কেজি ২০০-২৪০ টাকা দরেই বিক্রি
পেঁয়াজ কেনা থেকে মুখ ফেরাচ্ছেন ভোক্তা
এখনো অস্থির পেঁয়াজের বাজার। রোববার নতুন করে দাম না বাড়লেও খুচরা বাজারে প্রতি কেজি ২০০-২৪০ টাকা মূল্য হাঁকানো হচ্ছে। ফলে ক্রেতাশূন্য হয়ে পড়েছে পেঁয়াজের বাজার। পরিস্থিতি এমন-সামর্থ্য না থাকায় অনেক ক্রেতা পেঁয়াজ কিনতে পারছেন না। আবার অনেকেই অসাধু ব্যবসায়ীর প্রতি নীরব প্রতিবাদে পেঁয়াজ কেনা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। রোববার রাজধানীর একাধিক খুচরা বাজার ঘুরে ক্রেতা ও বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
এদিকে পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে সিন্ডিকেটের কারসাজিতে জড়িত কয়েক ডজন ব্যবসায়ীর নাম পেয়েছে জেলা প্রশাসন। ওই চক্রের সদস্যরা ‘ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করলে দেশে এর দাম কেজিপ্রতি ৩০০ টাকায় উঠবে’-এমন গুজব ছড়িয়ে দেয়। এরপর শুরু হয় পেঁয়াজ নিয়ে লঙ্কাকাণ্ড। ফলে ঘণ্টায় ঘণ্টায় বাড়তে থাকে পেঁয়াজের দাম। বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভারত রপ্তানি বন্ধ করলেও এ মুহূর্তে দেশে পেঁয়াজের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। কারণ, দেশে চলতি বছরে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে। আমদানিও হয়েছে অনেক। সঙ্গে বাজারে নতুন মুড়িকাটা পেঁয়াজ উঠতে শুরু করেছে। আর সরবরাহও পর্যাপ্ত। তাই দাম বাড়া একেবারেই অযৌক্তিক।
এদিকে পেঁয়াজের মূল্য নিয়েন্ত্রণে বাজার তদারকি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসনসহ একাধিক তদারকি সংস্থা সারা দেশে অভিযান পরিচালনা করছে। সরকারি সংস্থা টিসিবির পক্ষ থেকে কেজিপ্রতি ৫০ টাকা করে বিক্রি করা হচ্ছে। পাশাপাশি মূল্য নিয়ন্ত্রণে মাঠে গোয়েন্দা পুলিশ নামানো হয়েছে। এ সময় কোনো অনিয়ম পেলে কঠোর শাস্তির হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। আর ভারত থেকে আগের এলসি করা ১ হাজার ৩৪৩ টন পেঁয়াজ দেশে এসেছে। এরপরও ভোক্তার লাভের লাভ কিছুই হচ্ছে না।
রোববার রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ২২০-২৪০ টাকা, যা শনিবার একই দাম ছিল। তবে বৃহস্পতিবার বিক্রি হয়েছে ১৩০ টাকা। পাশাপাশি প্রতি কেজি আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ২০০-২২০ টাকা, যা শনিবার একই দাম ছিল। আর বৃহস্পতিবার বিক্রি হয়েছে ১১০ টাকা।
সকাল ১০টা। রাজধানীর নয়াবাজারে নিত্যপণ্য কিনতে এসেছেন সহিদুল ইসলাম। তার সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে কোনো ধরনের নৈতিকতা নেই। যে পেঁয়াজ বৃহস্পতিবার ১২০-১৩০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, সেই একই পেঁয়াজের দাম বিক্রেতারা ২৩০ টাকা চাইছেন। তাই আমি পেঁয়াজ না কিনে বাড়িতে ফিরছি। দাম না কমলে এখন আর পেঁয়াজ কিনব না। কারণ, কয়েকদিন পর দেশি পেঁয়াজ পুরোদমে বাজারে উঠবে। তখন কিনব। এটা অসাধু ব্যবসায়ীদের প্রতি আমার নীরব প্রতিবাদ। তিনি জানান, দেশের সরকারসংশ্লিষ্টরা দৃশ্যমান কোনো ভূমিকা নিচ্ছে না। বাজারে অভিযান পরিচালনা করে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই বাড়তি দরেই বিক্রি করছে। তাই আমরা ভোক্তারা পেঁয়াজ কেনা থেকে বিরত থাকলে ব্যবসায়ীরা দিশেহারা হয়ে পড়বে।
