কিশোরগঞ্জ জেলার সাহিত্য নিয়ে বিশেষ আয়োজন
কিশোরগঞ্জের সাহিত্য

এ টি এম নিজাম
প্রকাশ: ০৬ আগস্ট ২০২১, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

নদ-নদী আর সাগরের মতো বিস্তীর্ণ হাওর বিধৌত উর্বর জনপদ কিশোরগঞ্জ। এখানকার মাটি আর জলে লুকিয়ে আছে সাহিত্যের অফুরন্ত ভাণ্ডার। এসব নদ-নদীর মধ্যে দ্বীজ বংশী দাস ও তার কন্যা বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রবতীর নিবাস ছিল ফুলেশ্বরী নদীর তীরে। কালের রুদ্ররোষে ফুলেশ্বরী নদী সমতল ভূমিতে বিলীন হয়ে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। ষষ্ঠ শতকে বত্রিশ এলাকার বাসিন্দা কৃষ্ণদাস প্রামাণিকের ছেলে নন্দকিশোর ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে একটি গঞ্জ প্রতিষ্ঠা করেন। এ গঞ্জ থেকেই কালক্রমে নন্দ কিশোরের গঞ্জ বা ‘কিশোরগঞ্জ’-নামের উৎপত্তি।
অতীতের ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারায় সাহিত্য-সংস্কৃতিকে সমুন্নত রেখে এ নিরন্তন প্রক্রিয়ায় কিছু মানুষ নিবেদিত প্রাণ হয়ে সমাজ-সংস্কৃতি, শিল্প-সাহিত্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রেখে যাচ্ছেন। সমাজ ও জীবনেই সাহিত্য-সংস্কৃতির দর্শন নিহিত। মসনদে আলা বীর ঈশা খাঁ’র দৌহিত্র ফিরোজ খাঁ-বীরাঙ্গনা সখিনা ও মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর প্রেম-উপাখ্যান। লোক সংগ্রাহক চন্দ্র কুমার দে’র সহযোগিতায় ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন চন্দ্রবতীর চন্দ্র গীতিকা ও অসমাপ্ত রামায়ণ সংগ্রহ করেন। আর এ সবই ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ ও ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা’য় ঠাঁই পায়। চন্দ্রবতীর রামায়ণের পাণ্ডুলিপি কলকাতা মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। এ মাটির সন্তান কবি দ্বীজ বংশী দাস, ছড়াকার সুকুমার রায়, লেখক এবং সন্দেশ পত্রিকার সম্পাদক উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী, সত্যজিৎ রায়, বিপ্লবী মহারাজা ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির শিক্ষক নীরোদ শ্রী চৌধুরী, উপমহাদেশের ক্রিকেট অগ্রদূত সারদারঞ্জন রায়, শাহনামার বাংলা অনুবাদক কবি মনির উদ্দীন ইউসুফ, প্রখ্যাত পুঁথিকার মুনশী আজিম উদ্দিন হানাফী, রবীন্দ্র সংগীতের কিংবদন্তি দেবব্রত বিশ্বাস, ইতিহাসবিদ নীহার রঞ্জ রায়, কেদারনাথ মজুমদার, গল্পকার ফজলুল হক, চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রখ্যাত বিজ্ঞানী-শিক্ষাবিদ ও গবেষণাধর্মী লেখক ডক্টর এমও গণি, ১৯৬২ এশিয়ান গেমসে স্বর্ণজয়ী বাঙালি ফুটবল খেলোয়াড় চুনী গোস্বামী, কথাসাহিত্যিক রাহাত খান, অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক, রম্য লেখক অধ্যক্ষ নরেন্দ্রচন্দ্র ঘোষ, সাহিত্যিক জিয়া উদ্দীন আহমদ, মাহফুজ পারভেজ, কলামিস্ট বিমল সরকার, কবি আশুতোষ ভৌমিক, আবদুল হান্নান, প্রখ্যাত লোক সংগ্রাহক মাধব-মালঞ্চী কইন্যার কাহিনিকার মোহাম্মদ সাঈদুর, কবি আবিদ আজাদ, আবিদ আনোয়ার, ফারুক মাহমুদ, রিফাত চৌধুরী, কফিল আহমেদ, কাজল শাহনেওয়াজ, কামরুল আলম সিদ্দিকী, সব্যসাচী লেখক রাজীব সরকার, গল্পকার সাদিকুল নিয়োগী পন্নী, নৃত্যশিল্পী শামীম আরা নীপা, প্রখ্যাত গীতিকার ও সুরকার ওস্তাদ পরেশ ভট্টাচার্য্য, লোক সংগীতের কিংবদন্তি গীতিকার ওস্তাদ অমর চন্দ্র শীল, লোক সংগীতের জাদুকর অখিল ঠাকুর, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী বিপুল ভট্টাচার্য্য, চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন, সংগীতশিল্পী রিজিয়া পারভীন, পালাকার ইসলাম উদ্দিন, চিত্রশিল্পী আব্দুল কাইয়ুম, আমান উল্লাহ, আবদুস সালাম, নাট্যাভিনেতা সুধেন্দু বিশ্বাসসহ নাম জানা-না জানা অসংখ্য কীর্তিমানের শিল্পবৃক্ষের স্নিগ্ধ ছায়ায় সমৃদ্ধ কিশোরগঞ্জের সাহিত্য-সংস্কৃতি।
এখানকার সাহিত্য-সংস্কৃতি বিকাশ ও লেখক সৃষ্টির ক্ষেত্রে লিটল ম্যাগাজিন অসাধারণ অবদান রেখেছে। এ জেলা থেকে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত ছোট কাগজ ও সাহিত্য সঙ্কলনের মধ্যে-১৯৫২ সালে গুরুদয়াল কলেজের তৎকালীন ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক হাবিবুর রহমান সম্পাদিত ‘মাসিক প্রতিভা’, ১৯৬৭ সালে কবি আবিদ আজাদ সম্পাদিত ‘সংবর্ত’, ১৯৬৮ সালে আজিজুল হক এরশাদ সম্পাদিত ‘ইদানীং’, ১৯৬৯ সালে বিমলাংশু রায় বাবলু সম্পাদিত ‘রক্তজ্বালা’, ১৯৭২ সালে এখলাসউদ্দিন আহম্মদ সম্পাদিত ‘রক্তজ’, ১৯৭২ সালে রেজাউর রহমান সম্পাদিত ‘রক্তের স্বরলিপি’, ১৯৭২ সালে শফিকুল মবিন সম্পাদিত ‘লাল ফাল্গুন’, ১৯৭২ সালে আজহারুল ইসলাম আজাদ সম্পাদিত ‘ফাগুনের আগুন মেলায়’, ১৯৭৩ সালে জাকিরুল ইসলাম চৌধুরী সম্পাদিত ‘ফাগুনস্মৃতি’, ১৯৭৩ সালে শফিকুল মবিন সম্পাদিত ‘পলাশের পলাশী’, ১৯৭৪ সালে আশুতোষ ভৌমিক সম্পাদিত ‘বিস্ফোরণ’ ও ‘বিন্যাস’ (১৯৭৫), ১৯৭৫ সালে আবু বকর সিদ্দিক হিরো সম্পাদিত ‘সরণি’, ১৯৭৬ সালে জাহাঙ্গীর আলম জাহান সম্পাদিত ‘ফিনকি’, ১৯৭৬ সালে কে এম শহীদুল হক সম্পাদিত ‘জাগৃতি’, ১৯৭৬ সালে শাহ্ আজিজুল হক সম্পাদিত ‘নিনাদ’ ও ‘ঝড়ের খেয়া’, ১৯৭৬ সালে সৈয়দ আজিজুল বারী ও সুবীর বসাকের যৌথ সম্পাদনায় ‘উত্তরণ’, স্বাধীনতা উত্তর ৭০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে প্রকাশ পায় ‘বাতায়ন’, ‘চাঁদের হাট’ নামে মো. মিজানুর রহমানের সম্পাদনায় সাহিত্যপত্র প্রকাশ পায়, ১৯৭৭ সালে শাহ্ মুহাম্মাদ নাজমুল