ক্রেতার নতুন শর্তে উদ্বিগ্ন পোশাক মালিকরা
একটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের নীতিকে ভুল ব্যাখ্যা করা উচিত নয় -বিজিএমইএ
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
শ্রম অধিকার নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রম স্মারক নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন পোশাক মালিকরা। সম্প্রতি একটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের এলসিতে উল্লিখিত নতুন শর্ত, সেই দুশ্চিন্তাকে আরও ঘনীভূত করেছে। যদিও বিজিএমইএ বলছে, এলসির শর্ত সেই প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক নীতি, এটি কোনো দেশের পক্ষে জারি করা আদেশ বা বিবৃতি নয়।
মঙ্গলবার চট্টগ্রামে এক মতবিনিময় সভায় ক্রেতার দেওয়া নতুন শর্তের বিষয়টি উল্লেখ করেন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান। তিনি বলেন, একটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ঋণপত্রের সাধারণ শর্তের সঙ্গে নতুন একটি শর্ত যুক্ত করেছে। তা হলো, বাংলাদেশ কোনো নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়লে তারা পণ্য নেবে না, যদি পণ্য জাহাজীকরণের পরও নিষেধাজ্ঞা আরোপের কোনো ঘটনা ঘটে তাহলেও ওই এলসির অর্থ দেবে না ক্রেতা প্রতিষ্ঠান।
তিনি আরও বলেন, পোশাক খাত কঠিন সময় পার করছে। এলসিতে নতুন শর্তের কারণে ব্যাংক ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি খুলতে চাইবে না। নতুন শর্তের কারণে অর্থপ্রাপ্তিতে কিছুটা অনিশ্চয়তা দেখা দিতে পারে। এছাড়া বিশ্ববাজারে পোশাক রপ্তানি কমে গেছে। সামনে নির্বাচন আছে, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণেও ব্যবসায় ধীরগতি দেখা দিতে পারে। এ অবস্থায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে। আগামী ৬ মাস বা ১ বছরের মধ্যে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
ফারুক হাসান আরও বলেন, পোশাক শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য সব অংশীজনের উচিত হবে নিজ নিজ অবস্থান থেকে এ শিল্পকে নিবিড় সহযোগিতা প্রদান ও সমন্বিত প্রচেষ্টা গ্রহণ করা। বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে আবির্ভূত চ্যালেঞ্জগুলো কাটিয়ে ওঠা এবং শিল্পের একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ তৈরি করার জন্য যৌথ প্রচেষ্টা এবং দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নেওয়া অপরিহার্য।
মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন বিজিএমইএর প্রথম সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সিনিয়র সহসভাপতি এসএম মান্নান কচি, সহসভাপতি (অর্থ) খন্দকার রফিকুল ইসলাম, সহসভাপতি মো. নাসির উদ্দিন, সহসভাপতি রাকিবুল আলম চৌধুরী প্রমুখ।
তবে এদিন রাতে এক বিবৃতিতে বিজিএমইএ জানায়, একটি ঋণপত্রের ধারার ব্যখ্যায় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হতে পারে বলে উদ্বেগ ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি করা হয়েছে, যা সঠিক নয়। কারণ ক্রয়াদেশটি একটি নির্দিষ্ট ক্রেতার কাছ থেকে এসেছে এবং এটি কোনো দেশের দ্বারা সংবিধিবদ্ধ আদেশ বা বিজ্ঞপ্তি নয়। সুতরাং এটিকে বাংলাদেশের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার আরোপের হিসাবে ভুল ব্যাখ্যা করা উচিত হবে না।
