ফিকে হয়ে আসছে দিনের আলো। গাছগাছালির ছায়া ধীরে ধীরে গাঢ় হচ্ছে। আমগাছের ডালপালা থেকে কখন টুপ করে উঠানে লাফ দিয়ে নামবে, সন্ধ্যেটা যেন সেই অপেক্ষায় আছে এখন। বাড়ির পেছনের ডোবা থেকে কয়েকটি পাতিহঁভস পুচ্ছ দোলাতে দোলাতে উঠানে উঠে এসেছিল, অপরিচিত মানুষগুলোকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল তারা, গলা উঁচু করে প্যাক প্যাক করে জোরে জোরে ডাকতে লাগল। হয়তো মনিবকে খুঁজছে। তাড়া খেয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে ছিল আহাম্মদের কুকুরটা, এখন ফিরে এসে উঠানের একপ্রান্তে শুয়ে মাটিতে থুতনি রেখে ভীরু, অপ্রসন্ন চোখে তাকিয়ে লোকগুলোর কাণ্ড দেখছে আর হয়তো মনে মনে ভাবছে কখন এ আপদ বিদায় হবে।
টোডির বোতলটা মুখের ওপর কাত করে গলায় খানিকটা পানীয় ঢালল মাও, তারপর দূরে আকাশের দিকে তাকাল যেখানে কিছুক্ষণ আগেও কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উড়ছিল রোহিঙ্গাদের গ্রাম থেকে। করিম কাজীদের বাড়িঘর এতক্ষণে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে বোধ হয়। দূর থেকে মহিলা ও শিশুদের ভয়ার্ত চিৎকার আর কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছিল, এখন সব চুপচাপ, নিস্তব্ধ। চারপাশে শেষ বিকালের ম্লান আলোয় পৃথিবীটা কেমন যেন শান্ত থমথমে ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
মাও মুখ ঘুরিয়ে উঠানে দৃষ্টি ফেলে। একপাশে নারকেলগাছটার নিচে মাটিতে চিত হয়ে পড়ে আছে আহাম্মদ। রাইফেলের কুঁদো দিয়ে ওকে পিটিয়ে মেরেছে লেফটেন্যান্ট থোয়াই। আহাম্মদের মুখ আকাশের দিকে, চোখ দুটো খোলা, নিষ্পলক তাকিয়ে আছে শূন্যে। থেঁতলানো কপাল রক্তে মাখামাখি হয়ে আছে। পাশেই চাটাইয়ে শুয়ে অনবরত হাত পা ছুড়ছে তার শিশুকন্যা। বয়স মাস চারেক হবে। মাওয়ের মনে আছে বাচ্চাটা জন্মানোর পর চেয়ারম্যানের বাড়িতে মিষ্টি নিয়ে গিয়েছিল আহাম্মদ। একটা বাচ্চার জন্য বিয়ের পর বেশ ক’টি বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে আহাম্মদ দম্পতিকে। মাও অন্যমনস্কভাবে শিশুটির দিকে তাকিয়ে থাকে। নাদুস নুদুস, ফর্সা চেহারা, গোটা গোটা হাত পা। যেন জীবন্ত পুতুল। হাতে দুই গাছা রুলি। তাতে ছোট ছোট ঘুঙুর বাঁধা। হাত নাড়ছে আর ঝুন ঝুন করে বাজছে ঘুঙুর। বাচ্চাটি এতক্ষণ কাঁদছিল, এখন শান্ত। বিচিত্র সব শব্দ করছে মুখ দিয়ে। কশ বেয়ে লালা ঝরছে। মাও একমনে বাচ্চাটির খেলা দেখছিল, লেফটেন্যান্ট থোয়াইয়ের উঁচু গলা শুনে মুখ ফেরাল। উসমানের বাড়ি কতদূর? মাও একটু ভাবল তারপর দূরে আঙুল উঁচিয়ে বলল, ওই খালটা পেরোলেই উসমানের বাড়ি। শুনেছি উসমানরা সবাই বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে গেছে। বোধ হয় বর্ডারের দিকে গেছে। পালিয়েছে? কথাটা শুনে যেন বেশ হতাশ হলো থোয়াই, বিরস মুখে বলল, ভেবেছিলাম ওদের হাত পা বেঁধে গুষ্ঠিসুদ্ধ ঘরের ভেতর পুড়িয়ে মারব। সেটা হলো না। কুতকুতে চোখে মাওয়ের দিকে তাকাল সে। লোকটার ভাবলেসহীন মুখ দেখে বোঝা যায় না কিছুক্ষণ আগেই সে একটা লোককে ঠান্ডা মাথায় খুন করেছে। মাও শুনেছে এরা ৯৯ পদাতিক ডিভিশনের সৈনিক। ভয়ংকর খুনে স্বভাবের। কাচিনে বিদ্রোহীদের সঙ্গে অনেক দিন ধরে যুদ্ধ করেছে। মানুষ মেরে মেরে হাত পাকিয়েছে। যেন মানুষ মারা-ই ওদের কাজ। ঘরের ভেতর থেকে মেয়েলি আর্তস্বর আর লেফটেন্যান্ট থাং-এর ভারী গলার খিস্তি শোনা যাচ্ছে। খানিকটা আগে আহাম্মদের অল্পবয়েস বউটাকে টেনে হিঁচড়ে ঘরে ঢুকেছে সে। ঘরের ভেতর জাপটাজাপটির শব্দে কান পেতে টোডির বোতল মুখে তুলল মাও। এমন সময় আচমকা চিৎকার করে কেঁদে উঠল শিশুটি। অস্থীরভাবে হাত পা ছুড়তে লাগল। মাওকে উঠতে হলো, বাচ্চাটির পাশে গিয়ে উবু হয়ে তাকাল সে। একটা মস্ত কালো পিঁপড়া ওর কনুইতে কামড়ে ঝুলে রয়েছে। মাও আঙুল দিয়ে পিঁপড়াটা ছাড়াল। কান্না থামছে না। একটু ইতস্তত করল মাও, তারপর বাচ্চাটির গালে আলতোভাবে হাত বুলিয়ে মুখ দিয়ে চুক চুক শব্দ করল। আদুরে স্পর্শ পেয়ে বড় বড় চোখ মেলে তার দিকে তাকাল শিশুটি। চোখে জল টল টল করছে। মুখ দিয়ে অস্পষ্ট ভাষায় কি সব বলার চেষ্টা করছে যেন। কিছুটা নেশার ঘোরে থাকলেও মাও অনুভব করল শিশুটির জন্য একটা উদ্বেগ তার মনের ভেতর ফেনিয়ে উঠছে। সে ফিরে এসে বেঞ্চটায় বসল। শিশুটির কান্না থামছে না। উফ্, রোহিঙ্গার বাচ্চা বড় বিরক্ত করছে দেখছি। ওর মুখ বন্ধ করে দেব না কি? দারুণ বিরক্তভাব নিয়ে উসখুস করে উঠল লেফটেন্যান্ট থোয়াই, পাশ থেকে রাইফেল তুলে শিশুটির দিকে তাক করল। থুতনি কুঁদোয় চেপে একটা চোখ ছোট করে ট্রিগারে আঙুল রাখল সে। ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠল মাও। নিষ্পাপ দুধের শিশু। বোধ হয় ক্ষিধা পেয়েছে। একটা হাত মুখে ঢুকিয়ে শব্দ করে আঙুল চুষছে। ট্রিগার টানল থোয়াই। তিক্ষè শব্দ করে একটা গুলি শিশুটির মাথার কাছে চাটাই ফুটো করে, ছিটকে ওপাশে ডোবার দিকে ছুটে গেল। গুলির শব্দে হাঁসগুলো প্যাক প্যাক করে ডাকতে ডাকতে আবার দ্রুত নেমে গেল ডোবার দিকে। কি ভেবে থোয়াই রাইফেলটা কাঁধ থেকে নামাল। নির্বিকার মুখে মাওয়ের দিকে তাকাল সে, কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, থাক গুলি খরচ করে