চিত্রশিল্পী জামাল আহমেদ-এর আকাশ ছোঁয়া গন্তব্য

ড. মুস্তাফা মজিদ
প্রকাশ: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বাংলাদেশের বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী (অধ্যাপক) জামাল আহমেদ এ বছর [২০১৯] চিত্রকলায় বিশেষ অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয় দ্বিতীয় সম্মানিত পুরস্কার- একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন। কৃতীমান এ শিল্পীর এ পদক অনেক আগেই পাওয়া উচিত ছিল বলে চিত্রকলার বোদ্ধারা মনে করেন।
মেধাবী এ শিল্পীর জন্ম ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায়। স্কুল জীবনে পড়াশোনা করেছেন ঢাকার ল্যাবরেটরি উচ্চবিদ্যালয়। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে স্কুল সার্টিফিকেট শেষ করে ভর্তি হন ঢাকার আর্ট কলেজে- যা এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা ইন্সটিটিউট নামে অভিহিত। পেইন্টিংয়ে এখান থেকে স্নাতক সমাপ্ত করে এ বিভাগেরই প্রভাষক পদে যোগদান করেন।
প্রখর মেধা ও মননের অধিকারী এই গুণধর শিল্পীর জীবনায়ন [Career] অত্যন্ত বর্ণাঢ্য। যেমন ১৯৮০-৮১ খ্রিস্টাব্দে তিনি পোল্যান্ডের রাজধানী ওযারশ থেকে ফাইন আর্টসের ওপর গবেষণা কর্মের কোর্স সম্পন্ন করেন; ১৯৮২ সালে তিনি জাপানের ওসাকা ইউনির্ভাসিটি থেকে জাপানি ভাষা শিক্ষা লাভ করে ১৯৮২-৮৪ সালে তিনি জাপানের টুসুকুবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন আর্টসের প্রফেসর ফুমেকো ইয়োমাটোর অধীনে ফাইন আর্টসের পেইন্টিং বিষয় হাতে-কলমে শিক্ষা গ্রহণ করেন। পরে ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই তিনি ফাইন আর্টসে মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করেন অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে।
অন্যদিকে জামাল আহমেদের এ পর্যন্ত দেশে ও বিদেশে সত্তরটিরও অধিক একক চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং অন্য শিল্পীদের সঙ্গে প্রদর্শনীর সংখ্যা কয়েকশ’। দেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং দেশের ও বিদেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সংগ্রহে রয়েছে শিল্পী জামালের চিত্রকর্মসমূহ। যা চিত্রশিল্পীদের ক্ষেত্রে বিরল।
সত্যিকার অর্থে জামাল যেন জন্মগতভাবেই একজন ক্ষণজন্মা শিল্পী। যিনি এদেশের চিত্রকলার পথিকৃৎ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন-এর একজন সার্থক অনুসারী ও অনুরাগীও বটে! জামাল আহমেদ এর অংকন শৈলী এক ধরনের বিশেষ নিপুণতায় ভাস্বর যা অন্য কোনো শিল্পীর মাঝে খুব একটা দেখা যায় না। পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যকলার আধুনিক সমন্বয় সাধনে জামাল এক নবধারার শুভ প্রয়োগ ও সূচনা করেছেন এ দেশের চিত্রকলার জগতে। আর এ কারণেই জামাল তার সতীর্থ, চিত্রকলা প্রেমিক ও ছাত্রছাত্রীদের কাছে খুবই জনপ্রিয় নাম।
অধ্যাপক জামালের জনপ্রিয়তার মূল কারণ হচ্ছে তার উজ্জ্বল রঙের বৈচিত্র্যে সাধারণ খেটে খাওয়া মেহনতী মানুষের জীবন-যাপন ক্যানভাসে তুলে আনার নিপুণ দক্ষতায়। তার বিষয়বস্তুর প্রতিপাদ্যই হল মানুষের নানা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছবিতে তুলে ধরা এবং তা কতটা বাস্তবতা, নিপুণতা ও দক্ষতার সঙ্গে তুলে আনা যায় এটিই হল বিশেষজ্ঞ।
জামাল আহমেদ শুধু যে নর-নারীর আবার বা পশুপাখির নানা ভঙ্গি আঁকেন সেটি ভাবার কোনো কারণ নেই। মূলত এ আঁকার মধ্য দিয়েই তিনি মানুষের বিচিত্র মনোবিশ্লেষণ করেন। একজন মানুষ কি ভাবেন কি চিন্তা করেন কিংবা তার আচার-আচরণ মনোভঙ্গি কি তা একজন মনোবিজ্ঞানীর চোখ দিয়েই জামাল অবলোকন করেন গভীরতার সঙ্গে এবং তুলির মায়াবী স্পর্শে তুলে আনেন পরম মমতায় ও যত্নে। যা জীবন্ত- এবং কথা বলে। আর এ পারঙ্গমতাই জামালের ঐন্দ্রজালিক সার্থকতা। যা তাকে চিত্রকলার জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছতে সাহায্য করেছি। আসলে জামালের ছবিতে উদ্ভাসিত আবহমান বাংলার নানা বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি ও মানুষের জীবনযাত্রা। যেমন, জামালের ক্যানভাসে উঠে এসেছে বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা নদীর দৃশ্যপট, নদীমাতৃক বর্ষাকাল, শীতের হিমেল কুয়াশা, দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ-সোনালি মাঠ ইত্যাদি। জামালের ছবিতে প্রায়শ বিভাসিত কলসি কাঁখে যৌবনবতী উন্মুখ নারী, কিংবা নানা ভঙ্গিমায় অপেক্ষমাণ নারীর কাতরতা- প্রিয় প্রেমিকার জন্য। যেমন, বাঙালির চিরস্মরণীয় পুরানকালের আরাধ্য রাধার অপেক্ষা কানাইয়ার জন্য। তেমনি তার ছবির একটি বিস্তৃত অবয়বজুড়ে আছে বাংলার বাউল ফকির- যারা এ বাস্তব পৃথিবীর মানুষ হয়েও যেনবা দার্শনিকতায় ভিন্ন ভুবনের বাসিন্দা।
একদা (২০১০) জাতীয় অধ্যাপক প্রয়াত কবীর চৌধুরী জামাল আহমেদের চিত্রকলার পটভূমি আলোচনায় বলেছিলেন, জামাল বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান চিত্রশিল্পী। তিনি তার গভীর অন্তদৃষ্টি থেকে অসাধারণ দক্ষতাপূর্ণ অংকন-শৈলী দিয়ে সততা ও সাহসের সঙ্গে স্বাতন্ত্র্যসূচক উচ্চতর গুণগত বৈশিষ্ট্যের পর্যায় পৌঁছেছে। বিশেষত তার অংকিত নারীর মনোভঙ্গিপূর্ণ অবয়ব- যা সততই উজ্জ্বল রঙের বিশিষ্টতায় ফুটে ওঠে তার প্রিয়সব চরিত্র-চিত্রণে। এবং লক্ষণীয় যে, যেখানে কখনও নারীর বেদনাবিধুর মুখাবয়ব, কখনও ভালোবাসার প্রতীক্ষমাণ আকুলতা, কখনও আনন্দ, আবার কখনও হতাশায় ক্লান্ত নারীর অস্ফুট হাহাকার! এবং প্রয়োজনীয় রঙের ব্যবহার- কখনও উজ্জ্বল আবার কখনও গাঢ় এর ব্যঞ্জন ক্যানভাসকে সত্যিকার মূর্ত প্রতীকে রূপায়িত করে। আর সহজবোধ্যতই চিত্র সবাইকে অনায়াসে আকর্ষণ করে। অপরদিকে আন্তর্জাতিক চিত্র সমালোচক প্রফেসর টনি কে. স্টিওয়ার্ট জামালের সঙ্গে তার কুড়ি বছরের দীর্ঘ সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে তার চিত্রকলা নিয়ে ২০১০-এ বিশদ আলোচনা করেছেন। সেখান থেকে সামান্য ভাবানুবাদ তুলে ধরলে দাঁড়ায় : জামালের সঙ্গে তার সুদীর্ঘ দুই দশকের আলাপ আলোচনায় উঠে এসেছে যে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন তার আত্মিক প্রেরণাদানকারী শিক্ষাগুরু। তার অর্থ এই নয় যে জয়নুলের ছবির অনুকরণ ও অনুসরণ। জামাল তার নবতর ধারায় অবদান রেখে চলেছেন।
তিনি এও বলেন, যেমন জামালের ছবিতে নারীর নানাভঙ্গি যেমন আছে তেমনি আছে বিস্তৃত পরিসরে বাংলার ফকির বাউল- যা তাকে বিশিষ্ট করে তুলেছে। প্রফেসর টনি আরও উল্লেখ করেন যে, জামালের বিষয়বস্তুর সঙ্গে জয়নুলের বিষয়বস্তুর মিল খুঁজে পেয়েও বলতে বাধ্য হন যে- জয়নুল পরবর্তী প্রজন্ম জামাল, যে কিনা জয়নুল থেকে স্বাতন্ত্র্যিক অভিযাত্রী। জয়নুলের গন্তব্য তার প্রয়াণের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত না হলেও জামালের গন্তব্য ভিন্ন ও আকাশ ছোঁয়া।