আলমের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘কিশোরগঞ্জ প্রদর্শনী স্মরণিকা-৭৭’, ১৯৭৯ সালে শফিকুল মবিনের সম্পাদনায় বের হয় ‘ছাড়পত্র’, ১৯৭৯ সালে মু. আ. লতিফ সম্পাদিত ‘শতদল’, ১৯৮০ সালে ছড়াকার মো. নবী হোসেনের সম্পাদনায় বের হয় ‘শিস্ দিয়ে যায় অহর্নিশ’, ১৯৮০ সালে একেএম মাহফুজুল হক সম্পাদিত ‘প্রতিধ্বনি’, ১৯৮১ সালে কফিল আহমেদ সম্পাদিত ‘শব্দমিছিল’, জেলা পাবলিক লাইব্রেরি থেকে ১৯৮৬ সালের জুলাই মাসে অধ্যাপক জিয়াউদ্দিন আহমদের সম্পাদনায় ‘সৃষ্টি’ নামে সাহিত্য সাময়িকী, ১৯৮৫ সালে রিফাত চৌধুরী সম্পাদিত ‘ছাঁটকাগজের মলাট’ ২০০৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে জাহাঙ্গীর আলম জাহান-এর সম্পাদনায় ‘দৃশ্যপট-৭১’ উল্লেখযোগ্য। স্বাধীনতা পূর্ব ও উত্তরকালে কিশোরগঞ্জে সাহিত্য-সংস্কৃতির আড্ডা-আসরে সরব থাকতেন কবি-সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক-কর্মীরা। কিশোরগঞ্জ জেলা পাবলিক লাইব্রেরি, কিশোরগঞ্জ প্রেস ক্লাব ও জেলা শিল্পকলা একাডেমি (সাবেক এডওয়ার্ড হল) কে ঘিরে এসব জমজমাট আড্ডা-আসর বসত। প্রবীণ সাংবাদিক-প্রাবন্ধিক ও গবেষক মু আ লতিফ জানান, ষাটের দশকে গুরুদয়াল কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যক্ষ নরেন্দ্রচন্দ্র ঘোষ ‘সাহিত্য সংসদ’ এবং একই কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক জিয়া উদ্দীন ‘সাহিত্য মজলিশ’ নামে দু’টি সাহিত্য সংসদে আড্ডা বসত। তাদের নিজ নিজ বাসায় এসব সাহিত্যের আসর বসলেও সাহিত্যানুরাগী বিভিন্ন বয়সিদের যাতায়াত ছিল। একই সময় কিশোরগঞ্জ শিল্পকলা একাডেমিতে নিয়মিত বসত সংগীত, নৃত্য ও নাট্যশিল্পী সংগঠকদের নিয়মিত আড্ডা-আসর, চর্চা-প্রশিক্ষণ। নিয়মিত চলত সংগীত, নৃত্য ও নাট্যানুষ্ঠানসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানমালা। জেলার বাইরেও করিমগঞ্জ উপজেলা পাঠাগার-শিল্পকলা একাডেমি এবং বাজিতপুরের উপজেলা সাধারণ গ্রন্থাগারকে ঘিরে সাহিত্য-সংস্কৃতির এমন আড্ডা বসে। ছড়াকার ও গবেষক জাহাঙ্গীর আলম জাহান জানান, কিশোরগঞ্জ সাহিত্য গোষ্ঠী, অনুশীলন সাহিত্য গোষ্ঠী ও কিশোরগঞ্জ ছড়াকার সংসদ কিছুদিন আগ পর্যন্ত এ দুটি সংগঠন সক্রিয় ছিল। এর মধ্যে ছড়াকার সংসদের আড্ডার আসরের নাম ছিল ‘চান্নি পশর ছড়ার আসর’। জোছনা রাতে শহরের খোলা জায়গায় এসব আসর বসত। তবে এখনো বেশ ক’টি সংগঠনের উদ্যোগে প্রতি শুক্রবার এখানে বসে সাহিত্যলোচনা ও আড্ডার আসর। এসব সংগঠনের মধ্যে জেগে ওঠো নরসুন্দা, সন্দীপন সাহিত্য সংসদ নাম উল্লেখযোগ্য। লেখালেখিতে এ প্রজন্মের নবীন-প্রবীণ ও তরুণদের মধ্যে নাসিরুদ্দীন ফারুকী, প্রিন্স রফিক খাঁন, মু আ লতিফ, শাহ আজিজুল হক, সুবীর বসাক, জাহাঙ্গীর আলম জাহান, নবী হোসেন, ফেদৌস চৌধুরী, বাধন রায়, বাবুল রেজা, আবুল এহসান অপু, অধ্যাপক আবুল কাশেম সালতু, মেরাজ রহিম, আমিনুল ইসলাম সেলিম, আলী আকবর, বিজন কান্তিক বণিক, র ম পাশা, হারুন আল রশীদ, জীবন তাপশ তন্ময়, সাদেকুর রহমান রতন, জহিরুল আলম জাহাঙ্গীর, সিদ্দীক বকর, গোলাপ আমিন, মোহাম্মদ রফিক, অনিন্দ্য অসিফ, রাতুল হরিৎ, সাদরুলউলা, শামীম সিদ্দিকী, ফয়সাল আহমেদ, তন্ময় আলমগীর, জমাতুল ইসলাম পরাগ, শওকত কবীর কাজল, ওয়াসীম ফিরোজ, রাবিক অমি, লিয়ন আজাদ, মহফুজ সজল, সঈদ উজ্জ্বল, মো. শাহজাহান, ফরিদুজ্জামান পলাশ, জিসান মাহবুব, সুমন দ্বীপ প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
কিশোরগঞ্জের সংস্কৃতি বিকাশে বিভিন্ন নাট্যগোষ্ঠী ও সংগঠনের উজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। ষাটের দশকে কিশোরগঞ্জের নাট্য আন্দোলনে কল্লোল সমিতির নাম স্মরণীয়। স্বাধীনতা উত্তরকালে একে একে কিশোরগঞ্জ শহরে বৃহস্পতি নাট্যগোষ্ঠী, একতা নাট্য সংস্থা, সৌখিন শিল্পাঙ্গন, আমরা ক’জনা নাট্যগোষ্ঠী, পল্লী থিয়েটার, কিশোরগঞ্জ নাট্য পরিষদ, টিএন্ডটি নাট্য পরিষদ, কমিউনিটি থিয়েটার, কিশোরগঞ্জ নাট্য সাংস্কৃতিক সংস্থা, হিংকু নাট্যগোষ্ঠী, সুদীপ্ত থিয়েটার এবং জেলার নিকলীতে নিকলী থিয়েটার, নিকলী নাট্য মঞ্চ, তিমিরদিশারী নাট্যগোষ্ঠী, কটিয়াদীতে নাট্য সংঘ, শতদল নাট্যগোষ্ঠী, বালার্ক নাট্যগোষ্ঠী ও ভৈরবে সমকাল নাট্যগোষ্ঠী গড়ে ওঠে। এসব সংগঠনের কর্মকাণ্ডে মুখরিত হয়ে ওঠে এ জনপদ।
সংরক্ষণ ব্যবস্থার অভাবসহ অযত্ন-অবহেলায় ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সাহিত্য-সংস্কৃতির লীলা ভূমির ঐতিহাসিক নিদর্শন স্থাপনা ও পুরাকীর্তিগুলো আজ কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে বসেছে। একই সঙ্গে বেড়েছে সাহিত্য-সংস্কৃতিমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত সংগঠন ও সংগঠকদের পৃষ্ঠপোষকতা। দিনে দিনে ক্ষয়ে যাওয়া এসব অমর কীর্তির সুবর্ণ স্বাক্ষরগুলো রক্ষায় সরকার ও প্রশাসন এগিয়ে আসার আহ্বান এলাকাবাসীর।
কিশোরগঞ্জের প্রবাদ প্রবচন
১. যদি থাকে বন্ধুর মন, গাঙ পার অইতে কতক্ষণ?
২. না ফাইয়া ফাইছে ধন, বাপে-ফুতে কীর্তন।
৩. ন্যাড়ার বিবি খাডে যায়, ফিইরা ফিইরা খাডের দিগে ছায়।
৪. ইসালত যায়না ধুইলে, খাসালত যায় না মইলে।
৫. যার আতে খাইছি নাম-সে বড় রান্ধুনী, যারে কোনদিন দেখছি নাম-সে বড় সুন্দরী।
৬. ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও বারা ভানে।
৭. নদীর জল ঘোলাও বালা, জাতের মেয়ে কালাও বালা।
৮. সহালেই বুঝা যায় দিনডা কেমন যাইবো, মুখ দেইখ্যাই চেনা না যায়, ছেরাডা কেমন অইবো।
৯. আভাগ্যায়া হাঁতার দিছে, গাঙও চিৎ অইছে।
১০. লগরডগর হাইয়ের থাইক্যা বিধবাই বালা।