চাঞ্চল্যকর কোকেন উদ্ধার মামলা
চট্টগ্রামে ব্যবসায়ী দুই ভাইকে ফাঁসিয়েছিলেন বেনজীর
চট্টগ্রাম ব্যুরো
প্রকাশ: ০৮ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
চট্টগ্রামে চাঞ্চল্যকর কোকেন উদ্ধার মামলায় ব্যবসায়ী দুই ভাইকে ফাঁসিয়েছিলেন পুলিশের আলোচিত সাবেক আইজি বেনজীর আহমেদ। র্যাবের ডিজি থাকা অবস্থায় তদন্তভার পাওয়ার পর বেনজীর তারই শিষ্যকে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মহিউদ্দিন ফারুকীকে এ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ করেন। ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেছেন, আকারে-ইঙ্গিতে নানা মাধ্যমে পরোক্ষভাবে তাদের কাছে বড় অঙ্কের ‘ঘুস’ দাবি করা হয়েছিল। সেই চাহিদা না মেটানোর কারণেই খানজাহান আলী গ্রুপের চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ ও তার ভাই মোশতাক আহমেদকে এ মামলায় জড়িয়েছিলেন বেনজীর।
এ মামলায় জড়িয়েই অনেকটা তছনছ হওয়ার পথে সরকারকে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব পরিশোধকারী খাতুনগঞ্জের বনেদি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খানজাহান আলী গ্রুপ ও চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদের পরিবার।
২০১৫ সালের ৭ জুন চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি ইয়ার্ডে সন্দেহজনক চালানের একটি কনটেইনার জব্দ করা হয়। এতে ১০৭টি প্লাস্টিকের ড্রামভর্তি সানফ্লাওয়ার তেল পাওয়া যায়। এ তেলের মধ্যে মিশিয়ে কোকেন আনা হয়েছে বলে গোয়েন্দা সংস্থার কাছে তথ্য ছিল। রাসায়নিক পরীক্ষায় তেলে কোকেনের অস্তিত্ব রয়েছে বলে রিপোর্ট আসে। এ ঘটনায় বন্দর থানায় মামলা করে পুলিশ। এতে খানজাহান আলী গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান প্রাইম শ্রিম্প হ্যাচারির ম্যানেজার গোলাম মোস্তফা সোহেল ও গ্রুপের চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদসহ অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করা হয়। এদিকে কনটেইনার জব্দের দিনই ‘আমদানিকারক’ হিসাবে খানজাহান আলী গ্রুপকে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক হোসাইন আহমদ একটি চিঠি দেন। চিঠির জবাবে গ্রুপের চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ জনান, ‘তাদের গ্রুপ তেল আমদানির কোনো এলসি করেনি। চালান ছাড় করার জন্য কোনো ডকুমেন্টও জমা দেয়নি। নিয়োগ করেনি সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট। সুষ্ঠু তদন্ত করে তিনি জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানান। পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রপ্রধান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশপ্রধান, গোয়েন্দা সংস্থা প্রধানসহ সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরে চিঠি দেন নুর মোহাম্মদ। এই চালানের সঙ্গে তাদের গ্রুপকে জড়ানোয় শিপিং কোম্পানিসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ১০০ কোটি টাকার মানহানির মামলাও করা হয়।
চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার মোহাম্মদ কামরুজ্জামান মামলাটি তদন্ত করেন। আসামিদের জিজ্ঞাবাদ ও তদন্তসহ সামগ্রিক বিষয় অনুসন্ধানে নগর গোয়েন্দা পুলিশের তৎকালীন উপকমিশনার কুসুম দেওয়ানের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করা হয়। দীর্ঘ তদন্ত শেষে ৮ জনকে আসামি করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা। প্রাইম শ্রিম্প হ্যাচারির ম্যানেজার গোলাম মোস্তফা সোহেল ছাড়াও মোস্তফা কামাল, মো. মেহেদী আলম, আতিকুর রহমান, মো. সাইফুল ইসলাম, একেএম আজাদ, লন্ডন প্রবাসী ফজলুর রহমান ও বকুল মিয়াকে আসামি করা হয়। এর মধ্যে প্রথম ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়। গোলাম মোস্তফা সোহেল কোম্পানির অগোচরে চোরাকারবারিদের সঙ্গে যোগসাজশ করে চালানটি বলিভিয়া থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে নিয়ে আসে বলে তদন্তে বের হয়ে আসে। তদন্তে জানা যায়, আলোচ্য তেলের চালান আমদানির জন্য খানজাহান আলী গ্রুপ কোনো এলসি খোলেনি, বিএল (বিল অব লেডিং) জমা দেয়নি। কোনো সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট নিয়োগ করেনি। চোরাকারবারিরা নিজেদের স্বার্থেই এই গ্রুপের নাম ব্যবহার করে কোকেনের মতো স্পর্শকাতর চালান চট্টগ্রাম বন্দরে নিয়ে এসেছে। এতে ব্যবহার করা হয়েছে কোম্পানির অঙ্গপ্রতিষ্ঠান প্রাইম শ্রিম্প হ্যাচারির কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফাকে। তদন্তে সম্পৃক্ততা না পাওয়ায় খানজাহান আলী গ্রুপের চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদকে চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়া হয়। ২০১৫ সালের ১১ নভেম্বর আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়। সাবেক মহানগর পিপি ফখরুদ্দিন চৌধুরী মামলার সাক্ষ্যস্মারকে একমত পোষণ করেন।
সূত্র জানায়, আদালত চার্জশিট গ্রহণ না করে মামলাটি অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন র্যাবকে। নির্দেশ পাওয়ার পর র্যাবের তৎকালীন মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ এ মামলার তদন্তের জন্য তারই ঘনিষ্ঠ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মহিউদ্দিন ফারুকীকে তদন্ত কর্মকর্তা নিযুক্ত করেন। দায়িত্ব পাওয়ার পর ২০১৬ সালের ১৪ জানুয়ারি তদন্তে সহায়তার কথা বলে ডেকে নিয়ে নুর মোহাম্মদকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠান। এ মামলার পূর্ববর্তী চার্জশিটে থাকা ৮ জনের পাশপাশি নুর মোহাম্মদ ও তার ভাই মোশতাক আহমেদকে আসামি করে ১০ জনের বিরুদ্ধে সম্পূরক চার্জশিট জমা দেন। মামলাটি বর্তমানে চট্টগ্রাম মহানগর ৪র্থ অতিরিক্ত দায়রা জজ শরীফুল আলম ভুঁইয়ার আদালতে বিচারাধীন আছে। সাবেক চট্টগ্রাম মহানগর পিপি অ্যাডভোকেট আবদুস সাত্তার যুগান্তরকে বলেন, ‘আলোচ্য মামলার চার্জশিটে অনেক ত্রুটি রয়েছে। একটি স্পর্শকতার মামলায় কোনো তথ্যপ্রমাণ ছাড়া ঠুনকো অজুহাতে দুই ভাইকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার ঘটনাটি ছিল উদ্দেশ্যমূলক।’ একটি বিদেশি ব্যাংকে কর্মরত নুর মোহাম্মদের কন্যা মাদিহা নুর যুগান্তরকে বলেন, ‘র্যাবের হাতে নতুন করে মামলার তদন্তভার যাওয়ার পর সবকিছু ওলটপালট হয়ে যায়। র্যাবের তৎকালীন মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদের নির্দেশে আমার বাবাকে ডেকে নিয়ে গ্রেফতার এবং পরে তার বিরুদ্ধে চার্জশিট দেন তারই শিষ্য মহিউদ্দিন ফারুকী। তিনি অভিযোগ করেন, ‘বেনজীর আহমেদ নানা মাধ্যমে পরোক্ষভাবে আমাদের পরিবারের কাছে বড় অঙ্কের ঘুস দাবি করেছিলেন। সেই দাবি পূরণ না করার কারণেই জড়িত না থাকা সত্ত্বেও কোকেন মামলায় আমার বাবা ও চাচাকে ফাঁসিয়ে দেন।’