আইরিস সন্ন্যাসী সেন্টকলাম্বা ৮০০ খ্রিষ্টাব্দে মঠের যাজক সেন্ট ফিনিয়ানের কাছে ধর্ম সংগীতের বই ধার নেন এবং না জানিয়ে কপি করে নেন। বিষয়টি অনেকদূর গড়িয়ে রাজ দরবারে পৌঁছে। রাজা একটি যুগান্তকারী রায় দেন The every Cow its calf; to
every book its copy অর্থাৎ মা গাভীর কাছে তার বাছুর যেমন অনস্বীকার্য তেমনি একজন লেখক তার প্রতিটি বইয়ের স্বত্বাধিকারী। লেখকদের বই তার বিনা অনুমতিতে কপি করা হলে লেখকের সৃষ্টির মর্যাদা থাকে না। এই মর্যাদা ও সৃষ্টির সুরক্ষার প্রাচীন ধারণা থেকেই কপিরাইট বা মেধাস্বত্ব আইনের সৃষ্টি।
শিল্প সংস্কৃতির সূতিকাগার ইউরোপে কপিরাইট ধারণার উদ্ভব হয়। সাম্প্রতিক সময়ে ১৮৮৩ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত কনভেনশনে পেটেন্ট ট্রেডমার্ক, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইন, জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেশন কপিরাইট মাধ্যমে সৃষ্টিশীল মানুষের আর্থিক ও নৈতিক অধিকার প্রাপ্তির বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। কপিরাইট আন্দোলনকে একধাপ এগিয়ে নিয়ে যায় ফরাসি লেখক ডিক্টর হুগোর উদ্যোগে ১৮৮৬ সালে অনুষ্ঠেয় বার্ন কনভেশনে।
বাংলাদেশ সৃষ্টির আগেই ১৯৬২ সালে কপিরাইট আইন পূর্ব পাকিস্তানে বলবৎ ছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে কপিরাইট আইন ২০০০ (২০০৫ সালে সংশোধিত) কার্যকর আছে।
উন্নত বিশ্বে কপিরাইট আইন কিছুদিন পর নবায়ন হয়। কারণ কপিরাইট বিষয়ে নিত্যনতুন ধ্রুপদ হাজির হয়। নানা সমস্যার সমাধান ঘটাতে কপিরাইট আইনের পরিবর্তন, পরিমার্জন ও সংশোধনের প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশে বিদ্যমান অনেক আইনের ক্ষেত্রে একটি সাধারণ সমস্যা হচ্ছে যুগোপযোগী নয়। একবার আইন প্রণীত হলে নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে আইনের নবায়ন ঘটানো সম্ভব হয় না। ফলে বিদ্যমান আইনের বিধান দ্বারা সুবিধাভোগীরা আশানুরূপ প্রতিকার পায় না। এ তালিকার শীর্ষে আছে আমাদের দেশের কপিরাইট আইন। ২০০০ সালে প্রণীত আইন (২০০৫ সালে সংশোধিত) আজ অনেক ক্ষেত্রেই তামাদি হয়ে গেছে। কারণ বিদ্যমান আইন দ্বারা সংগীত, নাটক, চলচ্চিত্র, গ্রন্থ ইত্যাদি সেক্টরে পাইরেসি রোধ করা যাচ্ছে না। ইতোমধ্যে চলচ্চিত্র, শিল্পে পাইরেসি এতটাই হানা বসিয়েছে যে, দেশের অর্ধেক প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ হয়ে গেছে। সংগীত জগতে নতুন ক্যাসেট রিলিজ বন্ধ প্রায়। আর গ্রন্থজগতে পাইরেসি নিয়ে প্রকৃত প্রকাশকদের নাভিশ্বাস। ঢাকা, চট্টগ্রাম, বগুড়া, খুলনাসহ দেশের সব বড় শহরের বইয়ের বাজার পাইরেসির কারণে নাকাল দশা। তাই বৌদ্ধিক সৃষ্টিকর্মের স ষ্টার অধিকারের বিষয়ে আইন ও আইনের প্রয়োগ প্রণিধানযোগ্য। বাংলাদেশে বিদ্যমান কপিরাইট আইনে অনেক ফাঁক-ফোকরের মাঝেও যেটুকু আছে সেটুকুর যথার্থ প্রতিপালন নেই। কপিরাইটের বিদ্যমান আইনের ৯৩(১) ধারা অনুযায়ী সাব-ইন্সপেক্টরের নিুতর পদাধিকারী নন, এমন যে কোন পুলিশ কর্মকর্তা গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়াই পাইরেসি সংক্রান্ত কর্মের সব অনুলিপি বা যন্ত্রপাতি বা দ্রব্যসামগ্রী এবং অনুলিপি তৈরির উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত সব প্লেট বা যন্ত্রপাতি বা দ্রব্যসামগ্রী যেখানেই পাওয়া যাবে, তা জব্দ করতে পারেন। অথচ পুলিশ কর্মকর্তারাই কপিরাইট আইন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়। এবং এই আইনের প্রতিপালনে পুলিশের অনীহা রয়েছে। এসব বিষয়কে ধারণ করেই কপিরাইট আইন সংশোধন আশু প্রয়োজন। বিলম্বে হলেও সরকার ২০১৭ সালে কপিরাইট আইন সংশোধন করে সৃজনকর্মের সুরক্ষা ও ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
বাংলাদেশের বাস্তবতায় আমলাতান্ত্রিক নানা ধাপ অতিক্রম করে কারিগরি কমিটি আইন সংশোধন করে অনুমোদনের জন্য জমা দেয়। প্রস্তাবিত সংশোধিত আইনের উল্লেখযোগ্য দিক হলো-
* কপিরাইট-এর একটি সহজ সজ্ঞা সংযোজন করা হয়েছে
* সময়ের দাবি অনুসারে বেশ কিছু উপধারা যেমন নৈতিক অধিকার, অর্থনৈতিক অধিকার, রিলেটেড রাইটস, পাবলিক ডোমেইন, সংকলক ইত্যাদি বিষয় সংযোজন করা হয়েছে
* ইউটিউবসহ নানা মাধ্যমে গান, নাটক, গ্রন্থ ইত্যাদিতে প্রণেতার অধিকার সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে।
* লোকজ্ঞান ও লোক সংস্কৃতির অধিকার সুরক্ষা পাবে প্রস্তাবিত আইনে।
* কপিরাইট সমিতি গঠন ও কার্যকর করার সুযোগ।
* যে কোনো অনুমোদিত সম্প্রচার বন্ধে কপিরাইট অফিসকে ক্ষমতায়ন।
* বিভিন্ন ধারায় শাস্তির মাত্রা বৃদ্ধি করে কঠোরতা আনা হয়েছে।
এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা দাঁড়িয়েছে সংশোধিত আইনটি এখনো অনুমোদনের চূড়ান্ত রূপ পায়নি। আইন অনুমোদনে যদি এতটা দীর্ঘসূত্রতা হয় তাহলে বাস্তবায়ন যোজন যোজন দূর। আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সময়ের দূরত্ব বেশি হলে প্রণীত আইন যুগোপযোগী থাকে না। সংশোধিত কপিরাইট আইনটি এ সমস্যায় পড়তে পারে বলে আমাদের শঙ্কা।
ইতোমধ্যেই সংশোধিত কপিরাইট আইনে রিলেটেড রাইটস-এর আওতায় প্রকাশককে অন্তর্ভুক্ত করা যায় কি না? কারণ গানের ক্ষেত্রে গীতিকার ও সুরকার দু’জনেই রয়েলিটির দাবিদার হলেও পাণ্ডুলিপিতে প্রাণ সঞ্চার করে বই তৈরি করে প্রকাশক, তাহলে তার বিষয়টি বিবেচনায় আসতে পারে কি না?
ই-বুকের মাধ্যমে কেবল যেন বৈধ কনটেন্ট ব্যবহার হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। রেজিস্ট্রার অব কপিরাইটকে আইনের প্রায়োগিক বাস্তবতায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা অর্পণ এবং বিচারিক আদালতের সঙ্গে ট্রাইব্যুনালের বিষয়টি বিবেচনা করার বিষয় সংযোজন দাবি উঠেছে।
উন্নয়নশীল দেশের মানুষকে টিকে থাকার সংগ্রামে সকাল-সন্ধ্যা ছুটতে হয়। বস্তুগত সম্পদ নিয়ে জীবন চালাতেই বেশিরভাগ মানুষের হাপিত্যেশ- সেই পরিপ্রেক্ষিতে সৃজনকর্মের সুরক্ষার বিষয় অনেক সময়ই উপেক্ষিত হয়। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় তথ্য, মেধাশ্রম প্রযুক্তি- ইত্যাদিতে প্রাগ্রসর মানুষই এগিয়ে যাবে। তাই বলা হয়ে থাকে বর্তমান আইটির যুগের সঙ্গে এখন সমধিক গুরুত্ব পাচ্ছে আইপি (ইনটেলেকচুয়াল প্রপার্টি)। সুরক্ষা শুধু মেধাস্বত্বের মাধ্যমে আয় অর্জনে নয় সৃজনকর্ম যেন মৌলিক গুণাগুণ নিয়ে অনাদিকাল চলতে পারে সে ধারাবাহিকতা রক্ষাও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
সাম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানে চৌর্যবৃত্তির বিষয়টি বেশ আলোচিত। দেখা গেছে গবেষণার ক্ষেত্রে সম্মানিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকমণ্ডলীই এই দোষে দুষ্ট। কিছু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিষয়টি আমলে নিয়ে প্লেজারিজমের আশ্রয়ে গবেষণাকর্ম প্রকাশ ও সুবিধাভোগের অপরাধে অনেক শিক্ষককে বিভাগীয় শাস্তি প্রদান করেছেন। অপরদিকে অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির বর্তমান কার্যকর পরিষদের বিপরীত প্যানেল থেকে নির্ধারিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. ঈশানী চক্রবর্তীর গবেষণার জন্য এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রাপ্ত অনুদান বা বৃত্তি জমাকৃত গবেষণা খসড়া প্রতিবেদন প্লেজারিজমের দোহাই দিয়ে কর্তৃপক্ষ বাতিল করে অনুদানের টাকা ফেরত নিয়েই থেমে থাকেননি বরং এ বিষয়ে এশিয়াটিক সোসাইটির সব সদস্যকে অতি আগ্রহী হয়ে ঠিঠি দেওয়া হয়েছে এবং পত্রিকায় বিষয়টি প্রকাশ করা হয়েছে।
প্লেজারিজম কখন হয়? যখন কোনো লেখা বা প্রতিবেদন চূড়ান্তরূপে প্রকাশের আগেই প্লেজারিজম দৃষ্ট হয় তাহলে কর্তৃপক্ষ বাতিল, সংশোধন ও সতর্কতা ইত্যাদি ব্যবস্থা নিতে পারে। চূড়ান্তভাবে প্রকাশের আগে কোনো লেখা পাবলিক ডোমেন নয়। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে প্লেজারিজমসহ নানা কারণে অনেক নিবন্ধ, প্রতিবেদন প্রকাশ পায় না। বিষয়টির এভাবে নিষ্পত্তি করা হয়। এ ক্ষেত্রে সংস্কার ও সংশোধনের সুযোগ না করে দিয়ে গবেষণা প্রতিবেদনের খসড়ার ওপর ভিত্তি করেই অতিমাত্রায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা ও বাংলাদেশের বাস্তবতায় কতটুকু বাস্তবসম্মত। প্লেজারিজম অবশ্যই রোধ করতে হবে তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিষয়টি যেন বিভিন্ন বিবেচনায় প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার অস্ত্র হিসাবে বিবেচিত না হয় এবং গবেষণার ক্ষেত্রে ভীতিকর অবস্থা বিরাজ না করে সে বিষয়টিও গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে।
প্রতিটি মানুষের মধ্যে একটা সৃজনপ্রত্যয়ী মন থাকে। সেই মনের জমিনে অনেককিছু খেলা করে অনেক সময় জনসম্মুখে প্রকাশিত হয় অনেক সময় হয় না। প্রকাশিত সৃজনকর্মগুলো কখনো ব্যক্তির কাছেই গুরুত্ব পায় না জাতীয়ভাবে গুরুত্ব অর্জন করে। সেই সম্পর্কের সুরক্ষা আমাদের জাতীয় দায়িত্ব। লালন, হাছনের গান, রবীন্দ্র-নজরুলের সৃষ্টিসহ সব সৃজনশীল কর্মের মাধ্যমে উত্তরাধিকাররা আয় অর্জন করবে এমনটা নয় কপিরাইট আইন অনুযায়ী সৃষ্টের মৃত্যুর ৬০ বছর পেরিয়ে গেলে আর্থিক অধিকার ক্ষুণ্ন হলেও নৈতিক অধিকার থাকবে যুগ-যুগান্তরে। এ জন্যই আর একটি রবীন্দ্রসংগীত সৃষ্টি করা সম্ভব নয়- বিষয়টি প্রগাঢ় ও গভীর ভাবনার। দেশের উন্নয়ন, শুধু আর্থিক উন্নয়ন নয়, মানবিক সূচকগুলোর পরিব্যাপ্তি প্রয়োজন- এ ক্ষেত্রে সৃজনকর্মের রক্ষাকবচ আইন ও জনসচেতনতার মাধ্যমে নিশ্চিত প্রয়োজন।
ইতিহাস বলে বার্সেলোনায় ১৫০৭ সালে সেন্ট জর্জের মৃত্যু দিবস ২৩ এপ্রিল উপলক্ষ্য করে শুরু হয়েছিল একটি মেলা। ঐতিহ্য অনুসারে পুরুষেরা তাদের স্ত্রী, প্রেমিকা, বান্ধবী অথবা নারী আত্মীয়কে ফুল কিনে দেয়। আর বিনিময়ে নারীরা তাদের একটা বই উপহার দেন- এ বিষয়টি ২৩ এপ্রিল আন্তর্জাতিক গ্রন্থ ও কপিরাইট দিবস হিসাবে নির্বাচনের একটি সূত্র।