
প্রিন্ট: ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:৩৪ এএম
ব্যক্তি সাইফুল আলম ও তার সাহিত্যবোধ

সাইফুর রহমান
প্রকাশ: ২২ মার্চ ২০১৯, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
‘কিনু গোয়ালার গলি’ ‘শেষ নমস্কার’সহ বহু কালজয়ী উপন্যাস ও গল্পের লেখক প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও সাংবাদিক সন্তোষ কুমার ঘোষ যখন আনন্দবাজার পত্রিকার দায়িত্ব নিয়েছিলেন তখন সংবাদ প্রকাশের ধরনই তিনি পরিবর্তন ঘটাতে চাইলেন।
আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে সেখানে নিয়ে আসলেন বহু কবি-সাহিত্যিককে। উদ্দেশ্য ছিল প্রতিদিনের সংবাদের ভাষাও হবে সাহিত্যরসে সমৃদ্ধ। পাঠকরা একই সঙ্গে খবর ও কাব্যময় গদ্যের স্বাদ আস্বাদন করবেন।
একজন লেখকের সৃষ্টি সম্পর্কে জানার আগে সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে কিছুটা জ্ঞান থাকা প্রয়োজন, তাহলে সেই লেখকের সাহিত্য সম্পর্কে ভালোভাবে জানা যায়। সন্তোষ কুমার ঘোষ প্রসঙ্গ এখানে উল্লেখ করতে হল এ কারণে যে, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক সাইফুল আলমের মধ্যে যেন সন্তোষ কুমার ঘোষেরই প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই আমি। আনন্দবাজার পত্রিকাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯২২ সালে।
কিন্তু এর জনপ্রিয়তা শুরু হয় সন্তোষ কুমার ঘোষের হাত ধরে। যা আজও বিদ্যমান। যুগান্তর পত্রিকাটির জন্মকাল বিশ বছর আগে। বর্তমানে এটি দেশের অন্যতম শীর্ষ জনপ্রিয় পত্রিকা। আর এই জনপ্রিয়তার পেছনের মূল কারিগর সম্পাদক সাইফুল আলম।
এবারের বইমেলায় সাইফুল আলমের ‘গণতন্ত্রের যাত্রা ও অন্যান্য’ নামে একটি প্রবন্ধ সংকলন বেরিয়েছে। বইটিতে স্থান পেয়েছে বাছাই করা ২৭টি প্রবন্ধ।
বইটির ফ্ল্যাপে প্রবীণ সাংবাদিক ও সাহিত্যিক রফিকুল হক দাদুভাই লিখেছেন- সাইফুল আলম লিখিত প্রবন্ধগুলো তথ্য, তত্ত্ব ও পাণ্ডিত্যের কচকচানিতে কণ্টকিত কোনো প্রবন্ধ কিংবা নিবন্ধের সমাহার নয় বরং শুভচিন্তক দেশবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষারই প্রতিফলন ঘটেছে তার বইটিতে। এখানেই এ গ্রন্থের রচয়িতা হিসেবে সাইফুল আলমের সার্থকতা। রফিকুল হক দাদুভাই যথার্থই লিখেছেন। সাইফুল আলমের প্রবন্ধগুলোয় প্রকাশ পেয়েছে দেশের নানা সমস্যায় লেখকের নিজস্ব ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ। সাইফুল আলমের লেখালিখির হাতেখড়ি বেশ অল্প বয়সেই। লেখকের প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘হাত বাড়ালেই আকাশ’ গল্পগ্রন্থ ‘ছেঁড়া পাতা’, ‘নিমফুলের ঘ্রাণ’ এবং প্রবন্ধ সংকলন ‘কিছু ভাবনা কিছু কথা’ এসব গ্রন্থগুলোয় তার ব্যতিক্রমী মননের দিকটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। লেখকের জন্ম চাঁদপুরে হলেও তার লেখাপড়া ও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। লেখাপড়ার পাশাপাশি তিনি সক্রিয় ছিলেন নানা ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। শিশু সংগঠন চাঁদের হাট ও সাপ্তাহিক কিশোর বাংলার সাংস্কৃতিক জোয়ারে চষে বেড়িয়েছেন সমগ্র বাংলাদেশ। সেসব অভিজ্ঞতারই প্রতিফলন ঘটেছে তার নানা সৃষ্টিশীল রচনায়। এ প্রসঙ্গে আমার এ মুহূর্তে ২০১০ সালে নোবেল পাওয়া পেরুর বিখ্যাত লেখক মারিও ভার্গাস ইয়োসার কথা মনে পড়ে যায়। সম্পাদক সাইফুল আলম যেমন অতি অল্প বয়সে বেছে নিয়েছিলেন সাংবাদিকতা পেশা ঠিক তেমনি ইয়োসাও ষোলো বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই নিজেকে যুক্ত করেছিলেন পেরুর ‘লা ক্রনিকা’ নামক একটি সংবাদপত্রে। সাংবাদিক জীবনের রোমাঞ্চকর সেই অভিজ্ঞতাগুলো ইয়োসা লিখেছেন তার উপন্যাস ‘ক্যাথেড্রালে কথোপকথন’-এ। সাংবাদিক হিসেবে প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ইয়োসা লিখেছেন- সেই রাতে ছাপার অক্ষরে নিজের প্রথম লেখা দেখার উত্তেজনায় আমার আর ঘুম হল না। পরদিন সকালে উঠেই আমি লা ক্রনিকা নিয়ে এলাম, পাতা উল্টাতেই চোখে পড়ল, বক্সে ছাপানো ‘আজ সকালে ব্রাজিলিয়ান রাষ্ট্রদূত সিনর দন...তার পরিচয়পত্র পেশ করেছেন’। আমি এখন সাংবাদিক।
১৮৭০ সালের ভাদ্র মাসে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা তাদের শুভার্থীদাতাদের একটি নামের তালিকা প্রকাশ করেন। সেই ছাপা নামের তালিকায় দেখা যায়, জনৈক দাতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম। দাতা এ ব্যক্তিটি দান করেছেন ২ টাকা ১২ আনা ৩ পয়সা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর একবার তাকে নিয়ে ডালহৌসি পাহাড়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন, কিছুদিন পর তিনি রবীন্দ্রনাথকে ফেরত পাঠিয়ে নিজে রয়ে গেলেন সেখানে। হাতখরচ বাবদ ছেলের হাতে কিছু টাকা দিয়েছিলেন। সেই টাকা থেকে কিছু টাকা বাঁচিয়ে তিনি দান করেছিলেন তত্ত্ববোধিনী ফান্ডে।
তিনি তার নিজের নামটি ছাপার অক্ষরে দেখার জন্যই যে এ কাজটি করেছিলেন সেটি বোঝা যায় এ কারণে যে, ব্রাহ্মসমাজের ছাপাখানায় টাইপ খুঁজে খুঁজে নিজের নাম সাজিয়ে তাতে কালি মেখে কাগজের ওপর ছাপ দিয়ে দেখতে তার ভালো লাগত। এ ঘটনার উল্লেখ আছে, তার জীবনস্মৃতিতে। সে যা হোক ‘গণতন্ত্রের যাত্রা ও অন্যান্য’ গ্রন্থের লেখক সাইফুল আলমেরও এ ধরনের কোনো অভিজ্ঞতা আছে কিনা আমাদের জানা নেই। তবে সেসব কিছু জানার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে তার পূর্ণাঙ্গ আত্মজীবনী প্রকাশ পর্যন্ত। আমার সঙ্গে সাইফুল আলমের ব্যক্তিগত সখ্যতা রয়েছে বলেই বলছি না, সদালাপী এ মানুষটি প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরপুর। ক্ষমতার চূড়ান্ত বলয়ে বাস করেও তিনি নির্লোভ, নিরহংকারী ও বন্ধুবৎসল মানুষ। মাটির সঙ্গে একেবারে মিশে থাকেন সবসময়।
ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায় সাংবাদিকদের গুণাবলিকে দু’ভাগে ভাগ করেছেন- ১. বৃত্তিগত গুণ ২. চারিত্রিক গুণ। বৃত্তিগত গুণ হচ্ছে সাংবাদিকতার একটি বৃত্তি। অন্যান্য বৃত্তির মতো। সাংবাদিকতা নানা চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করে। সেজন্য সাংবাদিকদের বৃত্তিগত ব্যুৎপত্তি দেখার জন্য উপযুক্ত হতে হয়। সাংবাদিকদের আর একটি গুণ হল চারিত্রিক গুণ। সাংবাদিকতায় প্রলোভন অনেক। এসব প্রলোভন নানা ছদ্মবেশে এসে তার চরিত্র নষ্ট করে। তাই সাংবাদিককে এসব প্রলোভন জয় করতে হয়।
বাইবেলে আছে একজন অসতী নারীকে পাথরের আঘাতে মেরে ফেলার দণ্ডাদেশ দেয়া হল। যীশু বলেছিলেন, তোমাদের মধ্যে সেই-ই প্রথম ঢিলটি ছুড়বে যে কখনও পাপাচার করেনি। এ কথা শুনে জনতার মধ্যে গুঞ্জন উঠল, সবাই আত্মানুসন্ধানে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কেউ আর প্রথম ঢিলটি ছুড়ল না। সাংবাদিকদের এ গল্পটি স্মরণে রাখা কর্তব্য। কারণ সাংবাদিকদের কাজই হল অপরের ছিদ্র অন্বেষণ করা। অপরের অন্যায় ও ত্রুটি-বিচ্যুতির নির্মম সমালোচনা করা। কিন্তু এ সমালোচনা করার অধিকার আছে বলেই সাংবাদিকদের উচিত হবে ব্যক্তিগত জীবনে কোনো অসদাচরণকে প্রশ্রয় না দেয়া। সাংবাদিক বিচারক। বিচারকের বিচক্ষণতা, নিরপেক্ষতা ও ন্যায়পরায়ণতা সাংবাদিকদের প্রধান গুণ হওয়া উচিত।
পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের প্রনিধানযোগ্য উপরোক্ত সূত্র ধরেই বলতে হয় সাইফুল আলম বৃত্তিগত গুণ ও চারিত্রিক গুণ- এ দু’গুণেই উজ্জ্বল। তার কলামগুলোতে প্রতিভাত হয়েছে সময়ের নানা অসঙ্গতি, আশপাশের মানুষের চিন্তা ও কার্যক্রমের সমকালীন বৈকল্য ও অসহায় মানুষের হাহাকার। তার গ্রন্থের ‘পোড়া মবিলে কালিমালিপ্ত প্রিয় স্বদেশ’ কিংবা ‘পরিবহন ধর্মঘট স্বীয় স্বার্থ উদ্ধারের আগুনে না পোড়াই দেশকে’ প্রভৃতি কলামগুলোয় কি দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন আমরা কীভাবে কতগুলো নির্দয় মানুষের হাতে জিম্মি ও এ থেকে পরিত্রাণের উপায়। লিখেছেন মানবতা জাগানিয়া কলাম- ‘আদুরীদের পাশে দাঁড়ানোর ডাক দিয়ে যাই’, ‘আনিসুল হক, আপনাকে শ্রদ্ধা’ প্রভৃতি। সাইফুল আলমের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তিনি যা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন সেগুলোই উঠে আসে তার লেখায়। এ প্রসঙ্গে চার্লস ডিকেন্স একবার বলেছিলেন আমি যা বিশ্বাস করি না তা কখনও লিখি না। বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একবার বেড়াতে গিয়েছেন মামাবাড়ি ভাগলপুরে।