বিবৃতিতে বলা হয়, প্রতিটি স্বতন্ত্র ক্রেতা বা সত্তার নিজস্ব অভ্যন্তরীণ নীতি এবং প্রটোকল থাকতে পারে। তবে একটি এলসি কপি বা ব্যক্তিগত বাণিজ্যিক উপকরণ অফিশিয়াল কোনো ঘোষণা নয়। এছাড়াও বিজিএমইএ বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশন থেকে বা অন্য কোনো উৎস থেকে নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে কোনো তথ্য পায়নি।
বিজিএমইএ জানায়, শ্রমিকদের অধিকার এবং কল্যাণকে আমরা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছি। সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে একটি শ্রম রোডম্যাপ বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং ২০১৩, ২০১৮ এবং ২০২৩ সালে শ্রম আইনের সংশোধনসহ এটি বাস্তবায়নের জন্য সব প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। একটি কারখানার ইউনিয়ন নিবন্ধনের জন্য ৩০% শ্রমিকদের অংশগ্রহণের পূর্ববর্তী শর্ত (থ্রেশহোল্ড) শিথিল করে ২০% করা হয়েছিল, যা কিনা বাংলাদেশের শ্রম আইনের (বিএলএ) সাম্প্রতিক সংশোধনীতে আরও হ্রাস করে ৩০০০-এরও বেশি শ্রমিক নিয়োগকারী কারখানাগুলোর জন্য ১৫% করা হয়েছে। এছাড়া বিশ্বের সেরা পারফর্মিং বেটার ওয়ার্ক কারখানাগুলোর মধ্যে কয়েকটি বাংলাদেশে রয়েছে।
বিজিএমইএ আরও জানায়, আইএলও’র সঙ্গে আমরা প্রমোটিং সোশ্যাল ডায়ালগ অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশন ইন দি বাংলাদেশ আরএমজি সেক্টর (এসডিআইআর) শীর্ষক একটি প্রশিক্ষণ কর্মশালা/প্রকল্প সম্পন্ন করেছি। কারখানায় বিদ্যমান কমিটিগুলোকে শক্তিশালী করতে, বিশেষ করে অংশগ্রহণ কমিটি, নিরাপত্তা কমিটি এবং হয়রানি বিরোধী কমিটি শক্তিশালী করার জন্য বিজিএমইএ জিআইজেড এর সহযোগিতায় পাইলটিং ভিত্তিতে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি কারখানাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, ২০১৩ সালে মর্মান্তিক ভবন ধসের দুর্ঘটনার পর, শিল্পটি জাতীয় উদ্যোগের নেতৃত্বে একটি বড় নিরাপত্তা সংস্কারের মধ্য দিয়ে গেছে এবং ক্রেতাদের চালিত প্রোগ্রাম, অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ, অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার সেফটি দ্বারা উল্লেখযোগ্যভাবে সংস্কার হয়েছে।
এতে বলা হয়, শ্রমিকদের আর্থিক সুবিধার ক্ষেত্রে ২০১০ সাল থেকে ন্যূনতম মজুরি ছয় গুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে মজুরির ৫% হারে বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট এবং ২টি উৎসব ভাতা (প্রতিটি এক মাসের মূল মজুরির সমতুল্য) বাধ্যতামূলক করা হয়েছে: শ্রমিকদের চিকিৎসা ছুটি এখন অর্ধেক মজুরির পরিবর্তে ১৪ দিনের জন্য পূর্ণ মজুরিতে দেওয়া হচ্ছে, বার্ষিক ছুটির বিধান সংশোধন করা হয়েছে। এটি প্রতি ১৮ দিনের কাজের জন্য ১দিন করা হয়েছে, যা আগে প্রতি ২২ দিনের জন্য ১ দিন করা ছিলো। শ্রমিকরা আইন অনুসারে তাদের মোট বার্ষিক ছুটির ৫০% নগদায়ন করতে পারে, যা আগে আইনে ছিল না।
