদি কোনো রফতানিমুখী শিল্প বিশেষ বাধার সম্মুখীন হয়, তবে তাদের সেসব বাধা অতিক্রম করার জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয়া উচিত।
রুশিদান ইসলাম রহমান বলেন, বিএমইটি’র তথ্যমতে অভিবাসী হয়ে যারা বিদেশ যায় তারা যে দুঃখ বা কষ্টের মধ্যদিয়ে যায়, সেটি তত জানা যায় না। কিন্তু তাদের পাঠানো অর্থ বিদেশি কর্মসংস্থানের একটি উজ্জ্বল চিত্র দেখায়। সেটা তরুণদের বিদেশ যাওয়ার আগ্রহ বাড়ায়। দেশে শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণে বা দক্ষতা বৃদ্ধিতে নিরুৎসাহিত করে। ২০০০ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত দেশে তরুণদের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার ৪৭ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছিল ৫৩ দশমিক ২ শতাংশ। অথচ ২০১০ সাল থেকে ২০১৭ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪৭ দশমিক ৪ শতাংশে। বিদেশে শ্রমিক পাঠানো নিরুৎসাহিত নয় বরং অদক্ষ বা প্রায় অদক্ষ শ্রমিক পাঠানো আগামী ১০-১৫ বছরে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে দক্ষ শ্রমশক্তি পাঠাতে হবে। তাহলে অভিবাসীর সংখ্যা কমিয়েও রেমিটেন্স একই থাকবে। তিনি বলেন, আগামী ১০ বছরে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কারণে কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তা, রোবট ইত্যাদির ব্যবহার বাড়ছে। ফলে অদক্ষ শ্রমিকদের অভিবাসন হঠাৎই দ্রুত কমে যাবে। এজন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। আমরা অদক্ষ শ্রমিক বিদেশে পাঠাচ্ছি। অন্যদিকে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বিদেশি শ্রমিক এ দেশে এসে বছরে ৩-৪ বিলিয়ন ডলার নিয়ে যাচ্ছেন।
পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, বৃহত্তর পরিসরে দেখলে বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক ভালো করছে। তবে ক্ষুদ্র পরিসরে কিছু জায়গায় সমস্যা রয়েছে। সেগুলো সমাধানে আমরা নীতি-পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছি। তবে তথ্যের ঘাটতি রয়েছে। প্রতি বছর কত কর্মসংস্থান হচ্ছে এবং কোন কোন জায়গায় তারা কাজ করছে এসব হালনাগাদ তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। তবে আগামী বছর জনশুমারি হলে এর একটি পূর্ণাঙ্গ এবং হালনাগাদ চিত্র পাওয়া যাবে।
ড. শামসুল আলম বলেন, অর্থনীতির অনেক জায়গায় এখনও সুযোগ রয়েছে। যেমন- কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ব্যাপক বিনিয়োগ হতে পারে। কৃষিতে বড় আকারে ফার্ম করার সুযোগ আছে। কিন্তু উদ্যোক্তারা কেন এটা করছেন না। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় আমরা কর্মসংস্থান তৈরির জন্য নানা উদ্যোগ রাখছি।
ড. এমএম আকাশ বলেন, এ দেশে শিক্ষিত তরুণদের কাজের জায়গা কম। অশিক্ষিত বা অদক্ষ শ্রমিকদের জন্য কাজের স্থান রয়েছে। কিন্তু সেটি হচ্ছে প্রায় ৮৫ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। আর প্রায় ১৫ শতাংশ হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে। দেশের লেখাপড়ার সঙ্গে কর্মের সম্পর্ক নেই। তবে কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের ফলে গ্রামে এক সময় কৃষি শ্রমিকরা কাজ করতে পারবেন বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, দেশে বৈষম্য বাড়ছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্যোগ থাকতে হবে। তিনি বলেন, চালের ক্ষেত্রে যেমন দেখা যায় চকচকে পলিসিং করা হয়। এতে কেজিতে দাম বাড়ে ৩-৪ টাকা। তবে এর ফলে পুষ্টিমান বাড়ে না বরং কমার সম্ভাবনা থাকে। তাই এ ধরনের যন্ত্রাংশ আমদানিতে নিরুৎসাহিত করতে হবে।