পথে তার বিদ্যালয়ের প্রাক্তন এক মাস্টার মশাইয়ের সঙ্গে দেখা। শরৎকে উদ্দেশ করে মাস্টার মশাই বললেন- কিরে শরৎ শুনলাম তুই নাকি লিখে আজকাল বেশ নাম করেছিস। তবে একটা কথা সবসময় মনে রাখিস। যা বিশ্বাস করিস না তা কখনও লিখিস না। তাহলে আত্মার সঙ্গে প্রতারণা করা হবে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মাস্টার মশাইয়ের সে কথা মনে রেখেছিলেন।
ব্যক্তি হিসেবে যে কেউ যে কোনো রাজনৈতিক দলের আদর্শে প্রভাবিত হতে পারেন। কিন্তু লেখালেখিতে বা সাংবাদিকতার পেশায় সে প্রভাব না পড়াই শ্রেয়। সাইফুল আলমের লেখা পড়ে সেই সত্যটিই উপলব্ধ হয়েছে। যেমন তার গ্রন্থের একটি কলাম ‘সমন্বয়হীনতা এখন বড় আওয়ামী সিনড্রোম’, ‘বর্গির মতো খাজনা আদায় কাম্য নয়’, ‘প্রশ্নপত্র ফাঁস নাকি জাতির সর্বনাশ’, ‘মাইনাস নয় প্লাসের প্রজ্ঞাই গণতন্ত্রের অভিযাত্রা’ ইত্যাদি।
সাইফুল আলম তার লেখায় ও টক্শোগুলোয় প্রকৃত বুদ্ধিজীবীর দায়িত্বই পালন করেছেন সবসময়। ইনটেলেকচুয়ালরা বামপন্থী বা দক্ষিণপন্থী হতে পারেন, আবার সম্পূর্ণরূপে দল-মতের ঊর্ধ্বে থাকতে পারেন। তবে যারা শুধু জনগণের মনোভাব বুঝে নিজস্ব যুক্তি ও বুদ্ধি অনুসারে বলিষ্ঠ পদক্ষেপে এগিয়ে যাবেন তারাই আদর্শ ইনটেলেকচুয়াল। সাধারণ মানুষ কিন্তু পত্রপত্রিকা ও রেডিও-টিভিতে কথা বলার সুযোগ পায় না, এ জন্য বুদ্ধিজীবীরাই জনগণের পক্ষ হয়ে পত্রপত্রিকা ও অন্য গণমাধ্যমগুলোয় কথা বলেন।
সত্যিকারের বুদ্ধিজীবীকে জাগতিক সুখ-সুবিধার প্রলোভন থেকে দূরে থাকতে হয়। এ জন্যই বোধ হয় বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছেন, কোনো বিশেষ দলভুক্ত হলে তিনি কখনও সত্যিকার বুদ্ধিজীবী হতে পারেন না। সত্যিকার বুদ্ধিজীবী শুধু আপামর জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলো নিয়েই সব সময় সোচ্চার থাকবেন, সর্বোপরি এটাই তাদের কাছে প্রতিদিনের প্রত্যাশা।
সাইফুল আলমের এবারের বইটির নাম যেমন ‘গণতন্ত্রের যাত্রা ও অন্যান্য’ ঠিক তেমনই এর আগের বইটির নামও ‘মাইনাস নয় প্লাসের প্রজ্ঞাই গণতন্ত্র’। এতে করে একটি বিষয় স্পষ্ট প্রতীয়মান যে, দেশের যথার্থ গণতন্ত্রের প্রতি রয়েছে তার গভীর শ্রদ্ধাবোধ।
তার ‘মাইনাস নয় প্লাসের প্রজ্ঞাই গণতন্ত্র’ বইটির রিভিউ লিখেছিলেন বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। জনাব চৌধুরী সাইফুল আলম সম্পর্কে লিখেছিলেন- ‘পথ হারাতে প্রস্তুত নন সাইফুল আলম’।
আর আমি মনে করি পথ হারানোর তো প্রশ্নই আসে না বরং তার জীবনের সব অভিজ্ঞতাগুলো কাজে লাগিয়ে তিনি হয়তো একদিন সন্তোষ কুমার ঘোষের মতো লিখে ফেলবেন ‘কিনু গোয়ালার গলি’ কিংবা ‘শেষ নমস্কারের’ মতো উপন্যাস।