Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

নীল ফড়িং সমাজের বহুরূপী চিত্র

Icon

সকামাল হোসেন

প্রকাশ: ১৭ জুন ২০২১, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে প্রথমে মনে হবে ভাটি অঞ্চল থেকে জোয়ারে ভেসে আসছে গল্পটি। তারপর, একটা চায়ের দোকান, কিছুটা নীরবতার কোলাহল, চাঁদের ম্লান আলোর বয়সি অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, বাস্তবতা মোড়ানো চা-দোকানদারের জীবন, নীল ফ্রগ পরা রহস্যের আলো-আঁধারের কিশোরীই গল্পের বর্তমান অথবা ভবিষ্যৎ। অপরিচিত এবং অদৃশ্য আতঙ্কের সামনে কয়েকটি আগন্তুক গাছ। এ নিঃশব্দতায় উপন্যাস তার নিজের গল্প বলতে বলতে আমাদের নিয়ে যাবে এক জাদুবাস্তবতার পৃথিবীতে।

মতি মিয়া আর তার চায়ের দোকানে আসা অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা এখলাছ সাহেব, লাল রঙের ফ্রক পরা নাফিলা; এ তিনটি চরিত্র জমাট বাঁধে শীতে কাঁপা অন্ধকারে। ঠিক এমন সময়ে নিস্তব্ধতা ভাঙা পাখির ডাক যেন নিয়ে আসে আরও ভয়ানক প্রাগৈতিহাসিক নিঃসঙ্গতা। এ নিস্তব্ধতাময় আবহেই উপন্যাসের যাত্র। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত আর নিুবিত্তের জীবনের নানা টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে উপন্যাসিক আমাদের অনেক কঠিন বাস্তবতার দিকে নিয়ে যেতে থাকে। প্রথমে একটা ভৌতিকতার মধ্য দিয়ে উপন্যাসের কাহিনি এগোতে থাকে। একটা ঘোর। একুশ শতকের দ্বিতীয় বিশ্বের প্রান্তিক গ্রাম তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ঐশ্বর্য দেখিয়ে দেখিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সবুজ-শ্যামলে ভরা এ প্রাণখোলা গ্রামের কুটিল এবং জটিল সমীকরণগুলোও উঠে আসছে উপন্যাসের ছোট ছোট সাবপ্লটে। এসেছে গ্রামের রাজনীতি, ধর্ম, মানুষ-নির্মিত সামাজিক ব্যাকরণ, স্থানীয় প্রভাব-প্রতিপত্তির মধ্যে থাকা নির্মমতা। উপন্যাসের কেন্দ্র যদিও একটি ত্রিভুজ প্রেম। কিন্তু, এই প্রেমের কাহিনিকে অবলম্বন করে লেখক মূলত তুলে ধরেছেন এমন এক বাস্তবতা- যেখানে ভয় আছে, সন্দেহ আছে; রাজনীতি যেখানে বিষাক্ত সাপ হয়ে নিজেকে ছড়িয়ে রেখেছে।

অতিমানবিক নাফিলা চরিত্রটি অপরাধ আর অনুতাপের প্রতীক হয়ে ঘুরে বেরিয়েছে উপন্যাসের বিশেষ চরিত্রের দায়িত্বটি নিয়ে।

এখলাছ সাহেবের ছোট্ট সুখের সংসার। স্ত্রী-কন্যার ছোট্ট সংসারে মেয়ে নাফিলা ফুলের সৌরভ আর জোছনার হাসি বিলিয় যাচ্ছে। মাঝে মধ্যে শ্যালিকা ‘জেবুন্নেসা’র উপস্থিতিও এখলাছ সাহেবের মনকে সরস করে তোলে। কিন্তু সংসার জীবনের এ স্বাভাবিকতার মধ্যেও এক রহস্যজনক ভৌতিকতা নিয়ে আসে একলাছ সাহেবের ‘পাম্প শ্যু’ হারিয়ে যাওয়াটা। এ আতঙ্ক কেন! কেন মানুষের ভেতরে মানুষের ভূতের পালায়ন?

মানুষ হয়তো জানেই না, মানুষের অন্যায় অনুতাপ, ভয়; কোনো না কোনোভাবে তাকে তাড়া করে বেরাবেই। লেখকের অবচেতনেই তার ভেতরের মানবিক গুণাবলী লেখককে দিয়ে এই ছোট অথচ খুবই প্রয়োজনীয় পাঞ্চলাইনগুলো লিখিয়ে নিয়েছে।

মসজিদের মতো পবিত্র জায়গা দখলে নিয়েছে ‘মকবুল’দের মতো লোকরা। এ চরিত্রের মাধ্যমে লেখক প্রার্থনালয়ের চিত্রও তুলে ধরেছেন।

উপন্যাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র বেলাল সাহেব। তিনি নাফিলার ইংরেজির টিচার। শিক্ষক হলেও তার মধ্যে একজন শিক্ষকের নৈতিক যে গুণাবলী থাকা দরকার তার যথেষ্ট অভাব লেখক যৌক্তিকভাবেই দেখাতে পেরেছেন। শিক্ষক হয়ে ছাত্রীর টেবিলের দামি/সুন্দর কলম চুরির লোভ সামলাতে না পারা শিক্ষকই যে এই উপন্যাসের ভিলেন হবেন তা প্রথমেই বুঝা গেল। এই চুরিই তার চরিত্রের মাপকাঠি হতে পারে। হয়েছেও তাই। সে ছাত্রীকে শিক্ষকের চোখে না দেখে দেখেছেন (ভালোবাসার লেবাসে) কামনারই চোখে। এই শিক্ষকের কূটচালে উপন্যাসের নায়ক-নায়িকার জীবন নরকে পরিণত হয়। উপন্যাসের এই শিক্ষক চিরত্রই দেখিয়ে দেয় যে, শিক্ষক যদি শিক্ষকের গুণাবলী সম্বলিত না হয় তাহলে জাতির জীবনে অনেক ক্ষতি নেমে আসতে পারে।

ভোগের কামনা, ক্ষমতা আর অবৈধ টাকার প্রভাবে মত্ত চেয়ারম্যানের বখাটে ছেলে মাখন। মাখন তার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেধাবী বন্ধু নাবিল আর তার প্রেমিকার জীবন দুর্বিষহ করে তোলে। অন্যায়-অনিয়ম আর প্রকৃত শিক্ষার অভাবে সমাজ কতটা ভেঙে পড়তে পারে তা এই উপন্যাসের প্রত্যেকটি চরিত্রের মাধ্যমে লেখক সূক্ষ্মভাবে তুলে ধরেছেন।

পুরো উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে পাঠক এক ভয়াবহ জর্নির শিকার ঠিকই হবেন। তবে, সবকিছুর পরে সত্যই যে টিকে যায় তা দেখে যে কোনো পাঠকের হতাশা কেটে যেতে পারে। অনেক প্রতিকূলতার পরও উপন্যাসের নায়ক নাবিল ঠিকই উচ্চশিক্ষা গ্রহণে সক্ষম হয়। আর প্রকৃত প্রেমিকা যদি তার প্রেমের সত্যকে হৃদয়ে ধারণ করতে পারে সেও যে শত প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে ভালোবাসা পায়; তারও প্রমাণ লেখক উপন্যাসে দিয়েছেন।

উপন্যাসটি এমন একটি জার্নি যেখানে গল্প আছে, সমাজের কোথায় কোথায় কী কীভাবে সমস্যা রয়েছে চরিত্রের মধ্যে তা দেখানো আছে। আছে এসব থেকে উত্তরণের পথ এবং দৃঢ সংকল্পের দৃষ্টান্তও।

আব্দুল্লাহ শুভ্রর ‘নীল ফড়িং’ উপন্যাস পড়ে মনে হলো একটি সার্থক উপন্যাস সহজভাবে লেখা হয় ঠিকই; কিন্তু তা তরল হয় না, হয় প্রকৃত জীবনদর্শনে সমৃদ্ধ।

 

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম