গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্টস। যার নাম এখন ‘চারুকলা’। গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্টসের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে তা আজ তিয়াত্তর বছরে পদার্পণ করেছে। দীর্ঘদিনের পথপরিক্রমার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের আধুনিক চারুকলার উত্তরণের ইতিহাস। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের স্বপ্নের এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি বাঙালির রুচি নির্মাণে কতভাবে না পথ দেখিয়েছে। আজকের বাংলাদেশের আধুনিক চারুকলা চর্চার পুরো পথনির্মাণের যে স্বপ্ন দেখেছিলেন জয়নুল আবেদিন, তা মহিরুহসম হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি অত্যন্ত আনন্দিত এবং খুশি; সম্প্রতি চারুকলা অনুষদ ভবনের নাম হয়েছে : ‘শিল্পাচার্য জয়নুল ভবন’। যারা এ সুন্দর কাজটি বাস্তবায়নের সঙ্গে থেকেছেন তাদের প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
গত ২৯ ডিসেম্বর ছিল মহাত্মা জয়নুল আবেদিনের জন্মবার্ষিকী। তাকে স্মরণ করে প্রতি বছর চারুকলার ছাত্রদের বার্ষিক প্রদর্শনী হয়। সেরা কাজের জন্য ছাত্রছাত্রীদের পুরস্কার দেওয়া হয়। আজকে খুব ভাবতে ভালো লাগছে, আমি সেরা কাজের জন্য পুরস্কার পেয়েছি পাঁচবার। এ ছাড়া ওইদিন গুণিজনকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সারা দিন ও রাতের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ঘিরে আমাদের কৌতূহল আর আনন্দের সীমা থাকে না। তাই শিল্পাচার্যের জন্ম উৎসব আমাদের জন্য বিশাল এক আনন্দের দিন। এ বছর করোনার কারণে আনন্দ উৎসব হয়নি। কিন্তু শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনকে সম্মান জানিয়েছেন চারুকলা অনুষদের ডিন নিসার হোসেনসহ অন্যরা তা অত্যন্ত প্রশংসনীয় ও আনন্দের।
আশির দশকের শুরুতে আমি যখন ভর্তি হই এ প্রতিষ্ঠানে, তখন নাম ছিল : ‘চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়’। আমরা বলতাম ‘আর্ট কলেজ’। ১৯৮৩ সালে হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘চারুকলা ইনস্টিটিউট’। আরও পরে হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘চারুকলা অনুষদ’; যা বাঙালির পথনির্মাণ করেছে শিল্পের অন্বিষ্ট ভুবনে। জিজ্ঞাসা সঞ্চার করেছে বাঙালি ঐতিহ্য ও আধুনিকতাবোধে- যা আজ প্রতিটি বাঙালির জন্য অত্যন্ত আনন্দের ও গর্বের। চলুন এ পথপরিক্রমা পেছন ফিরে দেখা যাক একবার-
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের কিছু আগে-পরে জয়নুল আবেদিন, সফিউদ্দিন আহমেদ, আনোয়ারুল হক, শফিকুল আমিন, ড্রাফটসম্যান আলি আহসান এবং উঠকাট শিক্ষক হাবিবুর রহমান কলকাতা থেকে ঢাকা চলে আসেন। ঢাকা তখন মফস্বল শহর। সব এলোমেলো অবস্থা। তখন জয়নুল আবেদিনসহ অন্য শিল্পীদের স্বপ্ন ঢাকায় অনতিবিলম্বে আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠার। কিছুদিনের মধ্যে সে স্বপ্ন ভঙ্গ হলো। স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার ফলে জয়নুল আবেদিন সাহেব ঢাকার নর্মাল স্কুলে, সফিউদ্দিন আহমেদ সাহেব কলেজিয়েট স্কুলে, শফিকুল আমিন আরমানিটোলা স্কুলে এবং আনোয়ারুল হক চট্টগ্রাম নর্মাল স্কুলে শিল্পশিক্ষক হিসাবে যোগ দেন। ড. কুদরাত-এ-খুদা ছিলেন প্রথম ডিপিআই। ঢাকায় আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তার আগ্রহ ছিল আন্তরিক; কিন্তু প্রধান বাধা ছিল সরকারের সিদ্ধান্তহীনতা।
ঢাকায় আসার পর থেকেই জয়নুল আবেদিন থাকতেন পুরান ঢাকার আবদুল হাদী লেনে শ্বশুরালয়ে।ওই সময় প্রায় প্রত্যেক দিন বিকালে হাঁটতে হাঁটতে আসতেন তখনকার রেডিও পাকিস্তানের উল্টোদিকের একটি ছোট্ট রেস্টুরেন্ট, যেখানে রেডিওসংশ্লিষ্ট গায়ক, সুরকার, কবি-সাহিত্যিকরা আড্ডা দিতেন। তাদের মধ্যে ছিলেন কবি ফররুখ আহমদ, সিকান্দার আবু জাফর, সৈয়দ আলী আহসান, আব্বাসউদ্দীন, জসীমউদ্দীন প্রমুখ। কলকাতায় আবেদিন সাহেবের সঙ্গে তাদের সখ্য ছিল। ওখানকার আড্ডা শেষে আবেদিন সাহেব প্রায়ই রেললাইন পেরিয়ে ইউনিভার্সিটির মোড়ে একটা কালভার্টের ওপর বসার মতো বাঁধানো জায়গায় বসতেন। ওখানে আসতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল ছাত্র-শিক্ষকরা। ছাত্রদের মধ্যে মুনীর চৌধুরী, আতাউল করিম, সৈয়দ আনোয়ারুল করিম প্রমুখ। শিক্ষকদের মধ্যে সরদার ফজলুল করিম, অজিত কুমার গুহ, অমীয় বাবুও আসতেন, কিন্তু বসতেন না, কুশলবার্তাই বিনিময় হতো। তারা প্রায় সবাই মার্কসবাদে বিশ্বাসী। আবেদিন সাহেবের ’৪৩-এর দুর্ভিক্ষের ছবির সঙ্গে তারা সুপরিচিত ছিলেন। তাদের কয়েকজনের আগ্রহে ১৯৪৮-এর ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে ফজলুল হক হলের ডাইনিং রুমে আবেদিন সাহেবের দুর্ভিক্ষের ছবি দিয়ে ঢাকার প্রথম চিত্রপ্রদর্শনী হয় এক বিকালের জন্য।
সে সময় পূর্ববাংলা মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য ছিলেন হাবীবুল্লাহ বাহার। তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু সাহিত্য-শিল্প সম্বন্ধে তার উৎসাহ ছিল অপরিসীম। ঢাকার আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সরকারি উচ্চ মহলে একমাত্র উৎসাহী উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি। এ উৎসাহ আরও জোরদার করার ইচ্ছা থেকেই ১৯৪৮ সালের মে-জুন মাসে আবেদিন সাহেবকে প্রস্তাব দেন ১৪ আগস্ট অর্থাৎ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রথম বার্ষিকীতে একটি পোস্টার প্রদর্শনীর আয়োজন করার। এ প্রদর্শনী করার একটা উদ্দেশ্য ছিল, সরকারি উচ্চতর মহলে অন্তত ছবি আঁকার ব্যবহারিক প্রয়োজনীয়তার, সেই পোস্টার প্রদর্শনীর বিষয়বস্তু ছিল ভারত উপমহাদেশের মুসলিম বিজয় থেকে পাকিস্তান সৃষ্টির চিত্রায়িত সংক্ষিপ্ত ধারাবিবরণী। প্রায় একশ পোস্টার নিয়ে এ প্রদর্শনীর পরিকল্পনা। এ পরিকল্পনার ব্যয় হাবিবুল্লাহ বাহার সাহেবই জোগাড় করে দিয়েছিলেন। কিন্তু মাত্র দু’মাসে একশ পোস্টার আঁকা প্রায় অসাধ্য সাধনের মতো। তবু, আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠা, দেশে শিল্পচর্চার সূচনা এবং অবচেতনে এর প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে ভবিষ্যতের অসীম সম্ভাবনার আলোকে জয়নুল আবেদিন এ দুরূহ কাজে সাগ্রহে সম্মতি দিয়েছিলেন। ১৪ আগস্টের একদিন পূর্বেই তখনকার গভর্নর হাউজের বাগানে বিরাট প্যান্ডেলে গণ্যমান্য অতিথিদের সভা ও লাগোয়া আরও একটি প্যান্ডেলে প্রদর্শনীর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা হয়।
এ প্রদর্শনীর ফলে ঢাকাতে আর্ট স্কুল স্থাপনের সর্ব ধরনের বাধা দূর হয়ে যায়। একমাত্র বাধা ছিল স্থানাভাব, তা-ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আন্ডার সেক্রেটারি সলিমুল্লাহ ফাহমীর সহযোগিতায় সম্ভব হয়। পুরান ঢাকার রায় সাহেববাজার (কলতাবাজার)সংলগ্ন প্রায় বন্ধ ন্যাশনাল মেডিকেল স্কুলের হাসপাতাল অংশের পশ্চিম দিকের উপরতলা ও নিচতলার চারটি ঘর সে সময় ফাইলপত্রে বোঝাই ছিল। এর মধ্যে নিচতলার দুটি ঘর খালি করে আর্ট স্কুলের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হলো। ঢাকা-করাচির সরকারি মহলে এ প্রদর্শনীর এত ব্যাপক প্রচার হয়েছিল, সপ্তাহখানেকের মধ্যে তদানীন্তন পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিসের চেয়ারম্যানের (প্রফেসর শাহেদ সোহরাওয়ার্দী) ব্যক্তিগত আগ্রহে আবেদিন সাহেবকে করাচির কেন্দ্রীয় তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রধান শিল্পী হিসাবে শিগ্গির যোগদানের আহ্বান জানানো হয়।
আবেদিন সাহেব করাচি যাওয়া মনস্থ করেন। আনোয়ারুল হককে অফিসার ইনচার্জ হিসাবে আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠার দায়িত্বের ব্যবস্থা করে তিনি করাচি চলে যান। এ নতুন স্কুলের নামকরণ হয় government Institute of Arts. পদগুলো সৃষ্টি হয় প্রিন্সিপাল, লেকচারার, হেড ডিজাইনার এবং শিক্ষক হিসাবে। আনোয়ার সাহেব Lecturer in Fine Art, সফিউদ্দিন সাহেব Lecturer in graphic Art, এবং কামরুল হাসান যোগ দেন Head Designer হিসাবে। Draftsman আলি আহসান এবং হাবিবুর রহমান Teacher হিসাবে রয়ে যান। ১৯৪৮ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর প্রথম ছাত্র ভর্তি করার বিজ্ঞাপন নিউজ পেপারে প্রকাশিত হয়। আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠার প্রধান স্বাপ্নিক জয়নুল আবেদিন করাচি চলে গেলেন, সে ক্ষেত্রে বয়োজ্যেষ্ঠ শিল্পী আনোয়ারুল হক অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৫২ সালের জুন-জুলাই মাসে ‘গভর্নমেন্ট স্কুল অফ আর্টস’ সেগুনবাগিচায় একটি দোতলা ভবনে স্থানান্তরিত হয়। অধ্যক্ষ জয়নুল আবেদিন এ সময় সরকারি বৃত্তি নিয়ে ইংল্যান্ডে থাকায় আনোয়ারুল হক অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে ‘গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অফ আর্টস’ বর্তমান শাহবাগের নিজস্ব ভবনে স্থানান্তরিত হয়। এ সময়েও জয়নুল আবেদিন ‘রকফেলার’ বৃত্তি নিয়ে আমেরিকায় অবস্থানের কারণে আনোয়ারুল হক অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন’।
(সূত্র : বাংলাদেশের শিল্প আন্দোলনের পঞ্চাশ বছর। আমিনুল ইসলাম)