কক্সবাজার জেলার সাহিত্য নিয়ে বিশেষ আয়োজন
কক্সবাজারের সাহিত্য

সাইয়্যিদ মঞ্জু
প্রকাশ: ০৫ নভেম্বর ২০২১, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

এ পর্যটন নগরী, মৎস্য বন্দর, সমুদ্র শহর, হলুদ ফুলের দেশ কক্সবাজারের সাহিত্য নিয়ে কথা এলেই আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্যের প্রসঙ্গটা আনেন অনেকেই। কক্সবাজারের সংস্কৃতিতে আরাকান রাজসভায় রচিত সাহিত্যের প্রভাব এখনো প্রবহমান। কারণ কক্সবাজার পুরোনো আরাকান রাজ্যের অংশ ছিল। কিন্তু দেখা যায়, আরাকান রাজসভায় গুরুত্বপূর্ণ কবিদের মধ্যে কেউ কক্সবাজারে জন্মগ্রহণ করেননি। আরাকান রাজসভার কবি মাগন ঠাকুর, শাহ সগীর, দৌলত কাজী বা আলাওল এরা সবাই চট্টগ্রাম নিবাসী বলে বেশিরভাগ পণ্ডিত গবেষক ঐকমত্য পোষণ করেছেন। এরও অনেক পর আসলে শহর হিসাবে কক্সবাজারের বিকাশ। কক্সবাজারের নিম্নাংশে হয়তো তখন কোনো মানুষ বসবাস করত কিনা সন্দেহ। মি. হিরাম কক্সকে তো রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান ও পাহাড়ে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের সমতলে আনার জন্যই পাঠানো হয়েছিল। পালংকি প্যানোয়া নাম থেকে হিরাম কক্সের নামে কক্সবাজরের নামকরণ হয়। কক্সবাজারের মানুষের ভাষার সঙ্গে আরাকানিদের ভাষা অভিন্ন হলেও বাংলা সাহিত্যে কক্সবাজারের অনেকে প্রতিনিধিত্ব করছে। কক্সবাজারে গান, মানে আঞ্চলিক গান ও অনেক এগিয়ে। কক্সবাজার অঞ্চলের আঞ্চলিক গানের মর্ম ও সুর অনেক গভীরে প্রবেশ করে। যেমন একটা উদাহারণ দেওয়া যাক। ‘অঁ হালা চাঁন গলার মালা, পেট পুরেদ্দে তোঁয়ার লাঁই’ এ এক অসামান্য শব্দবন্ধ। যারা চট্টগ্রামের ভাষা বোঝেন না, তারা কখনো এ সৌন্দর্যের দেখা পাবে কিনা সন্দেহে।
কক্সবাজারে জন্ম নেয়া লেখদের মধ্যে জাতীয় পর্যায়ে পরিচিত মুখ কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, প্রাবন্ধিক সলিমুল্লাহ খান, অনুবাদক জাফর আলম, সাদাত উল্লাহ খান, কবি আসিফ নূর, কবি ও প্রাবন্ধিক জাহেদ সরওয়ার, কবি নির্ঝর নৈঃশব্দ্য অন্যতম। মুহম্মদ নুরুল হুদা সমকালীন বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কণ্ঠস্বর। তার কাব্য প্রয়াসের কেন্দ্রে রয়েছে ব্যক্তিমানুষ, জাতিমানুষ ও বিশ্বমানুষের সমীকৃত প্রতিকৃতি জাতিসত্তার কবি রূপে তার রয়েছে ব্যাপক পরিচিতি। তিনি বর্তমানে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক। তিনি মূলত কবি। কবিতার পাশাপাশি সাহিত্যের অন্যান্য শাখায়ও সমান সক্রিয়। তার কিছু কবিতা মানুষের মুখে মুখে ফেরে। যেমন-‘আমরা তামাটে জাতি’, ‘যতদূর বাংলাভাষা ততদূর এই বাংলাদেশ’ ‘পায়ের সাথে সবই কাঁপে’ ইত্যাদি। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে কবির নামে র্নিমাণ করা হয়েছে ‘হুদা কবিতা মঞ্চ’।
প্রাবন্ধিক গবেষক শিক্ষক সলিমুল্লাহ খান প্রথমে কবিতার বই ‘এক আকাশের স্বপ্ন’ দিয়ে শুরু করলেও তিনি আর কবিতার বই করেননি। কবিতা লিখেননি সে কথা বলা যাবে না। পরে তিনি দুটি কবিতার বই অনুবাদ করেছেন। ডরোথি জুল্লের আল্লাহর বাদশাহি ও পেন্টি সারিকোস্কির উহারা বাতাসে নামের কবিতা সংকলন। একজন প্রথিতযশা বাংলাদেশি চিন্তাবিদ লেখক ও বুদ্ধিজীবী হিসাবে সলিমুল্লাহ খান প্রসিদ্ধ। তার কয়েকটি বইয়ের নাম-‘আদমবোমা’, ‘স্বাধীনতা ব্যবসায়’, ‘প্রার্থনা’, ‘আহমদ ছফা সঞ্জীবনী’, ‘বেহাত বিপ্লব ১৯৭১’, (সম্পাদিত) ‘আমি তুমি সে’ ইত্যাদি। প্রয়াত জাফর আলম বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অনুবাদক, তিনি উর্দু সাহিত্য থেকে অনেক অনুবাদ করেছিলেন-সাদাত হাসান মান্টো, কুররাতুল আইন হায়দার, ফয়েজ আহমেদ, মির্জা গালিবসহ অনেকের প্রবন্ধ কবিতা তিনি অনুবাদ করেছিলেন। কবি শাকিল মামুদ ও কবি শাহেদ সাদ উল্লাহও এখন দু’জনই আমেরিকায়। প্রথম দিকে দু’জনের মধ্যেই প্রচুর সম্ভাবনা দেখা দিলেও দু-একটা গ্রন্থ করার পর দু’জনই আমেরিকা পাড়ি জমায়। আমেরিকা অবস্থানকালে তাদের সাহিত্যের সঙ্গে দূরত্ব ক্রমে বাড়তে থাকে। শাকিল মাহমুদ, শামসুর রহমান ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘দুই বাংলার ভালোবাসার কবিতা’ (১৯৯৮) সংকলনে অন্তর্ভুক্ত কবি তার একমাত্র গ্রন্থ ‘উজান জোয়ান’।
কক্সবাজারকে বলা যায় পর্যটন শহর বা রাজধানী। পাহাড় ও সমুদ্রবেষ্টিত এ শহর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত। এ মনোরম পরিবেশ নিজের সৌন্দর্যের বিকিরণ সম্ভবত তার লেখক কবিদের নিয়ে ঘটায়। তাই কক্সবাজারে কবির সংখ্যা যত বেশি অন্যান্য ক্ষেত্রে তত তৎপরতা নেই। তবে কক্সবাজারের পুরোনো দিনের আঞ্চলিক ভাষায় অনেক বচন বা লোককাহিনি ফেরে মানুষের মুখে মুখে। এসব কাহিনি কেচ্ছা হিসাবে প্রচলিত। কক্সবাজারের অপরাপর কবি ও লেখকরা হচ্ছেন, খালেদ মাহবুব মোর্শেদ, সিরাজল হক সিরাজ, কবি ভাগ্যধন বড়ুুয়া, ঐতিহাসিক মুহিবুল্লাহ ছিদ্দিকী, অমিত চৌধুরী, শিরিন আকতার, আদিল চৌধুরী, মাস্টার শাহ আলম, আহমেদ রায়হান, মোক্তার আমদ রাশেদ, অরণ্য শর্মা, মানিক বৈরাগী, সোহেল ইকবাল, কামরুল হাসান, মনজুর কাদের, এনএম হাবিব উল্লাহ, জসিম উদ্দিন, হাসিনা চৌধুরী লিলি, সুলতান আহমেদ, সেলিম রাহগীর, শাওয়াল খান, মোশতাক আহমদ, মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম, দর্পণ বড়ুয়া, রাহগীর মাহমুদ, পদ্মলোচন বড়ুয়া, আশীষ কুমার, ঝিনুক জোবাইদা, নাসিমা হক মুক্তা, শামীমা আকতার, ফারজানা সিকদার, আলী প্রয়াস, খালেদ শহীদ, নুপা আলম, রুহুল কাদের, কালাম আজাদ, জয়ন্ত জিল্লু, আজিজ কাজল, আনোয়ারুর রহমান, হাসেম সৈকত, সাগর শর্মা, ইয়ার ইগনিয়াস, মোঃ আমানুল্লাহ, মঞ্জুরুল ইসলাম, নাসের ভুট্টো, মোস্তাক মুকুল, হাসান মুরাদ ছিদ্দিকী, একরাম আজাদ, নিঃশব্দ আহমেদ, সুব্রত আপন, রুদ্র শাহাদাৎ, আহমদ সোলতান, শাহিন মোঃ আরিফ, মিজান মনির, প্রদীপ প্রোজ্জল, মোঃ শাহ আলাম, আলম তৌহিদ, জহিরুল ইসলাম, জহির সিদ্দিকী, হুমায়ূন সিদ্দিকি, বশিরুজ্জামান, আলম ছৈয়দ, ঋতিল মনীষা, মাহবুব রোকন, রহমান মফিজ, কুতুব হিলালী, মনির ইউসুফ, সাইয়্যিদ মঞ্জু, ইফতেখার ঈসপ, ধ্বনিরাম বড়ুয়া, ইবনে আলতাফ, আকলিমা আঁখি, রুহুল কাদের বাবুল, নিলয় রফিক প্রমুখসহ অনেক কবি সাহিত্যিক রয়েছেন। কবি ও সাহিত্যিকদের মধ্যে গল্পকার অনুবাদক শহিদ সাবের ও গবেষক আবদুর রশিদ ছিদ্দিকি, কবি ডা. কবির আহমদ, অনুবাদক প্রাবন্ধিক মফিদুল আলম, গবেষক মালিক সোবহান, কবি মাসুদ শাফি প্রয়াত হয়েছেন।
কক্সবাজারের দৈনিক পত্রিকাগুলো এক সময় সাহিত্য পাতা করত। স্থানীয় কবি সাহিত্যিকদের লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হতো। কালক্রমে পত্রিকার সংখ্যা বাড়লেও সাহিত্য পাতার সংখ্যা একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। স্বাধীনতা পূর্বে ‘সাধনা’, ‘ওয়াদা’, ‘সারণী’, ‘দু’পাতা’, ‘কলতান’, ‘আওয়াজ’ ইত্যাদি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হয়। স্বাধীনতার পর ‘এক ঝাঁক পায়রা’, ‘প্রত্যাশা অন্যরকম’, ‘নিগড়’, ‘নিুচাপ’, ‘উদ্ভাস’, ‘শব্দ তরঙ্গ’, ‘সূচনা’, ‘তারপর’, ‘নযান’, ‘উর্মিলা’, ‘প্রবাল’, ‘কনক’, ‘আবহ’, ‘বেলাভূমি’, ‘সংকেত’, নামে কক্সবাজার থেকে বেশ কয়েকটি ম্যাগাজিনও অনিয়মিত প্রকাশিত হয় এবং এখনো হচ্ছে। ইব্রাহিম মাহমুদ সম্পাদিত ‘কক্সবাজার বিচিত্রা’ ও ‘ঋতবর্ণ’, মনজুর কাদের সম্পাদিত ‘কঙ্কাল’, খালেদ শহীদ সম্পাদিত ‘চিন্তন’, অমিত চৌধুরী সম্পাদিত ‘মূল্যায়ন’, আলী প্রয়াস সম্পাদিত ‘তৃতীয় চোখ’। কক্সবাজার সাহিত্য একাডেমির মুখপত্র ‘সমুদ্র সংলাপ’, জাহেদ সরওয়ার সম্পাদিত ‘দ্বীপালোক’, হাসান মুরাদ ছিদ্দিকি সম্পাদিত ‘মহাকাল’, কামাল হোসেন সম্পাদিত ‘ছড়ুয়া’, মাহাবুব রোকন সম্পাদিত ‘ঝিনুক’, একরাম আজাদ সম্পাদিত ‘খতিয়ান’, মিজান মনির সম্পাদিত ‘নাগরিক চোখ’ অন্যতম। ‘ঋতবর্ণ’ পরে প্রকাশনায় নাম লিখিয়ে প্রায় পঞ্চাশটির মতো গ্রন্থ প্রকাশ করে। কক্সবাজারে কালক্রমে বেশ কিছু সাহিত্য সংগঠন গড়ে ওঠে কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে ভেঙে যায়! সাহিত্য নিয়ে দীর্ঘদিন সংগঠন করা আসলেই কঠিন। এসব সংগঠন অনেক উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে গড়ে ওঠে বটে কিন্তু ভাগ্যক্রমে ওইসব সংগঠনের কার্যক্রম নিয়মিত করার যে তাগিদ সেটা সবার ভেতর থাকে না। ‘কক্সবাজার রাইটার্স ক্লাব’, ‘কক্সবাজার সাহিত্য একাডেমি’, ‘মহেশখালী সাহিত্যসভা’, ‘চকরিয়ায় মহাকাল’, ‘দীপাঞ্চল সংস্কৃতি অঙ্গন’ ইত্যাদি। এসব সংগঠনের মধ্যে ‘কক্সাবাজার সাহিত্য একাডেমি’ দীর্ঘদিন নিয়মিত আড্ডা করে আসছে। সাহিত্য সংস্কৃতিতে অবদানের জন্য গুণিজনদের সম্মাননাও দিয়ে যাচ্ছে। কক্সবাজার সাহিত্য একাডেমির প্রকাশনা জাতীয় মানের, ‘মহাকাল’লেরও নিয়মিত পাক্ষিক আড্ডা বসে। ‘দীপাঞ্চল সংস্কৃতি অঙ্গন’ আড্ডা, সাহিত্য সন্মাননাসহ নানা কর্মযজ্ঞ করে আসছে। ‘দীপাঞ্চল সংস্কৃতি অঙ্গন’-এর কার্যালয় মহেশখালী দ্বীপে। কিছুদিন আগে ‘দীপাঞ্চল সংস্কৃতি অঙ্গন’-এর উদ্যোগে আদি ভাষার কবিখ্যাত হাফিজ রশিদ খান’র ৬০তম জন্মদিবস পালন করেছে বাংলাদেশ বিখ্যাত দ্বীপ ‘সোনাদিয়ায়’। দীপাঞ্চল সংস্কৃতি অঙ্গন’-এর কর্মযজ্ঞের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য কাজ করে যাচ্ছে এ সংগঠনের সম্ভাবনাময়ী তরুণ সাহিত্যিকরা। এমনকি দেশ বরেণ্য কবি, সাহিত্যিকদের মৈনাক সম্মাননা দিয়ে আসছে। ‘মহেশখালী সাহিত্যসভা’ এক সময় নিয়মিত সাপ্তাহিক আড্ডার আয়োজন করত মহেশখালী পাবলিক লাইব্রেরিতে। নিয়মিত বসত কিন্তু বর্তমানে অনিয়মিত।
সমুদ্র ও সমুদ্রপারের জীবন একানকার কবি সাহিত্যিকদের ভাবনায় ধরা দেয় তাই তো এখানকার বইয়ের নাম হয় ‘ঝাউদরিয়ার ডানা’, ‘নীল সমুদ্রের ঝড়’, ‘সমুদ্র ডানা’, ‘নুন দরিয়ার ঘ্রাণ’, ‘রূপচান্দার কঙ্কাল’, ‘আমার সমুদ্রশিরা’, ‘কবিমন হাঁটে দরিয়া নগর’, ‘ঝাউ পাতার ভায়োলিন’ ইত্যাদি। কালের বহমান স্রোতে দিন দিন সমৃদ্ধ হচ্ছে এ সমুদ্র জনপদের শিল্প-সংস্কৃতি। এখানকার তরুণরা ঝুঁকছে সাহিত্য সংস্কৃতিচর্চার অমিয় সুধার দিকে তাই আশা করি কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, লেখকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় জাতীয় পর্যায়ে আগামীতে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে আমাদের কক্সবাজার। এ প্রত্যশা নিয়ে হোক পথচলা...।