Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

অনাড়ম্বরের পথ ধরে অনন্তের ঠিকানায় : কাব্যেন্দ্র শঙ্খ ঘোষ

Icon

রহমান হেনরী

প্রকাশ: ২২ এপ্রিল ২০২১, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আমি তো আমার শপথ রেখেছি/অক্ষরে অক্ষরে

যারা প্রতিবাদী তাদের জীবন/দিয়েছি নরক করে।

দাপিয়ে বেড়াবে আমাদের দল/অন্যে কবে না কথা

বজ কঠিন রাজ্য শাসনে/এটাই স্বাভাবিকতা।

গুলির জন্য সমস্ত রাত/সমস্ত দিন খোলাক্স

বজ কঠিন রাজ্যে এটাই/শান্তি ও শৃঙ্খলা।

যে মরে মরুক, অথবা জীবন/কেটে যাক শোক করেক্স

আমি আজ জয়ী, সবার জীবন/দিয়েছি নরক করে।

[স-বিনয় নিবেদন / শঙ্খ ঘোষ]

পূর্ববাংলায় জন্মে, শৈশব-কৈশোর কাটিয়ে, পশ্চিম বাংলায় চলে গেছিলেন চিত্তপ্রিয় ঘোষ; অতঃপর যিনি বাঙলা ভাষায় কাব্যদেবীর বরপুত্র হবেন, হয়েছিলেন; নাম ধারণ করবেন শঙ্খ ঘোষ; ধারণ করেছিলেন। কেননা যে, শঙ্খে কান পাতলে, সমুদ্রের গর্জন শোনা যায়। শঙ্খের সেই ধর্মও রপ্ত করেছিলেন কবি। বুকের ভিতরে বিস্ফোরণোম্মুখ বারুদ নিয়েও এতটা নিরেট নিরীহ-স্বভাব সন্ত হয়ে, বিনয়- বিভূতিঋদ্ধ হয়ে, আচরণ ও ভাবনা-ভক্সিমায় ঋষিত্ব অর্জন করা যায়; কাব্যেন্দ্র শঙ্খ ঘোষের জীবন ও রচনাকর্মে অভিনিবেশী মনোসংযোগ না- করলে, সেটি বুঝতে পারা অসম্ভব হতো। রবীন্দ্র-জীবনানন্দ পরবর্তী বাঙলা কবিতায়, স্বয়ং কাব্যদেবীর বরপ্রাপ্ত হতে পেরেছেন মুষ্টিমেয় যে কয়জন কবি; তাদেরই অগ্রনাম এই দার্শনিক প্রজ্ঞাময় ঋষি কবি শঙ্খ ঘোষ। কবিতার করণকৌশল ও শৈলিতে অনিবার্য শব্দের নিপুণ পোচ মেরে নিজের সময়কে চিত্রায়িত করার জন্য তিনি যে ক্যানভাস বেছে নিয়েছিলেন; সেটা এতই বিশাল ও বিস্তৃত যে, সহসাই সেটাকে আমাদের বোধ ও উপলব্ধি ধারণ করতে সক্ষম ছিল না। তার কবিতা কথা বলে হারমোনিয়ম-স্বরের তারায় নয়ক্স উদারায়; অথচ সেই মৃদু স্বরকম্পন ভূমিকম্পে তোলপাড় করে দেয় সামাজিক অসঙ্গতি, রাজনৈতিক অনাচার, এমনকি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের হৃদয়পিণ্ডকে; ওইসব কবিতার তিরতীক্ষ্ণ শব্দমালা এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেয় স্বৈর-শয়তানের সাক্ষাৎ প্রতিমূর্তিকে। তার কাব্য ও জীবন একে অন্যের পরিপূরক। তার জীবন কবিতাকে যাপন করেছে; আর কবিতা ধারণ ও লালন করেছে জীবনকে। প্রণম্য পাঠক, আবারও চোখ বোলাতে পারেন সূচনায় উদ্ধৃত কবিতাটিতে। নন্দীগ্রাম গণহত্যার পর লেখা এই কবিতা; এর শব্দে-ছত্রে যে প্রতিবাদ, ক্ষোভ, শ্লেষ; সেখানেই থেমে থাকেননি কাব্যর্ষি শঙ্খ ঘোষ; বরং নন্দীগ্রাম গণহত্যার প্রতিবাদে রাজপথে নেমেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন মিছিলে। তার কবিতা ও জীবনযাপনে, কর্মে কোনো ছলনা ও ভণ্ডামি ছিল না। তিনি কথায় ও কাজে অসাংঘর্ষিক।

শঙ্খ ঘোষের কবিতায় যে প্রতিবাদ তা শিল্পময়তার শানে শানিত, কিরিচের মতো ধারালো; লক্ষ্যবস্তু কেটে চিরে দু’ফালি হয়ে দূরে ছিটকে পড়ার অনেক পরে বুঝতে পারা যায়: চিরলো। যেমন, ক্ষমতাসীনদের অরাজকতা ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের প্রতিবাদে লেখা কয়েকটি কবিতাংশ থেকে পাঠ নেওয়া যাক:

১.

তিন রাউন্ড গুলি খেয়ে তেইশ জন মরে যায়, লোকে এত বজ্জাত হয়েছে!

স্কুলের যে ছেলেগুলো চৌকাটেই ধসে গেলো, অবশ্যই তারা ছিল

সমাজবিরোধী।

ও দিকে তাকিয়ে দ্যাখো ধোয়া তুলসীপাতা

উল্টেও পারে না খেতে ভাজা মাছটি আহা অসহায়

আত্মরক্ষা ছাড়া আর কিছু জানে না বুলেটরা।

দার্শনিক চোখ শুধু আকাশের তারা বটে দ্যাখে মাঝে মাঝে।

পুলিশ কখনো কোনো অন্যায় করে না তারা যতক্ষণ আমার পুলিশ।

২.

[গুজরাট দাঙ্গার পরে লেখা]

নারায়ণ নয়, আমি পেয়ে গেছি নারায়ণী সেনা।

যতদূর যেতে বলি যায় এরা, কখনো আসে না কোনো কূটতর্ক নিয়ে,

ভাবলেশহীন ধ্বংস হাতে ছুটে যায়। যদি বলি দিন বলে দেয় দিন

যদি বলি রাত, বলে রাত

৩.

দিনদুপুরে ঘরের মধ্যে এসে আমাকে গ্রেফতার করছে পুলিশ।

টেনে নিয়ে যাচ্ছে পথে।

কী করেছি? আমি জানতে চা।

তাদের মুখে ঢাকনা দেওয়া, কথা বলছে না কেউ,

কাউকে যদিও দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু বুঝতে পারছি পথে পথে উৎসুক জনতা।

৪.

[আরওয়াল গণহত্যার পর]

ওদের ব্রহ্মর্ষি সেনা, ওদের চক্রের ব্যুহ ঘেরা

ওদের রাইফেলে গুলি ওদের পুলিশ সুপারেরা

শিল্পশৈলীতে প্রজ্ঞাবান কাব্যঋষি জানতেন, তারস্বরে চেঁচিয়ে যে প্রতিবাদ তার কোনো স্থায়িত্ব নেই, চিরায়ত প্রভাব নেই; সে কেবলই তাৎক্ষণিকে জ্বলে ওঠে, তাৎক্ষণিকেই তার আলো ও উত্তাপ উবে যায়; সরাসরি উত্থাপিত অভিযোগও উদ্দিষ্ট পাত্রের মনে স্থায়ী কোনো ছাপ ফেলতে অপারঙ্গম; বরং অভিযোগ যদি অনুযোগাকারে উপস্থাপিত হয়, সেটাই প্রতিক্ষণে খুঁচিয়ে রক্তক্ষরণ ঘটানো বল্লম হয়ে ওঠে। আবারও কবির লেখাতে ফেরা যাক! আরও কিছু কবিতাংশ:

১.

এত যদি ব্যুহ চক্র তীর তীরন্দাজ, তবে কেন

শরীর দিয়েছ শুধু, বর্মখানি ভুলে গেছ দিতে

২.

হাওড়া ব্রিজের চুড়োয় উঠুন/নিচে তাকান, ঊর্ধ্বে চান

দুটোই মাত্র সম্প্রদায়/নির্বোধ আর বুদ্ধিমান

৩.

নিশান বদল হলো হঠাৎ সকালে/ধ্বনি শুধু থেকে গেল, থেকে গেল বাণী

আমি যা ছিলাম তাই থেকে গেছি আজও/একই মত থেকে যায়: গ্রাম রাজধানী

৪.

....‘কী খুঁজছেন?’

মিহি স্বরে বললেন তিনি: ‘ মেরুদণ্ডখানা।’

সেই মুহূর্তে বিদ্যুৎ ঝলকালো ফের। চমকে উঠে দেখি:

একা নয়, বহু বহু জন

একই খোঁজে হামা দিচ্ছে এ কোণে ও কোণে ঘরজুড়ে।

প্রতিবাদী জীবনে এবং কবিতায় বাংলাভাষার অদ্বিতীয় কবি; শঙ্খ ঘোষ। জৌলুসহীন, শাদামাটা, নিরিবিলি জীবনের নিখাদ ভদ্রলোক ছিলেন। আড়ম্বরতা তার অপছন্দ; তাই হয়তো ১৯৪১ এবং ১৯৫৪’র পর ২০২১ নামক এই বর্ষপঞ্জি আমাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে, নিজে অনাড়ম্বরের পথ ধরে, নির্লিপ্ত-নির্বিকার-নিরাভরণ-নিঃশব্দ-নিরাসক্ত, অনন্তের দিকে চলে গেলেন; কিন্তু তার জীবন এবং তার কবিতাকে আমরা লিপ্ত জীবন ও লিপ্ত কবিতা হিসাবেই চিহ্নিত করতে পারি। মানবজীবন, নিজের যাপিতজীবন এবং স্বসময়কে তার রচনাকর্মের দালিলিকে এমন দক্ষতায় তিনি নিবন্ধিত করেছেন যে, রেশমের একটি নিঃসঙ্গ ফিনফিনে একক সুতাও তার চোখকে ফাঁকি দিয়ে ছুটে বা উড়ে যেতে পারেনি। কবির বাস্তু শিরোনামের কবিতাটির পাঠ নেওয়া যাক; যেখানে কন্যাবিরহে কাতর পিতার এবং বিদীর্ণ-হৃদয় ব্যর্থ প্রেমিকের যন্ত্রণা ও নৈঃসঙ্গকে কবি সমবিন্দুতে মিলিয়েছেন; কিংবা প্রকারান্তরে বলা চলে, একই বৃত্তের সদৃশ দুটি স্পর্শককে তিনি অভিন্নতা বা সমরূপায় এঁকেছেন।

আজকাল বনে কোনো মানুষ থাকে না,/কলকাতায় থাকে।

আমার মেয়েকে ওরা চুরি করে নিয়েছিল/জবার পোশাকে।

কিন্তু আমি দোষ দেব কাকে?

শুধু ওই যুবকের মুখখানি মনে পড়ে ম্লান,

প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা ও কেন গলির কানা বাঁকে

এখনো প্রতীক্ষা করে তাকে!

সব আজ কলকাতায়, কিন্তু আমি দোষ দেব কাকে?

কাব্যেন্দ্র সর্বশেষ যে বার বাংলাদেশে আসেন, কলকাতায় ফেরত যাওয়ার আগের দিন ধানমণ্ডিতে অবস্থান করছিলেন; আমার পরিচিত তরুণ এক কবির সেলফোন থেকে আমাকে ফোন করেছিলেন; খুব স্নেহপ্রবণ কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘একটিবার দেখা হলে খুব ভালো লাগতো।’ আমার শরীর কিছুটা খারাপ ছিলো; বাকিটা খুবই তুচ্ছ একটা অভিমান; যেতেই পারতাম; কিন্তু আমি তাকে সবিনয়ে অপারগতার কথা জানালাম। উনি রাগ করার মানুষ ছিলেন না; আফসোস করতে লাগলেন। আমি বললাম ব্যাপার নয়, অচিরেই যাবো, কলকাতায় কথা-সাক্ষাৎ হবে আমাদের; কথা দিচ্ছি। এর কিছুদিন পরই দুনিয়াব্যাপী করোনা এসে হাজির। কথা রাখতে পারলাম না।

কোনো অমূল্য সম্পদ যখন মানুষের ঘরে কিংবা হাতের কাছে থাকে; তখন তার গুরুত্ব বুঝতে পারা সহজ নয়; কিন্তু সেটা যখন হাতছাড়া হয় বা হারিয়ে যায়, তখন হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায়: কী নেই। বাংলা কবিতার এই মুকুটহীন সম্রাটের চলে যাওয়ার সংবাদটি ২১ এপ্রিল দুপুর ১২টার দিকে কবি জুননু রাইন সর্বপ্রথম আমাকে টেলিফোনে জানান। তখন আমার ঠিক সেরকমই অনুভূত হচ্ছিলো, যেমনটি হয়েছিলো ১৯৯৯ সালে, বাগেরহাটে অবস্থানরত আমাকে নাটোরের জেলা প্রশাসক যখন ফোন করে জানিয়েছিলেন আমার প্রিয়তম পিতার অনন্তযাত্রার সংবাদ।

সেই করোনাই জয়ী হলো। আর দেখা হলো না। কথা হলো না। আমাদের দু’জনের মাঝ বরাবর বৈকালিক ছায়ার মতো একটা দীর্ঘশ্বাস প্রলম্বিত হতে থাকবে বহু বছর। অনাড়ম্বরের পথ ধরে অনন্তে পৌঁছালেন কাব্যেন্দ্র। ক্ষতি হয়ে গেলো। দুঃসহনীয়। এ ক্ষতি পূরণ হওয়ার নয়...

‘কিন্তু আমি দোষ দেব কাকে?’

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম