আমিনুল ইসলামের কবিতা
রহমান হেনরী
প্রকাশ: ২১ ডিসেম্বর ২০১৮, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সৃজনশীল রচনাকর্মের মধ্যে কবিতাই হল সেই রচনাকর্ম যা বহুমুখী ও বহুরূপী; সে জন্যই বলা হয়ে থাকে : কবিতা অনেক রকমের। কথাগুলো কবিতা সম্পর্কে সামগ্রিকভাবে যেমন সত্যি, তেমনি সত্যি কবি আমিনুল ইসলামের কবিতাগুলোর ক্ষেত্রেও।
গত শতাব্দীর ছয় দশকে বরেন্দ্র অঞ্চলে জন্মগ্রহণকারী কবি আমিনুল ইসলাম হয়তো লিখছেন আগে থেকেই, হয়তো আটের বা নয়ের দশক থেকে; কিন্তু পাঠক হিসেবে গ্রন্থাকারে তার কবিতা আমরা পড়েছি একুশ শতকের সূচনালগ্নে। পড়তে পড়তে টের পেয়েছি, জন্মলগ্ন থেকেই ভেতরে ভেতরে তিনি কবিতা পাকাচ্ছিলেন। প্রতিভাধর জাতকবিদের ক্ষেত্রে এটাই স্বাভাবিক। জন্ম শৈশব কৈশোর-যৌবনের ভেতর দিয়ে বেড়ে উঠতে থাকে নীরব এক কবি; তারপর সেই নীরবতা নিজের ভেতরে এক নৈঃশব্দ্যের জন্ম দিলে, শাদা কাগজের পৃষ্ঠায় সরব হয়ে ওঠে কবি। আমিনুল ইসলামের বেড়ে ওঠা সেই কবিজীবন কেমন ছিল, তার কবিতা পড়তে পড়তেই উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে সেই জীবনী। কবিতা যে কেবল ভারী ভারী আভিধানিক শব্দে বিশেষণবহুল জটিলতর পঙ্ক্তি গঠনের বাহাদুরিতে থেমে থাকেনি; বরং অন্তর ছোঁয়া সহজিয়ায় হৃদয় ও মস্তিষ্কে ঝাঁকুনি তুলে চিন্তন সৌন্দর্য ও সৌকর্যের মুখোমুখি পাঠককে দাঁড় করিয়ে দেয়ার এক নান্দনিক শিল্পশৈলী, এ কবির কিছু কিছু কবিতা সেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করে, তাকে একবিংশ শতাব্দীর বৈশ্বিক শিল্পাঙ্গনে অপরিহার্য কবি করে তুলেছে। কালের নন্দনতত্ত্ব বলছে, সহজ উপস্থাপন যখন ভাবনাবিভূতির প্রভাবে দীর্ঘস্থায়ী চিন্তন সৌন্দর্যের দার্শনিক অবকাঠামো নির্মাণ করে, তখনই সেটা কবিতা হয়ে ওঠে। শিল্পের এই করণকৌশলই একুশ শতকীয় কবিতার ভিত্তি। কবির ব্যক্তিগত অনুভব থেকে জন্ম নেয়া একটি প্রেমের কবিতা কীভাবে বৈশ্বিক চেতনা এবং যৌথতা ও সমন্বয় ভাবনার দার্শনিক উন্মেষ ঘটায়, সে বিষয়টির রসাস্বাদনে, এ কবির কবিতা থেকে খুবই সরল এক উদ্ধৃতি :
আমার পকেটে যা আছে তা দিয়ে
আমি একটি নদী কিনতে পারি
কিন্তু তাতেই খালি হয়ে যায় পকেট;
তোমার কাছে যা আছে তা দিয়ে তুমি একটা
পাহাড় কিনতে পারো-
কিন্তু তার বেশি কিছু নয়;
অতএব এসো, আমরা দুজনে মিলে
একটা পাহাড় এবং একটি নদী কিনে ফেলি;
নিরীহ। সরলে উপস্থাপিত এক জটিলতম সুন্দর। প্রথম পাঠেই মনে হবে সামগ্রিক উন্মোচনে ধরা পড়ল। কিন্তু যতবার পাঠ, ততবারই নতুন তার আচরণ। কোনো জটিলতা নেই, সারল্যের স্বচ্ছতায় উদ্ভাসিত এই সুন্দর। চিরচেনা, চিরজানা এবং সেই সুপরিচয়ের কারণেই চিরদিন অচেনা থেকে যাওয়ার সব সম্ভাবনাও জারি রইল; এমনই অন্তরমতী বিভা, কবি আমিনুল ইসলামের কবিতা।
তার কবিতা প্রধানত নিজস্ব ইতিহাস ও ঐতিহ্যবোধে অটল, অবিচল। জন্মস্থল, দেশ, ভাষা ও শিকড়ের সন্ধানই তার মুখ্য অন্বেষা। নিকট ও সুদূর এবং অতীত ও বর্তমানের ভেতর সমন্বয় প্রয়াসী এ কবি স্থিতধী হয়েছেন নিজস্ব নির্জনতার অমেয় ভূগোলে; যা তাকে একাধারে স্থানিক ও প্রকারান্তরে বৈশ্বিক করে তোলে। কবিতাগুলো তার বহুমুখী যাপন ও অভিজ্ঞতার নির্যাস, বিধায়, উপভোগ্য। আবির্ভাব লগ্নের কবিতাতেই কবি বলেছিলেন : উত্তরের হাওয়া এসে মাড়িয়ে যায়/ রাজধানীর কলাকেন্দ্র;
আর এখন তো ক্রমান্বয়ে, সেই হাওয়া ইস্তাম্বুলও মাড়িয়ে চলে যাচ্ছে ওশেনিয়ার দিকে!
চিন্তনবিভা এবং নতুনতর বাস্তবতার উদ্ভাবন বা উদ্ঘাটন ছাড়া কবিতা আর কিছুই নয়; আর এর ভাষা যতটা হৃদয়গ্রাহী হয় বা সহজবোধ্যতা পায়, ততই ভালো। কবিতাভাষার নান্দনিকতা ভাষাতাত্ত্বিক উৎকর্ষের ভেতরে নয়; বরং উদ্ঘাটিত উপলব্ধি, প্রতিসত্য এবং প্রতিবাস্তবতার আকস্মিক হোঁচটের মধ্যেই নিহিত; অর্থাৎ চিন্তার সৌন্দর্যই কবিতার সৌন্দর্য। কবিতা একটি ইশারাভাষা, যা উদ্ভাবিত কল্পনা ও নান্দনিক মিথ্যার ভেতর দিয়ে যাত্রা শুরু করে এবং নবতর উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতার উদ্ঘাটনের মাধ্যমে পৌঁছে যায় : সত্যের সবচেয়ে নিকটতম বিন্দুতে। কবিমাত্রেই ইশারাভাষী গল্পকথক (storyteller), যিনি শুধু সূত্র ও ইঙ্গিত তুলে ধরেন, গল্পটা বানিয়ে নিতে হয় রসগ্রাহী পাঠককেই। কবিতা বিষয়ক এসব সত্য ও উপলব্ধিকেই উচ্চকিত করে আমিনুল ইসলামের কবিতা।