দুপুর ১টা। রাজধানীর কাওরান বাজারে পেঁয়াজ কিনতে আসেন হেলেনা বেগম। তিনি পেঁয়াজ বিক্রেতার কাছে দাম জানতে চাইলে দেশি পেঁয়াজের কেজি ২৩০ টাকা বলেন। সেসময় তিনি বিক্রেতাকে বলেন, আপনার পেঁয়াজ আপনি রেখে দেন। আমরা কিনব না। এ সময় তার সঙ্গে কথা বললে তিনি যুগান্তরকে বলেন, আমি দাম কমার আগ পর্যন্ত পেঁয়াজ কিনব না। এটা আমার প্রতিবাদ। এ সময় তিনি অন্য ক্রেতাদেরও পেঁয়াজ কেনা থেকে বিরত থাকতে বলেন।
কাওরান বাজারের খুচরা বিক্রেতা মো. মামুন বলেন, কাল ক্রেতা ছিল। আর রোববার কোনো ক্রেতা নেই। দাম বাড়ার কারণে ক্রেতারা পেঁয়াজ কিনছেন না। তিনি বলেন, আমরা পাইকারি বাজার থেকে কিনে এনে বিক্রি করি। সেখানে দাম বাড়তি থাকলে খুচরা বাজারেও বাড়ে। এখানে আমাদের কোনো হাত নেই। কিন্তু ভারত রপ্তানি বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে দাম কেন বাড়ালেন জানতে চাইলে তিনি যুগান্তরকে বলেন, এটা ব্যবসায়ীদের ধর্ম। অন্য ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে বিক্রি করেছে, তাই আমিও মূল্য বাড়িয়ে বিক্রি করেছি। তবে এটা আমার ঠিক হয়নি। রোববার রাজধানীর আগারগাঁও রাজস্ব ভবনে ভ্যাট দিবসের অনুষ্ঠানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, ভারত রপ্তানি বন্ধের একদিনের ব্যবধানে কেজিপ্রতি পেঁয়াজের দাম ৮০ টাকা বৃদ্ধি একবারেই অনৈতিক। নিত্যপণ্যের সংকট তৈরি হলেই অনেক ব্যবসায়ী এর সুযোগ নিয়ে থাকেন। ভারত পেঁয়াজ রপ্তানিতে শর্তারোপের পর একদিনেই হঠাৎ দাম ৭০-৮০ টাকা বেড়ে গেছে। এটা অবশ্যই দায়িত্বশীল আচরণ নয়। ব্যবসায়ীদের বুঝতে হবে দেশের জনগণের জন্যই ব্যবসা। ভারত রপ্তানি বন্ধের মাত্র ঘোষণা দিয়েছে, এ কারণে পরের দিনই দাম বাড়তে পাড়ে না। দাম বাড়তে তো সময় লাগার কথা।
একই দিন এক সংবাদ সম্মেলনে পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক টিম চকবাজার ও শ্যামবাজার এলাকায় মাঠে নেমেছে জানিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন- অর-রশীদ বলেন, বাজারে চড়া দামে পেঁয়াজ বিক্রি এবং সেই সঙ্গে এ পণ্যটি মজুত ও কালোবাজারি করা হলে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ ঘোষণার আগে যেসব এলসি করা হয়েছে, সেই পেঁয়াজ দেশে আসতে কোনো বাধা নেই। চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরে ভারত থেকে ৩৫ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ২০ হাজার টন চলে এসেছে। আরও ১৫ হাজার টন আসার অপেক্ষায় রয়েছে। এদিকে বৃহস্পতিবার ভারত রপ্তানি বন্ধের ঘোষণার পর শনিবার দেশের দুটি স্থলবন্দর দিয়ে ১৩৪৩ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে, যা আগের এলসি খোলা। এসব পেঁয়াজ দেশের বাজারেও চলে এসেছে। শনিবার চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ স্থলবন্দর ও সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে ৪৬টি ট্রাকে ওই পেঁয়াজ আনা হয়। সূত্র জানায়, আগের এলসি করা ৭৪৩ মেট্রিক টন পেঁয়াজ সোনামসজিদ স্থলবন্দর দিয়ে ২৬টি ট্রাকে দেশে আনা হয়েছে। দেশে আসা প্রতি মেট্রিক টন পেঁয়াজ ৮০০ ডলারে ক্রয় করা। সোনামসজিদ স্থলবন্দরের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ভারতের লোড করা আরও বেশ কিছু ট্রাক বন্দরে প্রবেশের অপেক্ষায় আছে।
পেঁয়াজ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান প্যানামা পোর্ট লিংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপক মো. কামাল হোসেন বলেন, ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের চিঠি আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো আমরা হাতে পাইনি। তবে দুপুর থেকে ভারতের ওপারে মহদিপুর থেকে বেশ কয়েকটি পেঁয়াজের ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ভারতের মহদিপুর সিএন্ডএফ এবং একাধিক রপ্তানিকারক জানিয়েছেন, আগের ৮০০ ডলারে এলসি করা টেন্ডারের পেঁয়াজের ট্রাক দেশে আসবে।
পাশাপাশি ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে এসেছে ৬০০ টন পেঁয়াজ। সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে ২০টি ট্রাকে এই পেঁয়াজ দেশে আনা হয়েছে। ভোমরা সিএন্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কাজী নওশাদ দিলওয়ার রাজু বলেন, বৃহস্পতিবার যেসব ট্রাকের কাগজপত্র ঠিক ছিল, সেগুলো দেশে প্রবেশ করেছে। রোববার থেকে আর কোনো পেঁয়াজ দেশে আসবে না। তিনি আরও বলেন, এ মুহূর্তে দেশে বাজারে পেঁয়াজের কোনো ঘাটতি নেই। একধরনের অসাধু ব্যবসায়ীরা সুযোগ বুঝে দাম বাড়াচ্ছেন।
বিভিন্ন অনিয়মে ৮০ প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করল ভোক্তা অধিদপ্তর : পেঁয়াজের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাজধানীসহ সারা দেশে অভিযান পরিচালনা করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এ সময় দেশের ৪০টি জেলায় একযোগে এ অভিযান পরিচালিত হয়। ৪৩টি টিম বাজার অভিযান করে বিভিন্ন অনিয়মের দায়ে ৮০টি প্রতিষ্ঠানকে ৩ লাখ ৭০ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা করে।
বরিশালের পেঁয়াজের বাজার : বরিশাল ব্যুরো জানায়, ভারত থেকে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ায় অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে বাজারে। লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে দাম। হঠাৎ মূল্যবৃদ্ধির কারণে চরম বিপাকে পড়েছেন ভোক্তারা। বৃহস্পতিবার কেজিপ্রতি ৯০ টাকায় বিক্রি হলেও শুক্রবার ১৮০-২০০ টাকায় বিক্রি হযেছে। আর শনিবার থেকে বিক্রি হচ্ছে ২৪০ টাকা দরে।
বাগেরহাটে ডাবল সেঞ্চুরি : বাগেরহাট প্রতিনিধি জানান, একদিনের ব্যবধানে দেশী ও ভারতীয় পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি বেড়েছে ১০০-১২০ টাকা। শুক্রবার দেশি পেঁয়াজের দাম ছিল ১২০ টাকা কেজি, যা রোববার বিক্রি হচ্ছে ২২০ টাকা। পাশাপাশি ভারতীয় পেঁয়াজ ১০০ থেকে বেড়ে ২০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
দাগনভূঞায় জরিমানা : দাগনভূঞা (ফেনী) প্রতিনিধি জানান, দাগনভূঞায় বেশি দামে পেঁয়াজ বিক্রি করায় পাঁচ ব্যবসায়ীকে ১৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। শনিবার সন্ধ্যায় উপজেলার দাগনভূঞা ও দুধমুখা বাজারের বিভিন্ন দোকানে এ অভিযান পরিচালনা করা হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মেহরাজ শারবীন।
চিলমারীতে দেশি পেঁয়াজের কেজি ৩০০ টাকা : চিলমারী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, কুড়িগ্রামের চিলমারীতে হঠাৎ একরাতেই বেড়েছে পেঁয়াজের দাম। উপজেলার বিভিন্ন খুচরা বাজারে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা। রোববার বিকালে বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ২৮০-৩০০ টাকা এবং আমদানি করা পেঁয়াজ ২৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
পেঁয়াজ কেনা থেকে মুখ ফেরাচ্ছেন ভোক্তা
কেজি ২০০-২৪০ টাকা দরেই বিক্রি
ইয়াসিন রহমান
১১ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
এখনো অস্থির পেঁয়াজের বাজার। রোববার নতুন করে দাম না বাড়লেও খুচরা বাজারে প্রতি কেজি ২০০-২৪০ টাকা মূল্য হাঁকানো হচ্ছে। ফলে ক্রেতাশূন্য হয়ে পড়েছে পেঁয়াজের বাজার। পরিস্থিতি এমন-সামর্থ্য না থাকায় অনেক ক্রেতা পেঁয়াজ কিনতে পারছেন না। আবার অনেকেই অসাধু ব্যবসায়ীর প্রতি নীরব প্রতিবাদে পেঁয়াজ কেনা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। রোববার রাজধানীর একাধিক খুচরা বাজার ঘুরে ক্রেতা ও বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
এদিকে পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে সিন্ডিকেটের কারসাজিতে জড়িত কয়েক ডজন ব্যবসায়ীর নাম পেয়েছে জেলা প্রশাসন। ওই চক্রের সদস্যরা ‘ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করলে দেশে এর দাম কেজিপ্রতি ৩০০ টাকায় উঠবে’-এমন গুজব ছড়িয়ে দেয়। এরপর শুরু হয় পেঁয়াজ নিয়ে লঙ্কাকাণ্ড। ফলে ঘণ্টায় ঘণ্টায় বাড়তে থাকে পেঁয়াজের দাম। বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভারত রপ্তানি বন্ধ করলেও এ মুহূর্তে দেশে পেঁয়াজের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। কারণ, দেশে চলতি বছরে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে। আমদানিও হয়েছে অনেক। সঙ্গে বাজারে নতুন মুড়িকাটা পেঁয়াজ উঠতে শুরু করেছে। আর সরবরাহও পর্যাপ্ত। তাই দাম বাড়া একেবারেই অযৌক্তিক।
এদিকে পেঁয়াজের মূল্য নিয়েন্ত্রণে বাজার তদারকি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসনসহ একাধিক তদারকি সংস্থা সারা দেশে অভিযান পরিচালনা করছে। সরকারি সংস্থা টিসিবির পক্ষ থেকে কেজিপ্রতি ৫০ টাকা করে বিক্রি করা হচ্ছে। পাশাপাশি মূল্য নিয়ন্ত্রণে মাঠে গোয়েন্দা পুলিশ নামানো হয়েছে। এ সময় কোনো অনিয়ম পেলে কঠোর শাস্তির হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। আর ভারত থেকে আগের এলসি করা ১ হাজার ৩৪৩ টন পেঁয়াজ দেশে এসেছে। এরপরও ভোক্তার লাভের লাভ কিছুই হচ্ছে না।
রোববার রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ২২০-২৪০ টাকা, যা শনিবার একই দাম ছিল। তবে বৃহস্পতিবার বিক্রি হয়েছে ১৩০ টাকা। পাশাপাশি প্রতি কেজি আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ২০০-২২০ টাকা, যা শনিবার একই দাম ছিল। আর বৃহস্পতিবার বিক্রি হয়েছে ১১০ টাকা।
সকাল ১০টা। রাজধানীর নয়াবাজারে নিত্যপণ্য কিনতে এসেছেন সহিদুল ইসলাম। তার সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে কোনো ধরনের নৈতিকতা নেই। যে পেঁয়াজ বৃহস্পতিবার ১২০-১৩০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, সেই একই পেঁয়াজের দাম বিক্রেতারা ২৩০ টাকা চাইছেন। তাই আমি পেঁয়াজ না কিনে বাড়িতে ফিরছি। দাম না কমলে এখন আর পেঁয়াজ কিনব না। কারণ, কয়েকদিন পর দেশি পেঁয়াজ পুরোদমে বাজারে উঠবে। তখন কিনব। এটা অসাধু ব্যবসায়ীদের প্রতি আমার নীরব প্রতিবাদ। তিনি জানান, দেশের সরকারসংশ্লিষ্টরা দৃশ্যমান কোনো ভূমিকা নিচ্ছে না। বাজারে অভিযান পরিচালনা করে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই বাড়তি দরেই বিক্রি করছে। তাই আমরা ভোক্তারা পেঁয়াজ কেনা থেকে বিরত থাকলে ব্যবসায়ীরা দিশেহারা হয়ে পড়বে।
