Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

বই আলোচনা

আব্দুল্লাহ শুভ্র’র মাখনের দেশলাই

Icon

রেশমা হাওলাদার

প্রকাশ: ২৬ মে ২০২২, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

এ বছর বইমেলায় প্রকাশিত ‘মাখনের দেশলাই’ উপন্যাসটি বিভিন্ন কারণে পড়তে ভালো লেগেছে। একটি বিশেষ কারণ-উপন্যাসের চরিত্রগুলো যে গল্প বিছিয়ে এগিয়েছে-তা মূলত তিনটি প্রজন্মের ইতিহাস। আমি ইতিহাসই বলব। ইতিহাসে সরাসরি সাল তারিখ দিয়ে একটি সময়ের কথা লেখা হয়। গল্প উপন্যাসে সাল তারিখ থাকে না ঠিকই, কিন্তু একটা সময়কে অঙ্কিত করাই থাকে এর লক্ষ্য। প্রত্যেক উপন্যাসকেই আমি ঐতিহাসিক উপন্যাস বলে থাকি এই অর্থে যে, এখানে অন্তত মানুষের জীবন প্রণালির ইতিহাস থাকে। তার কালচারের ইতিহাস থাকে, তার সংস্কারের ইতিহাস থাকে, তার উন্নতি অবনতির ইতিহাস থাকে; সে অর্থে-আমি এই উপন্যাসকেও কিছুটা ঐতিহাসিক বলতে আগ্রহী। এখানে জীবনের নানা বাঁক পরিবর্তনের চিত্র উঠে এসেছে। জীবনযুদ্ধের ইতিহাসে উঠে এসেছে সেই সময়ের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক চিত্র।

আব্দুল্লাহ শুভ্র’র লেখা উপন্যাসটির শুরু মুসাব আলী নামের এক দরিদ্র মানুষের ছোট চাকরি এবং আরও ছোট্ট স্বপ্ন নিয়ে। দেখা যায় মুসাব আলীর মামা অনেক চেষ্টা করে ভাগ্নের জন্য এই চাকরির ব্যবস্থা করেন। রেলের দারোয়ানের চাকরি যার কাছে অনেক বড় স্বপ্নপূরণের শামিল সেই মুসাব আলীর জীবনটা যেমন রহস্যময় তেমনই সেই সময়ের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক চিত্রটিও গবেষণার বিষয়। মানুষ কত ছোট্ট চাওয়ায় ভালো থাকতে পারে। মানুষের কত ছোট স্বপ্নেও জীবনে ভাবনার ফুল ফুটতে পারে-তা মুসাব আলীর প্রথম সময়ের ঘটনায় অত্যন্ত সুন্দরভাবে লেখক ফুটিয়ে তুলতে পেরেছে। পেরেছেন বলব না, বলব আবিষ্কার করেছেন। মুসাব আলী আর তার স্ত্রী লালবানুর নিজেদের থাকা ছোট্ট জোনাকির আলোয় পৃথিবী দেখার সৌন্দর্য উপন্যাসের প্রথম অংশটিকে আলোকিত করে রেখেছে। তাদের এ সাংসারিক ছোট্ট স্বপ্ন বয়ে নিতে মুসাব আলী আর তার স্ত্রী লালবানুকে অনেক প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। আমরা দেখতে পেয়েছি মুসাব আলীর রেলের উপরস্থ কর্মকর্তার অসদাচারণ, মুসাব আলীর কাছ থেকে ঘুস নিতে পারবে না ভেবে মুসাব আলীকে চাকরিচ্যুত করার চেষ্টা। বাড়িওয়ালি খালা মূলত ছদ্মবেশী শয়তান টাইপের একটা মানুষ। কবিরাজের কাণ্ডকারখানা। আবার পরিনতির মতোই মাখনের মাধ্যমে কবিরাজের হৃদয়হত হওয়া। লেখক এ দম্পতির জার্নির মাধ্যমে সমাজের কোথায় কোথায় কোন মাত্রার সংকীর্ণতা এবং সীমাবদ্ধতা আছে তা দেখাতে সক্ষম হয়েছেন। এবং একই সঙ্গে সততা এবং নিষ্ঠা থাকলে যে মুসাব আলীদের স্বপ্নও পূরণ হতে পারে তাও উপন্যাসের শেষভাগে দেখা যায়। তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র মানুষ নিজের উন্নয়নের চেয়ে অন্যের ক্ষতি বেশি চায়-এ উপন্যাসের কয়েকটি চরিত্রে তা ফুটে উঠেছে। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে পালক পুত্রের শ্রম এবং নিষ্ঠায় সফল হওয়া মুসাব আলীর সুখের সংসারে আগুন ধরিয়ে দেয় তারই আপন সন্তান মাখন এবং তা নিজের পালক ভাইয়ের সাফল্যে ঈর্ষান্বি^ত হয়ে। মাখনের চরিত্রটি উপন্যাসের সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে কিছুটা অপরিচিত মনে হলেও, বর্তমান সময়ে মাখনদেরই রাজত্ব। মাখনরাই জ্বালিয়ে দেয় অন্যের সুখ, এবং কারও অনিষ্ট করা যে নিজেরই ক্ষতি বয়ে আনা লেখক এখানে তা যৌক্তিকভাবে দেখিয়েছেন। দেখিয়েছেন মাখনের নিজের দেশলাইয়ের আগুনে পুড়ে মরার মতো ভয়াবহ পরিণতির মাধ্যমে।

উপন্যাসটিতে ত্রিমুখী ফোকাস রয়েছে। সামাজিক বাস্তবতা। দারিদ্র্যের কশাঘাত। ব্যক্তি মানুষের সততা অসততা। এ ছাড়া একটা বড় মেজেস দেওয়া হয়েছে নিজেদের মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তি মুসাব আলীর দোকানের কর্মচারী খেলুর আবির্ভাবের মাধ্যমে। খেলু থাকে মুসাব আলীর সাংসারিক অশান্তির আরেক খেলোয়াড়। সব মিলিয়ে একটা সফল উপন্যাস। অসাধারণ গদ্য। মাঝে মধ্যেই সুন্দর সুন্দর দৃশ্যকল্প। পড়তে গিয়ে এক বসায় শেষ করার মতো উপন্যাস।

মাখনের দেশলাই আব্দুল্লাহ শুভ্র। প্রকাশক কবি প্রকাশনী।

প্রচ্ছদ ধ্রুব এষ। মূল্য ৩০০ টাকা।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম