ধর্মীয় উগ্রবাদ ও নাট্যকার রবীন্দ্রনাথ
রাজীব সরকার
প্রকাশ: ০৪ জুন ২০২০, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রবীন্দ্রনাথের সর্বগ্রাসী প্রতিভার অন্যতম ফসল নাটক। বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য শাখার মতো নাটকও তার হাতেই সিদ্ধির শীর্ষে পৌঁছেছে। তার প্রথম উল্লেখযোগ্য নাট্যপ্রয়াস ‘বিসর্জন’। এ নাটকের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ রবীন্দ্রনাথের যুক্তিবাদী ও অসাম্প্রদায়িক জীবনদর্শন যা এমন প্রত্যক্ষ হয়ে তার অন্য কোনো নাট্যকর্মে চিত্রিত হয়নি। নাটকের মূল বক্তব্য আবর্তিত হয়েছে ধর্মভিত্তিক অর্থহীন সংস্কারের সঙ্গে হৃদয় ধর্মের সংঘাত, যুক্তিহীন প্রথার সঙ্গে মানব ধর্মের সংঘাত এবং ধর্মীয় অনাচারের সঙ্গে উদার মনুষ্যত্বের সংঘাতকে কেন্দ্র করে। ত্রিপুরার রাজ পরিবারের এক আখ্যানকে উপজীব্য করে রবীন্দ্রনাথ এক অমোঘ অথচ অনুচ্চারিত ও অপ্রিয় সত্যের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। অন্ধ ধর্মবিশ্বাস ও কুসংস্কার মানুষকে যে সীমাহীন দুর্ভোগের ঘূর্ণাবর্তে নিক্ষেপ করে তা শতাধিক বছর আগেই উপলব্ধি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ধর্মের অপব্যাখ্যার বীভৎস রূপ দেখে ‘বিসর্জন’ নাটকে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন, ‘দেবতার নামে মনুষ্যত্ব হারায় মানুষ।’ এ অমোঘ বাণী একালের যে কোনো ধর্মের দেবতার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এ দেবতা মানে ধর্মান্ধতা ও অনাচার। এ সংকট উত্তরণের উপায়ও রবীন্দ্রনাথ নির্দেশ করেছেন তার সৃষ্টিক্ষম প্রজ্ঞায়। এ ধারারই অন্যতম সৃষ্টি ‘বিসর্জন’।
অসাধারণ কুশলতায় রবীন্দ্রনাথ ‘বিসর্জন’ নাটকে কুযুক্তির সঙ্গে যুক্তিবাদিতার চিরন্তন দ্বন্দ্বকে রূপায়িত করেছেন এবং দেখিয়েছেন আচার ধর্মের ওপর মানবধর্ম কীভাবে জয়ী হয়। নাটকের নামকরণ ‘বিসর্জন’-এর মধ্যে এ নাটকের মূল তাৎপর্য নিহিত। নাটকের শেষে রঘুপতি প্রতিমা বিসর্জন দিলেন- এটি বহির্বাস্তবতা। আর অন্তর্বাস্তবতা হচ্ছে জয়সিংহের প্রাণ বিসর্জন যা রঘুপতির মনে মানবিক চেতনার জন্ম দেয়।
নাটকের প্রথম অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে রানী গুণবতীর আবির্ভাব। সন্তান লাভের আকাঙ্ক্ষায় দেবীর মন্দিরে এসেছেন। তার অর্থ-প্রতিপত্তি, দাস-দাসী, ঐশ্বর্যের অভাব নেই। কিন্তু সন্তানহীনতা তাকে কাঙাল করে রেখেছে। তপ্ত হৃদয়ে, প্রাণের মাঝে আর একটি প্রাণকে অনুভব করার আকাঙ্ক্ষা তার ভেতর প্রবল হয়ে উঠেছে। যেখানে একটি নতুন প্রাণের আকাঙ্ক্ষায় রানীর হৃদয় উদ্বেলিত, সেখানেই অন্য প্রাণীর জীবনাকাঙ্ক্ষার বিষয়ে তিনি নির্লিপ্ত। মন্দিরের পুরোহিত রঘুপতির সামনে তিনি বলেন-
‘করিনু মানত, মা যদি সন্তান দেন/বর্ষে বর্ষে দিব তাঁরে একশো মহিষ, তিনশত ছাগ ।’
রানীর চরিত্রের এই দ্বান্দ্বিকতা নাটকের অন্য চরিত্রগুলোকে পরিচালিত করেছে। নতুন প্রাণের আকাঙ্ক্ষায় একদিকে রানীর আকুলতা, অন্যদিকে অসহায় প্রাণীদের জীবননাশের পণ- তার চরিত্রের এই বৈপরীত্যকে স্পষ্ট করে দিয়ে নাটকে ভিখারিণী অপর্ণার প্রবেশ। গৃহহীনা এ মেয়েটি সহায় সম্বলহীন। তার একমাত্র সম্পদ একটি ছাগ-শিশু, যেটিকে সে মাতৃস্নেহে লালন-পালন করেছে। দেবী কালীর কাছে বলি দেয়ার জন্য প্রাণ কেড়ে নেয়া হয় এ ছাগশিশুর। শোকার্ত-ক্ষুব্ধ অপর্ণা রাজার কাছে ন্যায়বিচার প্রার্থনা করে। দেবীকে সম্বোধন করে সে বলে-
‘মা, তুমি নিয়েছ/কেড়ে দরিদ্রের ধন। রাজা যদি চুরি
করে, শুনিয়াছি নাকি আছে জগতের/রাজা- তুমি যদি চুরি করো, কে তোমারে/করিবে বিচার।’
এই ধর্মীয় অনাচারে রাজা ক্ষুব্ধ হয়ে তার রাজ্যে পশুবলি নিষিদ্ধ করেন। মন্দিরের পুরোহিত প্রতিবাদ করেন, রাজাকে স্মরণ করিয়ে দেন শাস্ত্রবিধি রাজার অধীনে নয়। ধর্মের ব্যাপারে হস্তক্ষেপের অধিকার রাজার নেই, মন্দিরের ভেতরে পুরোহিতের সিদ্ধান্তই শেষ কথা। পুরোহিতের ঔদ্ধত্য রাজার সংকল্পের কাছে প্রশ্রয় পায় না। স্বয়ং দেবীও পশুবলির বিপক্ষে- এ কথা বলে রাজা পুরোহিতকে নিবৃত করেন। ব্যর্থ হয়ে পুরোহিত রঘুপতি রাজাকে ‘নাস্তিক’ বলে অভিহিত করেন।
রাজার সঙ্গে মন্দিরের পুরোহিত রঘুপতির এই দ্বন্দ্ব ‘বিসর্জন’-এর চূড়ান্ত গন্তব্য স্থির করে। তরুণ ভক্ত জয়সিংহকে রঘুপতি পুত্রøেহে লালন করেন। জয়সিংহ রঘুপতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল। ছোটবেলা থেকে মন্দিরের সব আচার ও পশুবলি দেখে সে অভ্যস্ত। ন্যায়-অন্যায়ের বোধ তার জন্মায়নি। এমন প্রেক্ষাপটে রঘুপতি রাজা গোবিন্দমানিক্যকে সিংহাসনচ্যুত করার ষড়যন্ত্র করেন। এ চক্রান্তে যোগ দেয় রাজার ছোট ভাই। চক্রান্ত সফল না হওয়ায় রঘুপতি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চান তার একান্ত অনুগত জয়সিংহকে। তিনি জয়সিংহকে বোঝালেন দেবী কালী রাজরক্ত চান এবং এ রাজরক্ত সংগ্রহ করতে হবে জয়সিংহকে।
অপর্ণার সান্নিধ্য জয়সিংহের আজন্ম লালিত বিশ্বাসে চিড় ধরায়। যে প্রাণীকে অর্পণা পালন করেছে তারই রক্তধারা যখন মন্দিরের সোপান বেয়ে পড়ছে তখন জয়সিংহের অন্তর বিচলিত হয়। একদিকে রঘুপতির অমোঘ প্রভাব, অন্যদিকে অপর্ণা প্রদত্ত নবদৃষ্টি জয়সিংহকে দ্বিধান্বিত করে। ঈশ্বর তথা রঘুপতির প্রতি তার আনুগত্য দুর্বল হয়ে পড়ে। রঘুপতির আদেশ সে উপেক্ষা করে না, রাজাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়। রাজাকে মন্দিরে ফুল দেয়ার জন্য আসতে দেখে জয়সিংহ উপলব্ধি করে দেবীর আদেশ পালন করার সময় উপস্থিত।
দ্বিধাগ্রস্ত জয়সিংহ বুঝতে পারে না রঘুপতির আদেশ এলেই দেবীর আদেশ কিনা। দেবী কালীর কণ্ঠে শুনে সে নিশ্চিত হতে চায় যে তিনি সত্যিই রাজরক্ত চান-
‘বল চণ্ডী, সত্যই কি রাজরক্ত চাই?/এই বেলা বল, বল নিজ মুখে, বল
মানব ভাষায়, বল শীঘ্র- সত্যিই কি/রাজরক্ত চাই?’
আড়াল থেকে উত্তর আসে ‘চাই’। জয়সিংহের সন্দেহ হয় এমন সর্বনাশা আকাঙ্ক্ষা দেবী নিজ মুখে ব্যক্ত করেছেন কিনা। তখন রাজা বললেন-
‘দেবী নহে, জয়সিংহ,/কহিলেন রঘুপতি অন্তরাল হতে,
পরিচিত স্বর।’
জয়সিংহ আবারো দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তার উপলব্ধি-
‘কেবলই সংশয় হতে সংশয়ের মাঝে/নামিতে পারিনে আর! যখনি কূলের
কাছে আসি কে মোরে ঠেলিয়া দেয় যেন/অতলের মাঝে! সে যে অবিশ্বাসদৈত্য!’
জয়সিংহ দেবীকে অনুনয় করে রক্তের বদলে জবা ফুল দিয়ে তার তৃষ্ণা নিবারণ করতে। জবা ফুলও যে রক্তের মতো রাঙা। হতাশ হয়ে জয়সিংহ ছুরি ফেলে দেয়। রঘুপতি ক্ষোভে ফেটে পড়েন। তার আক্রোশে জয়সিংহ অনুতপ্ত হয়। দেবীর চরণ স্পর্শ করে সে শপথ নেয় শ্রাবণের শেষ রাতে সে দেবীর চরণে রাজরক্ত এনে দেবে।
‘বিসর্জন’ নাটকের ঘটনাপ্রবাহ আরও নাটকীয় মোড় নেয়। রাজা গোবিন্দমানিক্যের ভাই নক্ষত্র রায় ও মন্দিরের পুরোহিত রঘুপতির কুটিল ষড়যন্ত্র ধরা পড়ে। দুজনই নির্বাসন দণ্ডে দণ্ডিত হয়। গোবিন্দমানিক্য স্পষ্ট করে বলে দেন দেবতার নামে তার রাজ্যে যে ধর্মান্ধ জীববলি দেবে সেই দণ্ডিত হবে। দেবতার দোহাই দিয়েই রাজার বিরুদ্ধে রাজ্যবাসীকে উত্তেজিত করার চেষ্টা করেন রঘুপতি। জয়সিংহকে দিয়ে নিজের কার্যসিদ্ধির অপেক্ষা করতে থাকেন তিনি। অন্যদিকে অপর্ণার প্রভাবে জয়সিংহ ধীরে ধীরে ধর্মমোহ কাটিয়ে ওঠে। সাধারণ বালিকা অপর্ণার শ্রেয়োবোধ সঞ্চারিত হতে থাকে জয়সিংহের চেতনায়। ধর্মমোহের আবরণ খুলে যায় তার চোখ থেকে। যুক্তিবাদী দৃষ্টিতে সে অবলোকন করে জগৎ ও জীবনকে। মন্দির ছেড়ে বেরিয়ে পড়ার জন্য অপর্ণার আহ্বানকে যেমন সে উপেক্ষা করে তেমনি রঘুপতির কূট ইচ্ছা বাস্তবায়নেও সে অস্বীকৃতি জানায়।
জয়সিংহ নিজে রাজপুত্র, রাজার বংশধর। তার দেহেও রাজরক্ত প্রবাহিত। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করে না সে। নিজের বুকে ছুরি চালিয়ে দেবীর উদ্দেশ্য সে বলে-
‘এই যেন শেষ রক্ত/হয় মাতা, এই রক্তে শেষ মিটে যেন
অনন্ত পিপাসা তোর, রক্ত তৃষাতুরা!’
