অর্থ বিভাগের প্রতিবেদন
সরকারের ঋণ ১৪.৪৮ লাখ কোটি টাকা
রাজস্ব আদায় কম, কৃচ্ছ্রসাধনের নির্দেশনা উপেক্ষিত এবং ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণেই এমন পরিস্থিতি * বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে -ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম * ঋণ পরিশোধে বৈদেশিক মুদ্রার আয় সেভাবে বাড়ছে না, এটি খুবই বিপজ্জনক পরিস্থিতি -ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য
মিজান চৌধুরী
প্রকাশ: ০৮ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
সরকারের মোট ঋণের (অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক) দায় মার্চ পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৪ লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকা। মূলত কাঙ্ক্ষিত হারে রাজস্ব আদায় কম, ব্যয় নিয়ন্ত্রণে কৃচ্ছ্রসাধনের নির্দেশনা পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হওয়া এবং ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণেই ঋণের অঙ্ক দ্রুতগতিতে বাড়ছে। বিশেষ করে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি বৈদেশিক ঋণ ব্যয়কে উসকে দিয়েছে। দায় এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, এটি চলতি বাজেটের প্রায় দ্বিগুণের সমান। আবার ঋণের বিপরীতে সুদ পরিশোধ ব্যয়ও বাড়ছে। শুধু গেল অর্থবছরে (এক বছরের জন্য) ৮০ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকার সুদ গুনতে হয়েছে। অর্থ বিভাগের সর্বশেষ হিসাবে উঠে আসছে ঋণের তথ্য।
সূত্রমতে, অর্থ বিভাগ চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত সরকারের মোট ঋণের হিসাবটি তৈরি করেছে। এটি অর্থ বিভাগের সর্বশেষ হিসাব। ওই হিসাবে দেখা যায়, মোট ঋণের মধ্যে অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে অর্থাৎ ব্যাংক খাতে সরকারের দায় ৪ লাখ ৯৪ হাজার ১০১ কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্র ও অন্যান্য খাতে ঋণের দায় ৪ লাখ ২১ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। আর বৈদেশিক ঋণের অঙ্ক ৫ লাখ ৩৩ হাজার ১৯৮ কোটি টাকা।
অর্থ বিভাগের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারের মোট ঋণ ছিল ১৩ লাখ ৫৯ হাজার ৮৯৮ কোটি টাকা। সেখান থেকে বেড়ে গত মার্চ পর্যন্ত ঋণের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৪৮ হাজার ৩৩৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসে দায় বেড়েছে ৮৮ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, রাজস্ব আদায়ের পারফরমেন্স সন্তোষজনক নয়। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রাজস্ব আদায়ের অঙ্ক অনেক নিচে আছে। অপরদিকে সরকারের ব্যয়ও কমছে না। ব্যয় কমাতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কৃচ্ছ্রসাধন কর্মসূচি দিলেও অনেক ক্ষেত্রে পুরোপুরি নির্দেশনা মানা হচ্ছে না। ব্যয় মেটাতে ঋণ করছে বেশি। তিনি আরও বলেন, এই অধিক ঋণ নেওয়ায় বেসরকারি খাতে ঋণ কমবে। ফলে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ওপর বিরূপ প্রভাব আসবে।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য যুগান্তরকে বলেন, সরকারের ঋণের দায় বাড়ছে, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। এটি পরিশোধ করার জন্য বৈদেশিক মুদ্রার আয় সেভাবে বাড়ছে না। এটি খুবই বিপজ্জনক একটা পরিস্থিতি। এছাড়া অভ্যন্তরীণ আয় এমন পর্যায়ে যায়নি যে রাজস্ব আদায় বাড়ছে। এ প্রেক্ষাপটে সরকারের ঋণ পরিস্থিতি নিয়ে একটি পর্যালোচনা করা দরকার আছে। বিশেষ করে ঋণের মধ্যম মেয়াদি প্রাক্কলন করে একটি কৌশল বের করতে হবে। ঋণ পরিস্থিতি যেমন আছে, তেমন রাখার সুযোগ এখন আর নেই।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ঋণের ঝুঁকি স্কোর নির্ণয় করেছে। এই সংস্থার হিসাবে একটি দেশ তার মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ গ্রহণ করতে পারবে। এর ওপরে গেলে দেশটি ঝুঁকিতে পড়বে। ওই হিসাবে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত ঋণ নিয়েছে জিডিপির ৩২ দশমিক ৫৫ শতাংশ। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের অনুপাত ২০ দশমিক ৫৭ শতাংশ এবং বৈদেশিক ঋণের অনুপাত ১২ দশমিক ০১ শতাংশ। ফলে অর্থ বিভাগের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে ঋণ গ্রহণে বাংলাদেশ ঝুঁকিমুক্ত আছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে জানান, বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-এর বিশ্লেষণ ধরে বলতে গেলে দীর্ঘ মেয়াদে এখনো ঋণ ঝুঁকিতে নেই বাংলাদেশ। কিন্তু ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে ডলারে। এখন ডলার সংকট, অন্য জায়গায় ডলার দেওয়া যাচ্ছে না। তখনই ঋণটি বোঝা হয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি না থাকলেও নগদ ডলারের সংকটের কারণে স্বল্পমেয়াদে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে কোনো হস্তক্ষেপ সম্ভব নয়। কারণ, মেয়াদ হয়েছে, এখন শোধ করতেই হবে। না দিলে আবার ভবিষ্যতে ঋণ গ্রহণে বিপদ আসবে।
জানা যায়, বিদেশ থেকে স্বল্প মেয়াদের ঋণগুলো নেওয়া হয়েছে কম সুদে। দীর্ঘমেয়াদি ঋণও রয়েছে। এখন স্বল্পমেয়াদি ঋণগুলোর সুদ পরিশোধের সময় আসছে এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণের আসলও পরিশোধ করতে হচ্ছে। বৈদেশিক ঋণের পুরোটাই শোধ করতে হচ্ছে মার্কিন ডলারে। গেল অর্থবছরে (২০২২-২৩) ১৭০ কোটি টাকা ডলারের বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ করা হয়। বিপরীতে সুদ পরিশোধে গেছে ১৮০ কোটি ডলার।
সংশ্লিষ্টদের মতে, কোভিড-১৯ আঘাত হানার পর ঋণের বহর বেড়েছে বেশি। যে কারণে রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী হচ্ছে না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে বিদায়ি (২০২২-২৩) অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্য ঠিক করে দেওয়া হয়েছিল, এর ৮৯ শতাংশ অর্জন করতে পেরেছে এনবিআর। এনবিআর-এর শুল্ককর আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। বছর শেষে দেখা গেছে, ৩ লাখ ৩১ হাজার ৫০২ কোটি টাকা আদায় হয়েছে।
এছাড়া অতিরিক্ত খরচ, আর্থিক বৃদ্ধির গতি শ্লথ হওয়াও এর অন্যতম একটি কারণ। এখন অন্য অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্পগুলো চালিয়ে যেতে হলে বাজেটের ঘাটতির অঙ্ক বাড়াতে হবে। কিন্তু এই ঘাটতি বাড়াতে গেলে আরও ঋণ করতে হবে। না হলে সরকারকে সাশ্রয়ী হতে হবে। ব্যয় সাশ্রয়ের নানা কথা শোনা গেলেও মোটা দাগে সেটি কার্যকর হচ্ছে না। সব মিলে এক ধরনের চাপের মধ্যে পড়বে ঋণ নিয়ে।
সূত্র জানায়, কোভিড-১৯ মোকাবিলায় জরুরিভাবে স্বাস্থ্য খাতের ব্যবস্থাপনা, টিকা দেওয়া কার্যক্রমসহ অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে একদিকে প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়, অপরদিকে বৈদেশিক সহায়তা পাওয়ার বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করে সরকার। ফলে ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিদেশ থেকে ২৪০ কোটি মার্কিন ডলার, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬৫৫ কোটি ডলার এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ঋণ পাওয়া গেছে ৪৫৯ কোটি ডলার।