দরকার নেই। এটা এমনিতেই মারা যাবে। সে সময় ঘর থেকে বের হয়ে এলো লেফটেন্যান্ট থাং। প্যান্টের বোতাম লাগিয়ে, জিপারটা টেনে ওপরে তুলতে তুলতে বলল, খাটাস্ মেয়ে মানুষ। ক’দিন গোসল করে না কে জানে। বিশ্রী, নোংরা! চোখ মুখ কুঁচকে দারুণ ঘৃণার ভাব দেখাল লেফটেন্যান্ট থাং। নিচু হয়ে পরনের প্যান্টটা পরখ করল সে তারপর আশ্বস্ত হয়ে মাওয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ছুরিটা বেশি গাঁইগুঁই করছিল, চড় খেয়ে জ্ঞান হারিয়েছে। শিশুটি আঙুল চুষছে চুক চুক শব্দ করে। সেদিকে চোখ পড়লে থাং বলল, ওটাকে আবার রেখে দিলে কেন? শেষ করে দাও। থাক ওটা শেয়ালের জন্য। আজ রাতে শেয়ালগুলো একটু ভালো খাবে। বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল লেফটেন্যান্ট থোয়াই তারপর পকেট থেকে ম্যাচ বের করে ক’টা কাঠি জ্বালল, জলন্ত কাঠিগুলো একে একে ছুড়ে দিল ঘরটার দিকে। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল শুকনো খড়ের বেড়া, পাতা-ছাওয়া পুরু চাল।
আর্মির কনভয়টা তুলাতুলির সীমানা পার হলে কি ভেবে পায়ে পায়ে আহাম্মদের বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগল মাও। উঠানে ফেলে আসা একাকী শিশুটির চিন্তা মন থেকে তাড়াতে পারছে না সে। আহাম্মদের বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে চারপাশে চোখ বুলাল সে। বসতঘরটা চালসহ ধসে পড়েছে ভিটির ওপর। খড়ের ভেতর আগুন এখনো নিভে যায়নি। ভাটার আগুনের মতো ভেতরটা লাল হয়ে আছে। থেমে থেমে ফট্ ফট্ শব্দ করে আগুনের ফুলকি উড়ছে বাতাসে। উঠানে থই থই অন্ধকার। দুই হাতে চোখ রগড়ে তাকাল মাও। চাটাইয়ের ওপর বাচ্চাটা নেই। মাওয়ের তিক্ষ্ণ সন্দিহান দৃষ্টি অন্ধকার উঠানে গড়াতে গড়াতে বাড়ির পেছনে ডোবার দিকে নেমে গেল। বাচ্চাটির কোনো চিহ্ন নেই কোথাও। শুধু চাটাইয়ের পাশে আহাম্মদের নিথর দেহটা পড়ে আছে আর চারপাশে ভৌতিক শূন্যতার ভেতর পোড়া গন্ধমাখা বাতাস নারকেলের পাতায় আছড়ে পড়ছে। এমন সময় হঠাৎ উঠানের একপ্রান্ত থেকে বিকট স্বরে ঘেউ ঘেউ করে ডেকে উঠল আহাম্মদের কুকুর। চমকে উঠে সেদিকে তাকাল মাও। ভারি গলায় ধমক দিল কুকুরটাকে। জন্তুটা থামল না, তার দিকে দুই পা সামনে এগিয়ে হিংস চিৎকার করে গজরাতে লাগল। কপালে চিন্তার ভাঁজ নিয়ে আহাম্মদের বাড়ি থেকে বের হয়ে এলো মাও তারপর হন হন করে হেঁটে চলল চেয়ারম্যানের বাড়ির দিকে। কালিঝুলি মাখা অন্ধকার রাতটা প্রেতের মতো তার পেছন পেছন আসছে। আহাম্মদের বাড়ির উঠানে কুকুরটা থেমে থেমে চিৎকার করে চলেছে তখনো। দূর থেকে চিৎকারটা বিলাপের মতো শোনাচ্ছে।