বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন
খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৫৫ হাজার কোটি
হামিদ বিশ্বাস
প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বিশেষ সুবিধা দেওয়ার পরও কমছে না ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ। বেড়েই চলেছে ব্যাংক খাতের ‘প্রধান সমস্যা’ খেলাপি ঋণের পরিমাণ। একবার কিছু কমছে তো আবার বেড়ে যাচ্ছে। গত জুন প্রান্তিকে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে খেলাপি ঋণে। স্বাভাবিকভাবেই ধারণা ছিল পরের প্রান্তিকে কমে আসতে পারে। কমেছেও তাই। আইএমএফের শর্ত বাস্তবায়ন করতে অবশেষে খেলাপি ঋণের লাগাম পড়ল। বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্য বলছে, দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এখন ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা। যা তার আগের প্রান্তিকের চেয়ে ৬৪২ কোটি টাকা কমেছে। আর এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি বেড়েছে ২১ হাজার কোটি টাকা।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করপোরেট গভর্ন্যান্স ও খেলাপি ঋণ ব্যাংকিং খাতের বড় দুই সমস্যা। ব্যাংক খাতে প্রধান এ সমস্যা মোকাবিলায় ঢালাওভাবে ছাড় দেওয়া ঠিক হবে না। বরং পরিকল্পনার মাধ্যমে ব্যাংকিং সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। খেলাপি নামের সমস্যা দূর করতে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় গ্রহীতা ও দাতার ক্ষেত্রে একইভাবে আইনের প্রয়োগ করতে হবে। পাশাপাশি নৈতিকতার অনুশীলন প্রয়োগেরও পরামর্শ তাদের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ১৫ লাখ ৬৫ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা। এটি মোট বিতরণ ঋণের ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এটি গত বছরের (সেপ্টেম্বর-২০২২) একই সময়ের চেয়ে ২১ হাজার কোটি টাকা বেশি। গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা।
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, খেলাপি ঋণ বন্ধে আমাদের দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই। এ নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপও নেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। খেলাপির যে চিত্র উঠে এসেছে, প্রকৃত চিত্র এটা নয়। প্রকৃত চিত্র আরও ভয়াবহ, আরও বড় হবে। কোভিড পরিস্থিতিতে ছাড় দেওয়া হলো, অন্য সময়ও ছাড় দেওয়া হচ্ছে। মোট ঋণের কিছুটা পরিশোধ করলেই আর খেলাপি হচ্ছেন না, এমন সুবিধার পরও সুফল কতটুকু?
ড. জাহিদ হোসেন আরও বলেন, গ্রাহককে ঋণ পরিশোধে বারবার সুযোগ দেওয়ার পরও কোনো সুফল আসছে না। যে রেগুলেশন আছে সেটা কঠোরভাবে প্রয়োগ হচ্ছে না, কঠোরভাবে করতে হবে। ঋণ বিতরণ ও ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে একই চোখে দেখতে হবে। এক কথায় লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকতে হবে। একদিকে ব্যাংক খাতে ঋণ আদায় হচ্ছে না, আবার বিতরণও হচ্ছে-এভাবে খেলাপি কমবে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জুন প্রান্তিক শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণ ঋণের পরিমাণ ছিল ১৫ লাখ ৪২ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছিল ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। এটি মোট বিতরণ ঋণের যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। প্রান্তিকটিতে দেশের ইতিহাসে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে খেলাপি ঋণ। আর মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি ৮০ লাখ টাকা বা মোট ঋণের ৮ দশমিক ৮০ শতাংশ। সে হিসাবে ৬ মাসের ব্যবধানে সবশেষ প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ বেড়ে ২৩ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা বেড়ে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। গত বছরের জুন শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের অন্যতম শর্ত হচ্ছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা। তবে এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২১ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। আইএমএফ’র শর্ত মতে, পুনঃতফশিল ও পুনর্গঠন করা ঋণ, সন্দেহজনক ঋণ ও আদালতের আদেশে খেলাপি স্থগিতাদেশ থাকা ঋণকেও খেলাপি দেখাতে হবে। সেক্ষেত্রে আএমএফ’র হিসাবে খেলাপি দাঁড়াবে প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি। মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর অবস্থান না থাকায় খেলাপি বাড়ছে বলে মত অনেকের।
এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার জানিয়েছিলেন, করপোরেট গভর্ন্যান্স ও খেলাপি ঋণ দেশের ব্যাংকিং খাতের বড় দুই সমস্যা। খেলাপি ঋণ কমাতে ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের আরও ভূমিকা নিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ জানিয়েছিলেন খেলাপি ঋণ কমাতে আমাদের তেমন সফলতা আসছে না। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও কঠোর হতে হবে। খেলাপি কমাতে না পারলে ব্যাংকগুলোর শাখা বন্ধের নির্দেশ দিতে হবে।