বিজিএমইএ’র বিবৃতিতে বলা হয়, সবুজ রূপান্তরের ক্ষেত্রেও আমরা এগিয়ে আছি। বাংলাদেশ এখন ২০৪টি লিড প্রত্যয়িত পরিবেশবান্ধব কারখানার আবাসস্থল, যার মধ্যে ৭৪টি প্লাটিনাম রেটেড এবং ১১৬টি গোল্ড রেটেড। আরও ৫০০ কারখানা সার্টিফিকেশনের জন্য প্রক্রিয়াধীনে রয়েছে। বিশ্বব্যাপী শীর্ষ ১০০টি সর্বোচ্চ মানের লিড পরিবেশবান্ধব কারখানার মধ্যে ৫৪টি বাংলাদেশে রয়েছে। শুধু তাই নয়, বিশ্বব্যাপী শীর্ষ ১০টির মধ্যে ৯টি এবং বিশ্বব্যাপী শীর্ষ ২০টি লিড প্রত্যয়িত কারখানার মধ্যে ১৮টি বাংলাদেশে রয়েছে। এটি সত্যিই গর্বের বিষয় যে বিশ্বের সর্বোচ্চ স্কোরিং কারখানাটি ১০৪ স্কোর নিয়ে বাংলাদেশে রয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, আমরা বুঝতে পারি যে আমাদের অনেক রপ্তানি বাজারের জন্য মানবাধিকার এবং পরিবেশগত ডিউ ডিলিজেন্স ক্রমবর্ধমানভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার আমাদের বাণিজ্য অংশীদারদের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। গত ১৬ নভেম্বর কর্মীর ক্ষমতায়ন, অধিকার এবং বিশ্বব্যাপী চলমান লেবার ক্যাম্পেইনের সঙ্গে উচ্চ শ্রমমান জুড়ে দিয়ে ইউএস প্রেসিডেন্সিয়াল মেমোরান্ডাম স্বাক্ষর হয়েছে, যা এনগেজমেন্ট এবং প্রয়োগের দিক থেকে বেশ স্বতন্ত্র বলে আমাদের কাছে মনে হচ্ছে। মার্কিন শ্রমনীতিতে কূটনৈতিক ও সহায়তার সম্পূর্ণ ব্যবস্থা এবং যথাযথ আর্থিক নিষেধাজ্ঞা, বাণিজ্য জরিমানা, ভিসা নিষেধাজ্ঞা এবং অন্যান্য পদক্ষেপ সহ বেশ কয়েকটি পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে। তবে এটি বাংলাদেশের জন্য গৃহীত নয়, বরং এটি শ্রমিক অধিকার ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা অবস্থান।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, আমরা অতীতেও একই ধরনের উদাহরণ দেখেছি; এক ক্রেতার কাছ থেকে আসা একটি এলসি ক্লজ উদ্ধৃত করে এটিকে বাংলাদেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা হিসাবে সাধারণীকরণ করা হয়েছে এবং আমরা এ ধরনের ভুল তথ্য উপস্থাপনের বিরুদ্ধে সব সময়ই আমাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছি। তবে আমরা বাণিজ্যিক কাগজপত্র ও উপকরণে এ ধরনের ধারা অন্তর্ভুক্ত করাকে সমর্থন করি না, যদি এটি শুধু বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অনুশীলন করা হয়।
বিজিএমইএ তার সদস্যদের, যারা ওপরে উল্লিখিত এই জাতীয় ধারাসহ এলসি গ্রহণ করে, তাদেরকে সংশ্লিষ্ট ব্র্যান্ডগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে এর একটি স্পষ্টীকরণ চাওয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছে। যদি ধারাটি কেবল বাংলাদেশি সরবরাহকারীদের অনুকূলে জারি করা এলসিগুলোতে থাকে, তবে এটি নৈতিকতা লঙ্ঘন করে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে, আমরা আমাদের সদস্য কারখানাগুলোকে বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব সহকারে নেওয়ার জন্য এবং প্রয়োজনে এ ধরনের ক্রেতাদের সঙ্গে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি পর্যালোচনা/পুনর্বিবেচনা করার জন্য অনুরোধ করব।