বীজ সংকট, সারের মূল্যবৃদ্ধি, সহায়তা হ্রাস
পাটচাষে আগ্রহ কমছে কৃষকের
পাটচাষিদের প্রণোদনা বা ভর্তুকি গত বছরের চেয়ে কমেছে ৬১ লাখ টাকা * প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিলে দেশেই উন্নতমানের বীজ উৎপাদন করা সম্ভব

আমিরুল ইসলাম
প্রকাশ: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বীজ সংকট, সারের মূল্যবৃদ্ধি এবং সরকারি ভর্তুকি কমানোর ফলে কৃষক পাটচাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। অথচ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে পাট ফসলের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনা হবে। পাটচাষ বা উৎপাদন আগের জায়গায় নিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু পাটচাষিদের প্রণোদনা বা ভর্তুকি কমানো হচ্ছে। গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছর পাটচাষে প্রণোদনা বা ভর্তুকি কমানো হয়েছে ৬১ লাখ টাকা। পাটের উন্নত বীজও দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ উৎপাদন হয় না। ফলে আমাদনি করতে হয় পাটবীজ। যদিও বাংলাদেশের আবহাওয়া পাট উৎপাদনের উপযোগী। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিলে দেশেই উন্নতমানের বীজ উৎপাদন করা সম্ভব বলে অভিমত দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা যায়, গত বছর সরকার পাটচাষিদের ভর্তুকি দিয়েছে ৮ কোটি ৪৯ লাখ ৯ হাজার ১৫ টাকা। প্রত্যেক পাটচাষি ২৫২ টাকা করে প্রণোদনা বা ভর্তুকি পেয়েছেন। চলতি অর্থবছর সরকার পাটচাষিদের জন্য ৭ কোটি ৪৯ লাখ টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছে, যা দেশের ৩ লাখ ৩৬ হাজার ৬০০ জন প্রান্তিক কৃষকের মধ্যে বিতরণ করা হবে। প্রত্যেক পাটচাষিকে এক বিঘা জমি চাষের জন্য বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউশনের (বিজেআরআই) এক কেজি তোষাপাট-৮ (রবি-১) জাতের বিএডিসির বীজ দেওয়া হবে। এ বছর প্রত্যেক পাটচাষি পাবেন ২২২ টাকা করে।
এছাড়া পাটচাষিরা পাটের ন্যায্যমূল্য পান না। পাট যখন কৃষকের ঘরে থাকে, তখন ব্যবসায়ীরা একাট্টা হয়ে পাট কেনা বন্ধ করে দেন। তখন পাটের দাম একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকে। এ সুযোগে একশ্রেণির ব্যবসায়ী কম দামে কৃষকের পাট ক্রয় করে। কৃষক যখন অভাব-অনাটনে পাট বিক্রি করে দেন, তখন পাটের দাম বেড়ে যায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উপকরণ) শাহ মো. হেলাল উদ্দীন যুগান্তরকে বলেন, আগের চেয়ে ভর্তুকি বা প্রণোদনা কমেছে, তবে তাতে পাটচাষে প্রভাব পড়বে বলে মনে করি না। কারণ, আমরা পাটচাষিদের এক বিঘা জমির জন্য এক কেজি করে উন্নত মানের বীজ দিচ্ছি। তাছাড়া সরকারি বরাদ্দের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। দেশে প্রণোদনার বাইরে কোনো কৃষক আছে কি না, তা তিনি জানেন না। এক প্রশ্নের জবাবে অতিরিক্ত সচিব বলেন, পাটের বাজারজাতকরণটা এখনো যেভাবে হওয়ার, সেভাবে হয়নি। বিষয়টি দেখভাল করছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়।
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত সব পাটকল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সরকারিভাবে আগের মতো আর পাট কেনা হয় না। এখন দেশে পাটের একমাত্র ক্রেতা বেসরকারি পাটকল মালিকরা। তারাও পাটচাষি কৃষকদের তেমন একটা মূল্যায়ন করেন না। দিতে চান না ন্যায্যমূল্য। এ অবস্থায় ‘মাথার ঘাম পায়ে ফেলে’ উৎপাদিত পাট নিয়ে বিপাকে পড়েন কৃষক। ১০ বছরের মধ্যে গত মৌসুমে পাটের দাম কম। ওই সময় প্রতি মন পাট ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এর আগের বছরও প্রতি মন পাট ২ হাজার ৪০০ টাকা থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। বাড়তি দামের আশায় যেসব কৃষক গত বছর পাট সংরক্ষণ করেছেন, তারা আরও বড় ধরনের লোকসানে পড়েছেন। তবে বর্তমানে পাটের দাম অনেক বেশি। প্রতি মন পাট ৩ হাজার টাকার বেশি। কিন্তু এখন তো পাট কৃষকের হাতে নেই।
বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএ) সভাপতি মো. ফরহাদ আহমেদ আকন্দ মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, পাটচাষ না হলে পাটজাত পণ্য উৎপাদনের কাঁচামাল কোত্থকে আসবে। সুতরাং পাটচাষিদের পর্যাপ্ত ভর্তুকি দেওয়া সরকারের দায়িত্ব। সরকার গত বছরের তুলনায় ৬১ লাখ টাকা ভর্তুকি কমিয়েছে উল্লেখ করে বিজেএ-এর সভাপতি আরও বলেন, বীজের দাম বেড়েছে, বেড়েছে সারের দামও; অথচ সরকার ভর্তুকি কমিয়েছে। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
বিজেএ-এর একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, যে পরিমাণ পাট দেশে উৎপাদন হয়, তার ন্যায্যমূল্য থেকে কৃষক বঞ্চিত। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত উৎপাদনের ৮০ থেকে ৯০ ভাগ পাটজাত পণ্য এবং দ্রব্য নিজেরা ব্যবহার করে। অথচ বাংলাদেশ উৎপাদনের ৯০ ভাগ বিদেশে রপ্তানি করে। পাট শুধু রপ্তানি পণ্য হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে কোনো কারণে সংকট হলে তার ধাক্কা গিয়ে কৃষকের গায়ে লাগে।
তিনি আরও জানান, ইউরোপ ও আফ্রিকার বাজারে পাটজাত দ্রব্যের বিপুল চাহিদা ছিল। বিশ্বজুড়ে বিরাজমান মহামন্দায় সেখানে এখন চাহিদা কমে গেছে। পাকিস্তান ডলার সংকটের কারণে পাটজাত পণ্য নিতে পারছে না। তাছাড়া বিশ্বমানের পাটজাত পণ্য উৎপাদনে বেসরকারি পাটকলগুলোর সক্ষমতার অভাব রয়েছে। বিরাজমান বাস্তবতায় সরকারকে এ খাতের কৃষক, রপ্তানিকারক, ব্যবসায়ী ও মিলমালিকদের পাশে দাঁড়াতে হবে।
পাট গবেষণা অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশের পাটের আঁশের মান পৃথিবীর অন্যান্য পাট উৎপাদনকারী দেশের চেয়ে অনেক ভালো। উৎপাদনের দিক থেকে ভারতের পরেই দ্বিতীয় অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। পাট রপ্তানির ক্ষেত্রে বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম। বাংলাদেশের পাটের খ্যাতি এখনো বিশ্বজোড়া। বর্তমানে বিশ্বে পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিশ্ববাজারে পাটের চাহিদা এখনো রয়েছে। বিশ্ববাজারের চাহিদা কাজে লাগিয়ে উৎপাদন অব্যাহত রাখার পরিবর্তে সরকারি পাটকলগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
তারা আরও জানান, পাটের বাজার বেসরকারি মিলমালিকরা নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা যে মূল্য বলবে, এর বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে সরকারি মিল চালু থাকলে এবং সরকারি মিলের জন্য পাট ক্রয় করা হলে বাজারে ভারসাম্য থাকত। এখন সেই ভারসাম্যটাও নেই।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে বিপুল পরিমাণ পাট উৎপাদন হয়, অথচ দেশের পাটজাত দ্রব্য ব্যবহারে কারও আগ্রহ নেই। পাটজাত দ্রব্যের স্থান দখল করেছে পলিথিন। নিজেদের উৎপাদন যদি দেশে ব্যবহার না করা হয়, বিপুল পরিমাণ পাট নিয়ে কৃষককে বিপাকে পড়তেই হবে। এক্ষেত্রে পলিথিনের দৌরাত্ম্য কমালে পাটজাত পণ্যের চাহিদা বাড়বে।
পাট অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, কাঁচা পাট এবং পাটের সুতা ভারতে চলে যাচ্ছে। কারণ, তাদের চাহিদা বেশি। তারা আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা করে। ভারতের সিংহভাগ পাটকল বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়। তারা বিশ্বমানের পাটজাত পণ্য উৎপাদন করে। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হলেও ভারতে জাতীয় পাট কমিশন (জাতীয় জুট কমিশন) রয়েছে। জুট কমিশন ঠিক করে দেয় কোন মিল কত পরিমাণ পাটজাত দ্রব্য উৎপাদন করবে। বিপরীত দিকে বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নেই বলে দাবি করেন তারা।