দুপুর ১টা। রাজধানীর কাওরান বাজারে পেঁয়াজ কিনতে আসেন হেলেনা বেগম। তিনি পেঁয়াজ বিক্রেতার কাছে দাম জানতে চাইলে দেশি পেঁয়াজের কেজি ২৩০ টাকা বলেন। সেসময় তিনি বিক্রেতাকে বলেন, আপনার পেঁয়াজ আপনি রেখে দেন। আমরা কিনব না। এ সময় তার সঙ্গে কথা বললে তিনি যুগান্তরকে বলেন, আমি দাম কমার আগ পর্যন্ত পেঁয়াজ কিনব না। এটা আমার প্রতিবাদ। এ সময় তিনি অন্য ক্রেতাদেরও পেঁয়াজ কেনা থেকে বিরত থাকতে বলেন।
কাওরান বাজারের খুচরা বিক্রেতা মো. মামুন বলেন, কাল ক্রেতা ছিল। আর রোববার কোনো ক্রেতা নেই। দাম বাড়ার কারণে ক্রেতারা পেঁয়াজ কিনছেন না। তিনি বলেন, আমরা পাইকারি বাজার থেকে কিনে এনে বিক্রি করি। সেখানে দাম বাড়তি থাকলে খুচরা বাজারেও বাড়ে। এখানে আমাদের কোনো হাত নেই। কিন্তু ভারত রপ্তানি বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে দাম কেন বাড়ালেন জানতে চাইলে তিনি যুগান্তরকে বলেন, এটা ব্যবসায়ীদের ধর্ম। অন্য ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে বিক্রি করেছে, তাই আমিও মূল্য বাড়িয়ে বিক্রি করেছি। তবে এটা আমার ঠিক হয়নি। রোববার রাজধানীর আগারগাঁও রাজস্ব ভবনে ভ্যাট দিবসের অনুষ্ঠানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, ভারত রপ্তানি বন্ধের একদিনের ব্যবধানে কেজিপ্রতি পেঁয়াজের দাম ৮০ টাকা বৃদ্ধি একবারেই অনৈতিক। নিত্যপণ্যের সংকট তৈরি হলেই অনেক ব্যবসায়ী এর সুযোগ নিয়ে থাকেন। ভারত পেঁয়াজ রপ্তানিতে শর্তারোপের পর একদিনেই হঠাৎ দাম ৭০-৮০ টাকা বেড়ে গেছে। এটা অবশ্যই দায়িত্বশীল আচরণ নয়। ব্যবসায়ীদের বুঝতে হবে দেশের জনগণের জন্যই ব্যবসা। ভারত রপ্তানি বন্ধের মাত্র ঘোষণা দিয়েছে, এ কারণে পরের দিনই দাম বাড়তে পাড়ে না। দাম বাড়তে তো সময় লাগার কথা।
একই দিন এক সংবাদ সম্মেলনে পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক টিম চকবাজার ও শ্যামবাজার এলাকায় মাঠে নেমেছে জানিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন- অর-রশীদ বলেন, বাজারে চড়া দামে পেঁয়াজ বিক্রি এবং সেই সঙ্গে এ পণ্যটি মজুত ও কালোবাজারি করা হলে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ ঘোষণার আগে যেসব এলসি করা হয়েছে, সেই পেঁয়াজ দেশে আসতে কোনো বাধা নেই। চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরে ভারত থেকে ৩৫ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ২০ হাজার টন চলে এসেছে। আরও ১৫ হাজার টন আসার অপেক্ষায় রয়েছে। এদিকে বৃহস্পতিবার ভারত রপ্তানি বন্ধের ঘোষণার পর শনিবার দেশের দুটি স্থলবন্দর দিয়ে ১৩৪৩ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে, যা আগের এলসি খোলা। এসব পেঁয়াজ দেশের বাজারেও চলে এসেছে। শনিবার চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ স্থলবন্দর ও সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে ৪৬টি ট্রাকে ওই পেঁয়াজ আনা হয়। সূত্র জানায়, আগের এলসি করা ৭৪৩ মেট্রিক টন পেঁয়াজ সোনামসজিদ স্থলবন্দর দিয়ে ২৬টি ট্রাকে দেশে আনা হয়েছে। দেশে আসা প্রতি মেট্রিক টন পেঁয়াজ ৮০০ ডলারে ক্রয় করা। সোনামসজিদ স্থলবন্দরের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ভারতের লোড করা আরও বেশ কিছু ট্রাক বন্দরে প্রবেশের অপেক্ষায় আছে।
পেঁয়াজ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান প্যানামা পোর্ট লিংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপক মো. কামাল হোসেন বলেন, ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের চিঠি আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো আমরা হাতে পাইনি। তবে দুপুর থেকে ভারতের ওপারে মহদিপুর থেকে বেশ কয়েকটি পেঁয়াজের ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ভারতের মহদিপুর সিএন্ডএফ এবং একাধিক রপ্তানিকারক জানিয়েছেন, আগের ৮০০ ডলারে এলসি করা টেন্ডারের পেঁয়াজের ট্রাক দেশে আসবে।
পাশাপাশি ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে এসেছে ৬০০ টন পেঁয়াজ। সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে ২০টি ট্রাকে এই পেঁয়াজ দেশে আনা হয়েছে। ভোমরা সিএন্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কাজী নওশাদ দিলওয়ার রাজু বলেন, বৃহস্পতিবার যেসব ট্রাকের কাগজপত্র ঠিক ছিল, সেগুলো দেশে প্রবেশ করেছে। রোববার থেকে আর কোনো পেঁয়াজ দেশে আসবে না। তিনি আরও বলেন, এ মুহূর্তে দেশে বাজারে পেঁয়াজের কোনো ঘাটতি নেই। একধরনের অসাধু ব্যবসায়ীরা সুযোগ বুঝে দাম বাড়াচ্ছেন।
বিভিন্ন অনিয়মে ৮০ প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করল ভোক্তা অধিদপ্তর : পেঁয়াজের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাজধানীসহ সারা দেশে অভিযান পরিচালনা করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এ সময় দেশের ৪০টি জেলায় একযোগে এ অভিযান পরিচালিত হয়। ৪৩টি টিম বাজার অভিযান করে বিভিন্ন অনিয়মের দায়ে ৮০টি প্রতিষ্ঠানকে ৩ লাখ ৭০ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা করে।
বরিশালের পেঁয়াজের বাজার : বরিশাল ব্যুরো জানায়, ভারত থেকে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ায় অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে বাজারে। লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে দাম। হঠাৎ মূল্যবৃদ্ধির কারণে চরম বিপাকে পড়েছেন ভোক্তারা। বৃহস্পতিবার কেজিপ্রতি ৯০ টাকায় বিক্রি হলেও শুক্রবার ১৮০-২০০ টাকায় বিক্রি হযেছে। আর শনিবার থেকে বিক্রি হচ্ছে ২৪০ টাকা দরে।
বাগেরহাটে ডাবল সেঞ্চুরি : বাগেরহাট প্রতিনিধি জানান, একদিনের ব্যবধানে দেশী ও ভারতীয় পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি বেড়েছে ১০০-১২০ টাকা। শুক্রবার দেশি পেঁয়াজের দাম ছিল ১২০ টাকা কেজি, যা রোববার বিক্রি হচ্ছে ২২০ টাকা। পাশাপাশি ভারতীয় পেঁয়াজ ১০০ থেকে বেড়ে ২০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
দাগনভূঞায় জরিমানা : দাগনভূঞা (ফেনী) প্রতিনিধি জানান, দাগনভূঞায় বেশি দামে পেঁয়াজ বিক্রি করায় পাঁচ ব্যবসায়ীকে ১৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। শনিবার সন্ধ্যায় উপজেলার দাগনভূঞা ও দুধমুখা বাজারের বিভিন্ন দোকানে এ অভিযান পরিচালনা করা হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মেহরাজ শারবীন।
চিলমারীতে দেশি পেঁয়াজের কেজি ৩০০ টাকা : চিলমারী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, কুড়িগ্রামের চিলমারীতে হঠাৎ একরাতেই বেড়েছে পেঁয়াজের দাম। উপজেলার বিভিন্ন খুচরা বাজারে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা। রোববার বিকালে বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ২৮০-৩০০ টাকা এবং আমদানি করা পেঁয়াজ ২৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by The Daily Jugantor © 2024