বরিশালে ১০ কোটি টাকার পুকুর দখল বিএনপি নেত্রী শিরিনের
জনগণের নামে লিখে দেওয়া ১০ কোটি টাকা মূল্যের পুকুর দখলের অভিযোগ উঠেছে সংরক্ষিত নারী আসনের সাবেক এমপি বিএনপি নেত্রী বিলকিস জাহান শিরিন ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে।
টানা ৪ রাত ট্রাক ভরে বালু এনে ভরাট করা হয় পুকুরটি। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সুযোগে এই দখল, বলছেন নগরীর ব্রাউন কম্পাউন্ড এলাকার বাসিন্দারা।
একই অভিযোগ বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনসহ (বাপা) বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাদের। তবে দখলের অভিযোগ স্বীকার করেননি বরিশালের দায়িত্বে থাকা বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শিরিন।
দখল সম্পর্কে কিছুই জানেন না বলার পাশাপাশি ওই সম্পত্তি তাদের পৈতৃক বলে দাবি করেন তিনি। নিজস্ব সম্পত্তি হলেও পুকুর ভরাটের ক্ষেত্রে সরকারি যেসব আইন মানতে হয় তা মানা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে অবশ্য সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে বরিশালে ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ছিলেন পর্তুগিজ নাগরিক এমটি ব্রাউন। তৎকালীন বরিশালের বিশাল একটি এলাকা কেনেন তিনি। কালক্রমে ওই এলাকার নাম হয় ব্রাউন কম্পাউন্ড। ১৯২২ সালে সেখানে থাকা তিনটি পুকুর জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত ঘোষণা ও দলিল করে দেন তার স্ত্রী মিসেস ব্রাউন।
এরপর থেকেই পুকুরগুলো ব্যবহার করে আসছেন ব্রাউন কম্পাউন্ড এলাকার বাসিন্দারা। এরই একটি পুকুর গত বছরের মে মাসে হঠাৎ ভরাট শুরু করেন বিএনপি নেত্রী শিরিন ও তার পরিবার। বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় হলে ঘটনাস্থলে গিয়ে বাধা দেয় বাপা ও বেলাসহ বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারা। পরিবেশ অধিদপ্তর ও সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারাও যান সেখানে।
অবৈধভাবে পুকুর ভরাটের প্রমাণ পেয়ে সেখানে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে একটি সাইনবোর্ড টানায় সিটি করপোরেশন। একই সঙ্গে বিলকিস জাহান শিরিন ও তার পরিবারের সদস্যসহ মোট সাতজনকে একটি সতর্কীকরণ নোটিশ দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর।
নোটিশে অবৈধভাবে পুকুর ভরাটের প্রমাণ পাওয়ার উল্লেখের পাশাপাশি যে বালু ফেলা হয়েছে তা অপসারণ ও দখলমুক্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়। অন্যথায় সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা করার হুঁশিয়ারি দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর। ওই নোটিশের পর বালু ভরাট ও দখল প্রক্রিয়া বন্ধ হলেও অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী পুকুরে ফেলা বালু অপসারণ করেননি অভিযুক্ত সাতজন।
নাম পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বরিশাল নগর ভবনের সম্পদ বিভাগের দায়িত্বে থাকা এক কর্মকর্তা বলেন, ‘গত বছরের মে মাসে পুকুর ভরাট শুরু হওয়ার পর ঘটনাস্থলে গিয়ে বাধা দেই। একই সঙ্গে নগর ভবনে থাকা দলিল দস্তাবেজ ঘেঁটে দেখা যায়, জায়গাটি পুকুর হিসাবেই রয়েছে ম্যাপে।
তিনি বলেন, সিএস, আরএস ও এসএ-তেও একই তথ্য। যতদূর দলিল দস্তাবেজ দেখেছি তাতে পুকুরটি মিসেস ব্রাউন জনস্বার্থে দলিল করে দান করে গেছেন। পুকুর ভরাট করা যাবে না মর্মে একটি নোটিশও সেখানে লাগিয়ে দিয়ে আসি। গত দু’দিন ধরে শুনছি সেটি নাকি আবার ভরাট করা হচ্ছে।
কিন্তু বর্তমান যে পরিস্থিতি, আমাদের মেয়রও আত্মগোপনে। ফলে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছি না। তবে মুখ্য কর্মকর্তা যদি নির্দেশ দেন অবশ্যই সেখানে গিয়ে বাধা দিতে পারব। এস্টেট বিভাগের এই কর্মকর্তার কথার প্রমাণ মেলে ব্রাউন কম্পাউন্ড এলাকায় গিয়ে।
শনিবার সকালে গিয়ে দেখা যায় রুদ্ধশ্বাস দশা পুকুরটির। প্রায় পুরোটাই ভরাট হয়ে গেছে কয়েকশ’ বছরের পুরোনো জলাশয়টির।
বিএনপি নেত্রী শিরিনের ভয়ে নাম পরিচয় না প্রকাশের শর্তে স্থানীয় বেশ কয়েকজন বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে ৫ আগস্ট যখন দেশব্যাপী আনন্দ-উচ্ছ্বাস, ঠিক সেই মুহূর্তে রাতের অন্ধকারে শুরু হয় প্রায় ২৫ শতাংশ জায়গা জুড়ে থাকা পুকুর ভরাট। শিরিনের ছোট ভাই শহিদুল ইসলাম শামিম নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তত্ত্বাবধান করেন ভরাট কার্যক্রম। ভেঙে ফেলা হয় ভরাট বন্ধে নগর ভবনের লাগানো সাইনবোর্ড। এর আগে যখন ভরাটের চেষ্টা হয় তখন সবাই মিলে বাধা দিয়েছে এলাকাবাসী। কিন্তু এখন তো ভিন্ন পরিস্থিতি। অভিযোগ যে করব সে জায়গাটিও নেই। কারণ, পুলিশ নেই থানায়।
তাছাড়া শিরিন যেহেতু বিএনপির প্রভাবশালী নেতা তাই আর সাহস করে সামনে যায়নি কেউ।’ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক সুজয় শুভ বলেন, ‘অবৈধভাবে পুকুর ভরাটের বিষয়টি জানতে পেরে ভরাটকারীদের সঙ্গে কথা বলেছি। পুকুর ভরাটে নিষেধও করা হয়েছে। তার পরও তারা কিভাবে ভরাট করল দেখব আমরা।’
জনগণের নামে দান করা পুকুর ভরাট সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) বরিশালের সমন্বয়কারী রফিকুল আলম বলেন, ‘গত বছর যখন ভরাট শুরু হয় তখন সবাই সম্মিলিতভাবে বাধা দিয়েছি। কিন্তু এবার তো ভিন্ন পরিস্থিতি।
পুকুরটির মালিকানা দাবি করা পরিবারটি বিএনপি নেত্রী শিরিনের। তাদের বিরুদ্ধে এখন কেউ দাঁড়াতে চাইবে না। এর পরও আপনারা যদি পত্রিকায় নিউজ করেন তাহলে আমরা দাঁড়াতে পারি।’
প্রায় একই কথা বলেন নদী খাল বাঁচাও আন্দোলন বরিশালের সদস্য সচিব কাজী এনায়েত হোসেন শিপলুসহ বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারা। ব্রাউন কম্পাউন্ড এলাকার একাধিক বাসিন্দা বলেন, ‘মূল্যমান অনুযায়ী পুকুরে থাকা জমির বর্তমান দর কম করে হলেও ১০ কোটি টাকা। আর এজন্যই সুযোগ বুঝে সেটি দখলে নিয়েছে শিরিনের পরিবার।’
পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক ইকবাল হোসেন বলেন, ‘মালিকানা যদি তাদেরও হয় তবু পুকুর-জলাশয় ভরাটের একটি আইনি বিধান রয়েছে। যেটা এক্ষেত্রে মানা হয়নি। আমরা যত দ্রুত সম্ভব এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেব।’ বরিশালের জেলা প্রশাসক শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা সেখানে লোক পাঠাব। অভিযোগ সত্য হলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপি নেত্রী শিরিন বলেন, ‘পুকুরটি আমার বাপদাদার সম্পত্তি। ওটার খাজনাও দেই আমরা। জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য দান করার বিষয়টি সত্য নয়। তবে পুকুর ভরাটে আমি বা আমার পরিবারের কেউ জড়িত নই। ওই পুকুরসহ সংশ্লিষ্ট এলাকার জমির মালিক ২১ জন। তাদের কেউ হয়তো সেটি ভরাট করেছে। আমাকে বিতর্কিত করার জন্য কেউ এসব অপ-প্রচার চালাচ্ছে।
তাছাড়া সেখানে মেয়ে হিসেবে আমার যেটুকু জমি আছে তার জন্য আমি নিশ্চয়ই ভাবমূর্তি হারানোর ঝুঁকি নেব না।’ আপনার ছোট ভাই নিজে দাঁড়িয়ে থেকে পুকুর ভরাট তত্ত্বাবধান করেছে উল্লেখ করলে তিনি বলেন, ‘এমনও তো হতে পারে যে, সে দেখতে গিয়েছিল।’
যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া পুকুর-জলাশয় ভরাট করা যায় না, ভরাটের কোনো অনুমোদন আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি তো ভরাট করিনি। যারা করেছে তাদের কাছে জিজ্ঞেস করুন।’