জয়সিংহের আত্মবিসর্জন মুহূর্তের মধ্যে পাল্টে দেয় দৃশ্যপট। দাম্ভিক, হিংসার পূজারি রঘুপতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। রঘুপতির অপত্য
স্নেহের একমাত্র ধন জয়সিংহ যে প্রাণ বিসর্জনের মধ্য দিয়ে তাকে এমন শিক্ষা দেবে তা ছিল অকল্পনীয়। যে দেবীকে নিয়ে তার এত আবেগ উত্তেজনা সেই দেবীর প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন তিনি। দেবীর অস্তিত্বই তিনি আর স্বীকার করতে চান না।
রঘুপতি উপলব্ধি করেন এতদিন মন্দিরে শুধু পাপের রক্ত প্রবাহিত হয়েছে। এই সহিংস রক্তধারাকে জয়সিংহ নিজের পুণ্যরক্ত দিয়ে চিরতরে মুছে দিয়েছে। অপর্ণা যখন শোকাতুর রঘুপতিকে বলে, ‘পিতা চলে এসো’ তখন রঘুপতির মনে হয়- ‘পাষাণ ভাঙ্গিয়া গেল জননী আমার/এবার দিয়েছে দেখা প্রত্যক্ষ প্রতিমা।’ এই প্রথম রঘুপতি যথার্থভাবে ঈশ্বরোপলব্ধি করলেন। এতদিন তিনি শুধু মন্দিরের পুরোহিত ছিলেন। ধর্মকে ব্যবহার করেছেন নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য। জয়সিংহের আত্মবিসর্জন তার চেতনার রূপান্তর ঘটাল। তিনি দেবীকে প্রত্যক্ষ করলেন অপর্ণার মাঝে, ধর্মের প্রকৃত তাৎপর্য তিনি হৃদয়ঙ্গম করলেন। জয়সিংহের আত্মত্যাগ রাজা গোবিন্দমানিক্য ও রানী গুণবতীকেও অভিভূত করে। তারাও উপলব্ধি করেন মন্দিরে বা শাস্ত্রে নয়, মানুষের মধ্যেই ঈশ্বরকে খুঁজে পাওয়া যায়।
পুরোহিততন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে স্ত্রীর অনুরোধ ও প্রজাদের অসন্তোষকে উপেক্ষা করে মানবপ্রেমী রাজা গোবিন্দমানিক্য তার রাজ্যে জীব বলিদান নিষিদ্ধ করেছিলেন। সহস বছর ধরে চলে আসা এ নিষ্ঠুর রীতিকে ছিন্ন করার শক্তি তিনি পেয়েছিলেন অপর্ণার কাছ থেকে। রাজার উপলব্ধি-
‘বালিকার মূর্তি ধরে/স্বয়ং জননী মোরে বলে গিয়েছেন
জীবরক্ত সহেনা তাঁহার।’
অপর্ণার প্রেরণাতেই ধর্মান্ধতা পরাজিত হয়, জয়ী হয় মানবতার মুকুট। তার কারণেই নিষিদ্ধ হয় জীব বলিদান, পাষাণ মূর্তি নিক্ষিপ্ত হয় নদীতে। ‘বিসর্জন’ নাটকের এমন পরিণতি রবীন্দ্রনাথের যুক্তিনিষ্ঠারই পরিচায়িক।
আচারসর্বস্ব প্রথার সঙ্গে প্রাণধর্মের সংঘাতের অসামান্য উদাহরণ ‘অচলায়তন’ নাটক। ১৯১২ সালে প্রকাশিত এ নাটকে রবীন্দ্রনাথ দেখালেন আচারসর্বস্ব হয়ে কীভাবে হিন্দু ধর্ম অচল কারাগারে রূপান্তরিত হয়েছে। ‘অচলায়তন’ নাটকের প্রেক্ষাপট এমন এক জনগোষ্ঠীকে ঘিরে যারা এক সংকীর্ণ পরিসরে আবদ্ধ। অচলায়তনের কোনো কিছুই সচল নয়। পাথরের প্রাচীর, বদ্ধ দরজা, নানা রেখার গণ্ডি, স্তূপাকার পুঁথি, মন্ত্রপাঠের গুঞ্জনধ্বনি- এসব এই আবদ্ধ আয়তনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। কূপমণ্ডূক এ পরিবেশটি অন্ধকারাচ্ছন্ন, ইউরোপের মধ্যযুগের মতোই। বাইরের আলো হাওয়াবঞ্চিত অচলায়তনে মুক্তির কোনো স্বাদ নেই। আচার, সংস্কার এখানে আস্তানা গেড়েছে। পঞ্চক এ অচলায়তনের বাসিন্দা। কিন্তু সে বাইরের ডাক শুনতে পেয়েছে। এ অমোঘ আহ্বানকে উপেক্ষা করার উপায় তার নেই। একটি নতুন সুরের মধ্য দিয়ে সেই আহ্বান অনুরণিত হয়েছে তার কণ্ঠে যা দিয়ে নাটকের সূত্রপাত-
‘তুমি ডাক দিয়েছ কোন সকালে/কেউ তা জানে না,
আমার মন যে কাঁদে আপন-মনে/কেউ তা মানে না।
ফিরি আমি উদাস প্রাণে,/তাকাই সবার মুখের পানে,
তোমার মতো এমন টানে/কেউ তো টানে না।’
‘অচলায়তন’ নামের আশ্রমের বাঁধ দেয়া হয়েছে লোহার কপাট দিয়ে। আশ্রমের বিদ্যার্থীদের বাইরে প্রবেশাধিকার নেই। তাদের অধিকার শুধু ধর্মীয় মন্ত্রের অন্ধ অনুকরণে। কঠোর বিধি অচলায়তনের সবাইকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। পঞ্চকের এ বাঁধাধরা জীবন ভালো লাগে না। তার কাছে মনে হয়েছে মন মন্ত্রের চেয়ে সত্য, বড় মহান। অচলায়তনের ছাত্রদের একজন পঞ্চককে জিজ্ঞাসা করেছে, ‘আচ্ছা বলো দেখি হরেত পক্ষীর নখাগ্রে যে পরিমাণ ধূলিকণা লাগে সে পরিমাণ যদি-’ জবাবে পঞ্চকের বক্তব্য, ‘আরে ভাই, হরেত পক্ষীই কোনো জন্মে দেখিনি।’ অচলায়তনের উত্তর দিকে একটি দেবী মন্দির, তাই সেদিকের জানালা খোলা নিষেধ। বালক সুভদ্র সেই জানালা খুলেছে। রবীন্দ্রনাথ বাঁধ ভাঙার প্রথম হাতিয়ার হিসেবে উপস্থাপন করেছেন সুভদ্রকে। জানালা খুলে দেখা যায় বাইরে পাহাড় আছে এবং সেখানে গরু চরছে। তিনশত পঁয়তাল্লিশ বছর যে জানালা খোলা হয়নি সেটি খুলে সুভদ্র অপরাধ করেছে- এটিই আশ্রমবাসীর বিশ্বাস। পঞ্চক এটিকে কোনো অপরাধ মনে করেনি। উপাধ্যায় এ কথা শুনে ক্ষুব্ধ। আচার্য মহাশয় সুভদ্রকে শাস্তি দিতে নারাজ। তার মতে সুভদ্র কোনো পাপ করেনি।
সুভদ্রের পক্ষ নেয়ায় পঞ্চককে অচলায়তন থেকে বের করে দেয়া হয়। নির্বাসনে পাঠানো হয় তাকে। গন্তব্যহীন পথে বেরিয়ে পড়ে পঞ্চক। এ অজানা পথকেই তার আপন মনে হয়। সে মুক্তির স্বাদ লাভ করে তার উপলব্ধি- ‘খাঁচায় যে পাখিটি জন্মায়, সে আকাশকেই সবচেয়ে ডরায়।’
পঞ্চকের সঙ্গে দেখা হয় কর্মবীর শোনপাংশু দলের। তারা কাজের লোক, কাজ ছাড়া কিছু বোঝে না। কাজই তাদের ধর্ম। তারা আনন্দ করে, নাচে। তাদের কর্মচঞ্চল জীবন পঞ্চককে আকৃষ্ট করে। শোনপাংশুরা লোহার কাজ করে। তারা কাঁকুড় আর খেসারি ডাল চাষ করে শুনে পঞ্চক অবাক হয়। অচলায়তন শিক্ষা দিয়েছিল যে এগুলো চাষ করা মানে পাপের পঙ্কিলে নিমজ্জিত হওয়া। শোনপাংশুদের জীবনমথিত গানে পঞ্চক প্রাণের সন্ধান পায়-
‘আপন হাতের জোরে/আমরা তুলি সৃজন করে
আমরা প্রাণ দিয়ে বাঁধি/থাকি তাঁর মাঝেই ।’
দাদা ঠাকুর এক আশ্চর্য চরিত্র এই নাটকের। শোনপাংশুদের কাছে তিনি শতদল পদ্ম আর দর্ভকেরা তাকে মনে করে ‘গোঁসাই’। অচলায়তনের আশ্রমবাসীরা গুরুর প্রতীক্ষায় ছিল। তাদের আশঙ্গা ছিল আশ্রমের বিধি কঠোরভাবে অনুসরণ না করার জন্য গুরু তাদের ভর্ৎসনা করবেন। কিন্তু না, এমন গুরু নন দাদাঠাকুর। তিনি এসে জাগরণের মন্ত্রে দীক্ষিত করেন সবাইকে। দাদা ঠাকুরকে গুরু মেনে পঞ্চক অচলায়তনের বাঁধ ভাঙতে চায় ।
দাদাঠাকুর শোনপাংশুদের নেতা। তাদের সঙ্গে তিনি খেলে বেড়ান। খেলতে খেলতে তার মনে হয়, ‘আমি ঝরনার সঙ্গে খেলছি, সমুদ্রের সঙ্গে খেলছি।’ অচলায়তন ভাঙার উদ্যোগ নেন দাদাঠাকুর। তার ঘোষণা- ‘আমাদের রাজার আদেশ আছে এদের পাপ যখন প্রাচীরের আকার ধরে আকাশের জ্যোতি আচ্ছন্ন করতে উঠবে তখন সেই প্রাচীর ধুলোয় লুটিয়ে দিতে হবে।’
রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য নাটকের মতো অচলায়তন নাটকেও একজন রাজা আছেন। তার নাম মন্থর গুপ্ত। এ রাজা অন্ধকারের পূজারি ও প্রাচীন বিধির অন্ধ উপাসক। কোনো এক শোনপাংশু স্থবির হওয়ার জন্য পোড়ো মন্দিরে তপস্যায় রত ছিল। সেই অপরাধে রাজা তাকে হত্যা করে। স্থবির পত্তনের প্রাচীরকে আশি হাত উঁচু করার জন্য তিনি লোক নিয়োগ করেন যেন কেউ লাফ দিয়ে হঠাৎ স্থবিরক হয়ে উঠতে না পারে। শাস্ত্রের এমন বিধি অচলায়তনবাসীকে কূপমণ্ডূক করে রেখেছিল। দাদাঠাকুর স্থবির পত্তনের প্রাচীর ভাঙার জন্য অগ্রসর হন।
দাদাঠাকুরের দলের রাজ্যসীমার প্রাচীর ভাঙার সংবাদ পৌঁছে যায় রাজার কানে। তিনি মুষড়ে পড়েন। আশ্রমের বালকেরা মহাখুশি। চারপাশ থেকে আলো ঘিরে ধরেছে। সমস্ত আকাশ ঘরের ভেতরে চলে এসেছে। পঞ্চকের বড় ভাই মহাপঞ্চক প্রচণ্ড বিষণ্ন। অচলায়তরে একমাত্র রক্ষাকর্তা সে। যোদ্ধা বেশে দাদাঠাকুর ধাবমান, তার পেছনে শোনপাংশুর দল যাদেরকে মহাপঞ্চক ম্লেচ্ছ ছাড়া কিছু ভাবে না। শোচনীয় পরাজয়ের মুখে মহাপঞ্চক তার নিজের ভেতর চলে যায়, ইন্দ্রিয়ের সমস্ত দ্বার রুদ্ধ করে দিয়ে প্রায়োপবেশনে বসে। লড়াইয়ের শেষ মুহূর্তে দর্ভক দল ছুটে আসে দাদাঠাকুরের দলে যোগ দিতে। এর আর প্রয়োজন হয় না। অবরুদ্ধ অচলায়তনের পতন ঘটে। আকাশে আগেই মেঘ জমেছিল বজ নিনাদ শোনা গেছে। এরপর নেমে এলো বৃষ্টি যার জন্য তৃষিত ছিল পৃথিবী। দাদাঠাকুর বলেন, ‘ভাবনা নেই আচার্য, ভাবনা নেই- আনন্দের বর্ষা নেমে এসেছে- তার ঝর ঝর শব্দে মন নৃত্য করছে আমার। বাইরে বেরিয়ে এলেই দেখতে পাবে চারদিক ভেসে যাচ্ছে।’
প্রাচীর আর লোহার দরজা ভেঙে অচলায়তনে অন্তহীন আলো ছড়িয়ে পড়েছে। মুক্তির আলোয় সবার হৃদয় আলোকিত। বাঁধভাঙা আলোর জোয়ারে ভেসে যায় অচলায়তন। মুক্তিপিয়াসী পঞ্চকের উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে যোগ দেয় সবাই-
‘আলো, আমার আলো, ওগো
আলো ভুবনভরা।
আলো নয়ন-ধোওয়া আমার
আলো হৃদয়হরা।’
মুক্ত অচলায়তনকে ঘিরে আশাবাদী সবাই। শোনপাংশুরা কাজের জন্য অস্থির হয়ে পড়ছে। দাদাঠাকুর তাদের কাজ দেবেন, সবার ঠাঁই হবে এখানে। অচলায়তনের সব বিধিনিষেধ উঠে যায়। প্রাণহীন ধর্মাচার আর যুক্তিহীন প্রথার অবসান ঘটিয়ে নতুন যুগের ঘোষণা দিয়ে এ নাটকের সমাপ্তি ঘটে।