নির্বাচন কমিশনে প্রস্তাব উত্থাপন
বিচ্ছিন্ন বক্তব্য দেওয়ার পথ বন্ধের উদ্যোগ
কাজী জেবেল
প্রকাশ: ২৬ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
গণমাধ্যমে নির্বাচন কমিশনারদের বিচ্ছিন্নভাবে বক্তব্য দেওয়ার পথ বন্ধ করতে যাচ্ছে কমিশন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও নির্বাচন কমিশনারদের মধ্য থেকে কে গণমাধ্যমে বক্তব্য দেবেন তা নির্ধারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবনা চলতি সপ্তাহে কমিশনের কাছে উপস্থাপন করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়। ওই বিষয়ে সিদ্ধান্ত হলে শিগগিরই এ সংক্রান্ত অফিস আদেশ জারি হতে পারে। ওই আদেশ জারি হলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কিংবা কমিশনারদের মধ্যে একজন এবং ইসি সচিবালয়ের সচিব শুধু গণমাধ্যমে বক্তব্য দেবেন। বাকি নির্বাচন কমিশনারদের বক্তব্য দেওয়ার পথ রুদ্ধ হবে। ‘নির্বাচনের প্রত্যাশিত অনুকূল পরিবেশ’ নিয়ে সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনারদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানানোর রেশ না কাটতেই এ উদ্যোগ নেওয়া হলো। এদিকে সম্প্রতি তফশিল ঘোষণা করা তিনটি সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনের বিষয়ে কমিশনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আগের তথ্য গোপনের অভিযোগ উঠেছে ইসি সচিবালয়ের বিরুদ্ধে। ইসি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এ বিষয়ে গতকাল যোগাযোগ করা হলে নির্বাচন কমিশন সচিব মো. জাহাংগীর আলম যুগান্তরকে জানান, তিনি ঢাকার বাইরে অবস্থান করছেন। ঢাকায় ফিরে এ বিষয়ে কথা বলবেন। ইসির একাধিক কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তারা প্রকাশ্যে কথা বলতে রাজি হননি। তাদের কেউ কেউ জানান, নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সচিব মুখপাত্র হিসাবে কাজ করবেন-এটিই বিধিমালায় বলা আছে। সেখানে নির্বাচন কমিশনারদের গণমাধ্যমে বক্তব্য দেওয়ার বিষয়ে কিছু বলা নেই। এরপরও কোনো কোনো নির্বাচন কমিশনার বিচ্ছিন্নভাবে গণমাধ্যমে ব্রিফিং বা বক্তব্য ও মন্তব্য করছেন। ওই ব্রিফিং নিয়ে কমিশনের ভেতর ও বাইরে ভুল বোঝাবুঝির ঘটনাও ঘটেছে। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এ প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়েছে বলে মনে করেন তারা। তবে তারা এও বলেন, নির্বাচন কমিশনাররা সাংবিধানিক পদে রয়েছেন। ওই বিধিমালা মূলত কমিশন সচিবালয়ের কার্যক্রম কিভাবে পরিচালিত হবে তার জন্য প্রযোজ্য। যদিও সম্প্রতি বিশিষ্টজনদের সঙ্গে সংলাপে বিচ্ছিন্নভাবে বক্তব্য না দিয়ে একজন নির্বাচন কমিশনারকে মুখপাত্রের দায়িত্ব দেওয়ার পরামর্শ দেন কয়েকজন বক্তা।
নির্বাচন কমিশন (কার্যপ্রণালি) বিধিমালার ১১ ধারায় এ বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। সেখানে কমিশনের ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধি হিসাবে সচিবকে গণমাধ্যমে বক্তব্য দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া আছে। এতে বলা আছে, সচিব গণমাধ্যমকে ব্রিফিং প্রদান করবেন এবং ক্ষমতাপ্রাপ্ত না হলে সচিব ছাড়া অন্য কোনো কর্মকর্তা গণমাধ্যমে কোনো বক্তব্য রাখতে পারবেন না। এতে আরও বলা আছে, কোনো ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষ কমিশনের আওতাধীন কোনো বিষয়ের ওপর কোনো মতামত বা পরামর্শ চাইলে সেই ক্ষেত্রে কমিশনের সিদ্ধান্ত সচিবালয়ের মাধ্যমে উক্ত ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হবে।
১ নভেম্বর থেকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কাউন্টডাউন শুরু হচ্ছে। নভেম্বরের প্রথমার্ধে তফশিল ও জানুয়ারির শুরুতে ভোটগ্রহণের কথা বলে আসছে নির্বাচন কমিশন।
জানা গেছে, আজ নির্বাচন কমিশনে অনুষ্ঠেয় গণমাধ্যম সম্পাদকদের আমন্ত্রণপত্রের সঙ্গে পাঠানো ইসির একটি ধারণাপত্র নিয়ে কমিশনারদের মধ্যে দূরত্বের বিষয় প্রকাশ্যে চলে আসে। ওই ধারণাপত্রে উল্লেখ করা হয়, অংশগ্রহণমূলক ও উৎসবমুখর নির্বাচনের জন্য প্রত্যাশিত পরিবেশ এখনো হয়ে ওঠেনি। এরপরই নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান কয়েকটি গণমাধ্যমকে বলেন, ভোটের অনুকূল পরিবেশ নিয়ে সিইসি অন্য কমিশনারদের সঙ্গে আলোচনা করেননি। গণমাধ্যম সম্পাদকদের যে ধারণাপত্র পাঠানো হয়েছে সে বিষয়ে তারা জানেন না। নির্বাচনের পরিবেশ ভালো আছে বলেও তিনি দাবি করেন। আরেকজন নির্বাচন কমিশনারও অনানুষ্ঠানিকভাবে জানান, তিনি যখন আমন্ত্রণপত্র পাঠানোর ফাইল অনুমোদন করেন তখন ধারণাপত্রটি তার নজরে আসেনি। তাদের বক্তব্য নির্বাচন কমিশনে সমন্বয়হীনতা কিনা-এমন প্রশ্ন ওঠে। মঙ্গলবার এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আহসান হাবিব খান সাংবাদিকদের বলেন, সমন্বয়হীনতা নেই। অবশ্যই সমন্বয় আছে। ভোটের পরিবেশ আছে কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, অবশ্যই আছে। ভোটের পরিবেশ থাকবে না কেন, তা বুঝতে পারছি না। এই কমিশনারের ভাষায়, সিইসি বলেছেন, প্রত্যাশিত অনুকূল পরিবেশ নেই।
আরও জানা গেছে, ভোটের পর রাজনৈতিক মামলায় গ্রেফতার না করার বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীরের একটি বক্তব্যে সরকারের বিভিন্ন মহলে তোলপাড় হয়। ওই বক্তব্যের বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের কাছেও ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। এরপর থেকে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর গণমাধ্যমে বক্তব্য দিচ্ছেন না। কে বক্তব্য দেবেন সেই বিষয়টি তিনি সিইসির সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দেন। এমন পরিস্থিতির মধ্যে চলতি সপ্তাহে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের মধ্যে কে গণমাধ্যমে বক্তব্য দেবেন তার নির্দেশনা চেয়ে ফাইল উপস্থাপন করেছে ইসি সচিবালয়। গতকাল পর্যন্ত ওই বিষয়ে সিদ্ধান্ত পাননি বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
উপনির্বাচনের তথ্য গোপন : জানা গেছে, এদিকে সম্প্রতি তফশিল ঘোষণা করা তিনটি সংসদীয় আসনের উপনির্বাচন নিয়েও কোনো কোনো কমিশনারের মধ্যে ক্ষোভ দানা বাঁধছে। নির্বাচন কমিশনারদের কেউ কেউ মনে করছেন, ওই তিনটি সংসদ নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার বৈঠকে তাদের কাছে আগের নির্বাচনের রেফারেন্স গোপন করেছে ইসি সচিবালয়। ওই তথ্য গোপন করায় নির্বাচন কমিশন সরাসরি উপনির্বাচন আয়োজনের সিদ্ধান্ত দিয়েছে। কমিশন সচিবালয়ের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে এ তথ্যের সত্যতা পাওয়া গেছে।
ওই কর্মকর্তারা জানান, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ ও লক্ষ্মীপুর-৩ শূন্য আসনে উপনির্বাচনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে কমিশন বৈঠক বসে। ওই বৈঠকে ইসি সচিবালয়ের কাছে জানতে চাওয়া হয়, জাতীয় নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার আগে উপনির্বাচন না করার কোনো উদাহরণ আছে কিনা? এর জবাবে নির্বাচন কমিশন সচিবালয় কিছু জানে না বলে সভায় জানায়। এরপরই ওই সভায় সংবিধান অনুযায়ী ৯০ দিনের ভোট করার বাধ্যবাধকতা হিসাবে এ দুটি আসনের উপনির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেয়। একইভাবে সর্বশেষ মঙ্গলবার কমিশন সভায় পটুয়াখালী-১ আসনের উপনির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করে। পরে কমিশন জানতে পারে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কাউন্টডাউন শুরুর ১ মাস ১৮ দিন আগে কুড়িগ্রাম-২ সংসদীয় আসন শূন্য হলেও তৎকালীন কেএম নূরুল হুদা কমিশন ওই আসনে উপনির্বাচন করেনি। ২০১৮ সালের ১৩ আগস্ট বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী মারা যাওয়ায় ওই আসনটি শূন্য হয়। ওই বছরের ৩০ অক্টোবর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কাউন্টডাউন শুরু হওয়ায় সময় স্বল্পতার কথা বলে ওই নির্বাচন করেনি তৎকালীন কমিশন। বুধবার ওই নির্বাচন না করার বিষয়টি জানতে পারে কমিশন। এ বিষয়ে ইসি সচিবালয়ের কাছে মৌখিক ব্যাখ্যা জানতে চায় কমিশন।